Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মৃতদের জন্য জীবিত আপনজনদের করণীয়

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,‘হে নবী আপনি বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালায়ন করছ, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাত করবে। অতপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এমন সত্তার কাছে, যিনি দৃশ্য-অদৃশ্য সকল কিছুই জানেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত করবেন।’ [সূরা জুমআ:৮] অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর কিয়ামত দিবসে তোমাদেরকে দেওয়া হবে তোমাদের কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান। যে ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হলো আর জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো সে সফলতা লাভ করল। [সূরা আলে ইমরান:১৮৫] পবিত্র এই আয়াত দুটির বার্তা হচ্ছে, মৃত্যু অনিবার্য। অনিবার্য এই মৃত্যুর ডাকে সবাই সাড়া দিবে। পাড়ি জমাবে দুনিয়ার ওপারে। সাড়া না দিয়ে কেউ পার পাবে না। সকল ক্ষমতাধরের ক্ষমতা এখানে অসহায়। দুনিয়ার কোনো শক্তিই অনিবার্য মৃত্যুর ডাক রুখতে পারবে না। অনস্বীকার্য এই বাস্তবতাকে সবাই স্বীকার করে। এ কথাও সবাই স্বীকার করে যে, মৃত্যুর পর দুনিয়া থেকে সবাই একাই যাবে। কেউ সঙ্গী হবে না।

মৃত্যুর সময় নির্ধারিত
এ মৃত্যু যেভাবে অনিবার্য, মৃত্যুর নির্ধারিত সময়ও অনিবার্য। মৃত্যুর নির্ধারিত সময় এড়িয়ে যাওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অসীম কুদরতের মালিক আল্লাহর পক্ষ থেকে যার জন্য যতটুকু হায়াত নির্ধারিত, যার মৃত্যুর জন্য যে সময় লিখে রাখা হয়েছে, এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই কারও। এই ঘোষণা পবিত্র কুরআনের একাধিক স্থানে মহামহিম আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, তাদের মৃত্যুর সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন মুহূর্তকাল বিলম্বও করতে পারবে না এবং মুহূর্তকাল ত্বরান্বিতও করতে পারবে না।’ [সূরা নাহল:৬১] তাই নির্ধারিত সময়েই সকলের মৃত্যু হবে। এখানে কারও করার কিছুই নেই। দুনিয়ার এই ক্ষুদ্র জীবনে কতজনের সাথে কতভাবে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু মৃত্যু এসে সকল বন্ধন ও সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে তাকে একাকী তুলে নিয়ে যায়। দুনিয়ায় থেকে যায় তার পরিবার-পরিজন, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীসহ কত আপনজন। সঙ্গে কেউ যায় না। একাই যেতে হয়। এভাবে একে একে সবাইকেই চলে যেতে হয়। কেউ আগে, কেউ পরে। যেতে হয় সকলকেই। যাদেরকে আপাতত দুনিয়ায় রেখে যায় তাদের কিছু করণীয় থাকে মৃতদের জন্য। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য কিছু করণীয় থাকে সুস্থ ব্যক্তিদের। এই করণীয়গুলো মূলত জীবতদের উপর মৃত ও মৃত্যুপথযাত্রীদের হক বা অধিকার।

কোনো কিছু ভালো বলে বিবেচিত হওয়ার জন্য সুন্দর সমাপ্তি জরুরী
কোনো কিছু ভালো বলে বিবেচিত হওয়ার জন্য সুন্দর সমাপ্তি জরুরী। এ বিষয়ে বাংলায় একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদও আছে। প্রবাদটি হলো- ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। বাস্তবতাও এমনি। যে কোনো বিষয় ভালোভাবে শেষ হলে তার প্রসংশার কোনো শেষ থাকে না। আবার শেষটা যদি কোনো কারণে খারাপ হয়ে যায়, তাহলে নিন্দা ও তিরিস্কারের ঝড় বয়ে যায়। কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে মৃত্যুর বিষয়টিও এমনি। পরপারে সুন্দর ও সুখময় জীবনের জন্য সুন্দর মৃত্যুর বিকল্প নেই। মৃত্যুটা যদি ঈমানের সঙ্গে হয়। বিদায়কালে ঈমানটা যদি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে দুনিয়ার পাহাড়সম দুঃখ-কষ্ট, ব্যাথা-বেদনা সবই তখন তুচ্ছ। আর যদি এর বিপরীত কিছু হয়, শয়তানের ধোঁকায়, নফসের প্রবঞ্চনায় নিজের ঈমানটা খুইয়ে বসে, ঈমান হারিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়, তাহলে দুনিয়ার সকল সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ সব কিছুই তখন গৌণ। তার পরকালের পুরো জীবনটাই কাটবে শুধু অসহ্য দুঃখ-কষ্ট আর আযাব-গযবে। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আমল তো শেষ অবস্থা অনুসারেই বিবেচিত হবে।’ [বুখারী, হাদীস:৬৬০৭] হাদীসটির ভাষ্যমতে যার মৃত্যু সুন্দর হবে, ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে, তার পরকালের জীবনটাও সুন্দর হবে। ফুলে-ফলে ভরে উঠবে তার পরকালীন জীবন। তাই সুন্দর মৃত্যু হওয়াটা পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আপনজনদের করণীয়
১. দুআ করা
এ জন্য একজন মৃত্যুপথযাত্রীর আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের উচিত তার সুন্দর মৃত্যুর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। কুরআন-হাদীসের আলোকে একজন মৃত্যুগামী ব্যক্তির সহজ ও সুন্দর মৃত্যুর জন্য তার আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের কিছু করণীয় আছে। তার মধ্যে একটি হলো, তার জন্য দুআ করা। এ আমলটি দূরের কাছের সবাই করতে পারেন। তার মৃত্যু যেন ঈমানের সঙ্গে হয় এবং সহজ হয়- এ দুআ করা। এ দুআটুকুর জন্য পাশে বা কাছে থাকার প্রয়োজন হয় না। যারা সংবাদ পেয়েছে সবাই এ দুআ করতে পারে। সুন্দর মৃত্যুর জন্য এ দুআ খুবই জররী। আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের এ দুআর কল্যাণে যদি মৃত্যুগামী ব্যক্তির মৃত্যু সুন্দর ও সহজ হয়, তাহলে তো সে চির সফল। মহা সৌভাগ্যবান। কিন্তু আমাদের অবস্থা হলো, কোনো মুমূর্ষ রোগীর সংবাদ পেলে বারবার তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি-অবনতির খোঁজ-খবর নিতেই ব্যস্ত সময় পার করি। এগুলো অন্যায় বা ভালো নয়, তা আমি বলছি না। আামি বলতে চাচ্ছি, এগুলোর পাশাপশি তার জন্য দুআ করাটা বেশি জরুরী; বরং এখন সুন্দর মৃত্যুর জন্য দুআটাই তার বেশি দরকার। এই দুআতে কেবল মৃত্যুগামী ব্যক্তির উপকার হবে- ব্যাপারটি এমন কিন্তু নয়; বরং দুআকারীরও এতে ব্যাপক উপকার হয়। এক হাদীসে আছে, কেউ যদি তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের জন্য দূর থেকে দুআ করে, তাহলে ফিরিশতারা বলেন, দুআকারীকেও যেন দুআকৃত বিষয়গুলো দান করা হয়। তাই কোনো আপনজন মৃত্যুগামী ব্যক্তির সুন্দর, সহজ ও ঈমানের সাথে মৃত্যুর জন্য দুআ করলে আশা করা যায়, দুআকারীরও মৃত্যু হবে সুন্দর, সহজ ও ঈমানের সঙ্গে।

২. কালীমার তালকীন করা
দ্বিতীয় করণীয় হলো, মাইয়িতকে কালীমার তালকীন করা। এ ব্যাপারে সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রা. এর বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের মৃত্যুপথযাত্রীদের ‘লা ইলাহ ইল্লাহ’র তালকীন কর। [ সহীহ মুসলিম, হাদীস:৯১৬-৯১৭] ‘লা ইলাহ ইল্লাহ’র তালকীনের অর্থ হলো, মুমূর্ষ ব্যক্তির পাশে বসে মৃদু আওয়াজে [এমন আওয়াজ যেন কালিমার আওয়াজ মুমূর্ষ ব্যক্তি শুনতে পায়] কালিমা পড়তে থাকা। তবে মনে রাখতে এ অবস্থায় তাকে কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করে কালিমা পড়ার আদেশ করা যাবে না। কোনো প্রকার জোরাজুরি করা যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই নিয়ম হলো, তার পাশে বসে মৃদু আওয়াজে কেবল কালিমা পড়তে থাকা। কালিমা বলুন বা এ জাতীয় কিছু বলা যাবে না। তার পাশে বসে যখন এভাবে কালিমা পড়া হবে এবং তিনি যখন কালিমার আওয়াজ শুনতে পাবেন, তখন আশা করা যায়, তিনি নিজেই কালিমা পড়ে নিবেন। আর যার মৃত্যু হবে কালিমার সাথে, যার শেষ কথা হবে এই কালিমা, হাদীসের ভাষ্যমতে তিনি জান্নাতী। সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যার দুনিয়ার জীবনের শেষ কথা হবে লা ইলাহ ইল্লাহ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস:৩১১৬] সুবহানাল্লাহ! কি চমৎকার সুসংবাদ! তাই আমাদের উচিত এই অবস্থায় অন্য ব্যস্ততা কমিয়ে মুমূর্ষ ব্যক্তির পাশে বসে মৃদু আওয়াজে কালিমা পড়তে থাকা।

৩. সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করতে থাকা
মুমূর্ষ ব্যক্তির জন্য তৃতীয় আরেকটি আমলের কথা হাদীসে পাওয়া যায়। সেটি হলো, মুমূর্ষ ব্যক্তির পাশে থেকে সূরা ইয়াসীন
তিলাওয়াত করতে থাকা। সাহাবী মাকাল ইবনে ইয়াসার রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের মৃত্যুপথযাত্রীদের পাশে বসে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত কর।’ [সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস: ৩১২১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস:৩০০২] আপনজনদের উচিত মুমূর্ষ ব্যক্তির সুন্দর ও সহজ মৃত্যুর জন্য উপরোক্ত আমলগুলো গুরুত্ব দিয়ে করা।

মৃত্যুর পর আপনজনদের করণীয়
১. দ্রুত দাফন কার্য সম্পন্ন করা
কেউ মারা গেলে তার রেখে যাওয়া আপনজনদের কিছু করণীয় থাকে। এগুলোর মধ্যে সর্ব প্রথম যে কাজটি করতে হয়, তা হলো তাকে যথাযথ নিয়মে গোসল দিয়ে কাফন পড়িয়ে খুব দ্রুত দাফন কার্য সম্পন্ন করা। কিন্তু নানা কারণেই দাফন বিলম্বিত করা হয়। কখনও দূর-দূরান্তের আপজনদের অপেক্ষায়, কখনও জানাযায় অধিক মুসল্লী অংশ গ্রহণের আশায়, কখনও আবার মৃতদেহ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে জানাযা বিলম্ব করা হয়। (চলবে)
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃতদের জন্য জীবিত আপনজনদের করণীয়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ