Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণপরিবহনে ঠাসাঠাসি যাত্রী

বিধিনিষেধ মানছে না ঢাকার বাস মালিকরা

একলাছ হক | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

রাজধানীর সবগুলো রুটে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে
যানবাহন ও মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে
দেশে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। অর্ধেক জনবল দিয়ে সরকারি অফিস চালানো হচ্ছে। আদালত চলছে ভার্চ্যুয়ালি। মন্ত্রিপরিষদ ১১ দফা বিধিনিষেধ দিয়েছে। গণপরিবহনে প্রথমে ‘অর্ধেক সিটে যাত্রী’ পরবর্তীতে ‘যত আসন তত যাত্রী’ নিয়ে চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু গণপরিবহণগুলো সরকারি নির্দেশনা তোয়াক্কাই করছে না। রাজধানী ঢাকার প্রতিটি রুটের বাসে ঠাঁসাঠাঁসি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। গুলিস্তান থেকে প্রায় ৫০টি রুটে কয়েক হাজার বাস চলাচল করছে। প্রতিটি বাসে আসনের চেয়ে অধিক যাত্রী নেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা গণপরিবহণে এমন দশা করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনকে আমন্ত্রণের নামান্তর।

জানতে চাইলে রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, গণপরিবহণের মানুষের যাতায়াত দেখে মনে হচ্ছে আমরা করোনাভাইরাসকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আসলে সরকারকে জনগণকে নিয়ে সক্রিয়ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবার নির্দেশ দিলেই হবে না। তা কার্যকরে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, করোনার শুরুতে যেটা তাদের করতে হয়নি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক ব্যবহার করা জনসাধারণকে উৎসাহিত করার জন্য একটা জাতীয় কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। একই সাথে যদি কেউ এটি মেনে না চলে তাহলে শাস্তির ব্যবস্থা করে সেটা মানুষকে জানানো এবং কি শাস্তি দিতে হবে। তবেই মানুষ সচেতন হবে।

প্রতিদিন বেড়েই চলেছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। নতুন ধরন ওমিক্রনের ধাক্কা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে। ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। দৈনিক পরিসংখ্যানে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা ঊর্ধমুখী। এমনকি টিকা গ্রহণকারীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ওমিক্রনে। পরিস্থিতি কথা বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে বিধিনিষেধ। এর মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য গণপরিবহনের যাত্রী ধারনের বিষয়টিও। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ঠেকাতে সরকারের বিধিনিষেধ থাকলেও গণপরিবহন খাতে সবকিছুই যেন অকার্যকর।

সরকারি বিধিনিষেধকে বৃদ্ধাগুলি প্রদর্শন করে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা। গণপরিবহনের মালিকরা নিয়মিত তদারকি করছেন কিনা তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। যাত্রীবাহী বাসের চালক ও চালকের সহকারী হেলপাররা যেন কারো কোন কথাই শুনছেন না। যাত্রীবাহী বাসগুলো পাল্লা দিয়েই উঠাচ্ছে যাত্রী।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জায়গা ধীরে ধীরে দখলে নিচ্ছে ওমিক্রন। সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ১০ জানুয়ারি ১১ দফা বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১৩ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে বিধিনিষেধ কার্যকর হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল গণপরিবহনে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীরা। করোনার ভয়াবহতায় এখন অধিকাংশ যাত্রী গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে বাড়তি সচেতনতা অবলম্বন করছেন। কিন্তু সেটা হয়তো কোনো কাজেই আসবে না, যতক্ষণ গণপরিবহনের চালক ও শ্রমিকরা সচেতন না হবেন। রাজধানীর সব গণপরিবহনে চালক ও হেলপারের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার কথা বলা হলেও ১০ ভাগ ক্ষেত্রেও সেটি দেখা যাচ্ছে না। বরং মাস্ক না পরার প্রতিই তাদের উৎসাহ বেশি। বাসে জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে না। সুযোগ পেলেই গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এ অবস্থা করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশে বলা হয়, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ও দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাÐ সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

বিধিনিষেধগুলো হলো বাস, ট্রেন ও লঞ্চে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। আর সব ধরনের যানবাহনের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে করোনার টিকা সনদ থাকতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সমাবেশ বন্ধ রাখা এবং দোকান, শপিংমল, বাজার ও হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। না পরলে আইনানুগ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া ও আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই করোনার টিকা সনদ দেখাতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিধিনিষেধের মধ্যে আরও রয়েছে স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দরগুলোতে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়ানো। ক্রুদের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। স্থলবন্দরগুলোতে আসা ট্রাকের সঙ্গে শুধু চালক থাকতে পারবেন, কোনো সহকারী আসতে পারবেন না। বিদেশগামীদের স্বাগত জানাতে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ থাকবে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলক করোনার টিকা সনদ দেখাতে হবে এবং র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন এবং মাস্ক পরার বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, আগের অভ্যাসেই যাত্রী পরিবহনে ব্যস্ত চালক ও হেলপাররা। যাত্রীবাহী বাসগুলো ছুটছে যাত্রীদের পিছনে। বাসস্ট্যান্ডগুলোতে এসে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বেশিভাগ বাস। যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা বাসের চাপে সড়কে দেখা দেয় যানজট। আর বাড়তি ভাড়া আদায়ের কারণে হেরপার ও যাত্রীর মাঝে দেখা দেয় বাগবিতÐা। কোন বাস চালক, সুপারভাইজার ও হেলপাকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। তাদের কারো মুখে মাস্ক নেই। অফিস টাইমে কর্মজীবীরা লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে ছুটছেন। বাসের ভেতরে গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতেও দেখা যায়নি কোনো গণপরিবহনে। বাসের হেলপাররা অতিরিক্ত যাত্রী তুলছেন। পরিবহন শ্রমিকদের উদাসীনতা এবং যাত্রীদের প্রচÐ ভিড়ে উপেক্ষিতই রয়ে গেলো স্বাস্থ্যবিধি। সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে সড়কে চলছে বাস। পাশাপাশি রয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতা।

অন্যদিকে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দেশের সব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু অনলাইনে শিক্ষার্থীদের কতটুকু পড়ালেখা করা হবে সে বিষয় নিয়েও উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। অনেক অভিভাবক বলছেন গণপরিবহনে গাদাগাদি, বাজারে মানুষের উপচেপড়া ভিড়, শপিংমল খোলা, রাস্তা-ঘাটে মানুষের বেশি চাপ, রেস্টুরেন্টগুলোতে ভিড় দেখা যায়। কিন্তু শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কোন সমাধান হতে পারে না।
রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী নাজিমুল হাসান বলেন, কলেজ বন্ধ রেখে সব কিছু খোলা তাই আমাদের লেখাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে না। আর যাত্রীবাহী বাসগুলোতে এখন উঠা যায়না। কোন বাসেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। আবার বাস ভাড়াও এখন আগের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। আমাদের কারো কোন কথা বাসের চালক ও হেলপাররা শুনেনা।

বাস যাত্রী নয়ন বলেন, বাসের নির্ধারিত ভাড়া কেউই মানছে না। এখনো সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিল সিস্টেমে ভাড়া কাটা হচ্ছে। ভাড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে তর্ক হচ্ছে। বাসে কোন কোন যাত্রীকে মাস্ক পড়লেও বেশিরভাগ যাত্রীই সচেতন না। বাসে সিট না থাকলে বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে যেতে হয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার পরিস্থিতিও নেই। এতো যাত্রীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানা প্রায় অসম্ভব।

শিকড় পরিবহনের এক চালক বলেন, যাত্রীরা আমাদের কথা শুনেন না। এখন আর আমরা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার কথাও বলি না। বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আমরা রাখলেও কেউ চায় না। কোন যাত্রীই এগুলো ব্যবহার করতে চায় না। যাত্রীরা জোর করে ওঠে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সাধারণ যাত্রীদের কথা কেউই বিবেচনা করে না। সব আসনে যাত্রী পরিবহন করা হোক, কিন্তু তাতে যাতে স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে পরিপালন করা হয়। এ কথা আমরা আগেও বলেছি। কিন্তু সরকারের কোন নজরদারি নেই। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে করোনা মহামারি আরও ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবেই। নিয়মের বাইরে এখনো ভাড়া বেশি নিচ্ছে গণপরিবহনগুলো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ