বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
গত ১৫ অক্টোবর দেশের একটি জাতীয় দৈনিক শিরোনাম করেছে ‘৪৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না’। এই প্রতিবেদনের এক স্থানে বলা হয়েছে, ৫৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন। একই সাথে আরো বলা হয়েছে, রাজশাহী অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে সৃজনশীল প্রশ্ন করার হার সবচেয়ে বেশি, ৭৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর ৬৪ দশমিক ১৮ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীলে সম্পূর্ণরূপে প্রশ্ন করতে পারেন। ইতিবাচক এই কথাগুলো থাকা সত্ত্বেও নেতিবাচক বাক্য দিয়ে শিরোনাম করার পেছনে হয়তো তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। অধিকাংশ মানুষের মাঝেই মানবিক অক্ষমতা ও দুর্বলতার একটি অংশ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে শিক্ষক সমাজকে নিয়ে পত্রিকাটি নেতিবাচক শিরোনাম করায় শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি হওয়ার যে সুযোগ করা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। যাইহোক সৃজনশীল বলে কথা। মুখস্থ বিদ্যার গ-ি থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মেধা আর মননের বিকাশের জন্য চালু করা হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। ১৯৫৬ সালে মার্কিন শিক্ষা মনোবিদ বেঞ্জামিন এস ব্লুম এর দেখানো চিন্তা করার সহজ থেকে কঠিন ধাপগুলো হলো জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। চিন্তা করার এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়ন করা হয়।
২০০৮ সালে সর্বপ্রথম সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা হলেও দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পাননি বলে খবরে প্রকাশ। আর যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাদের বৃহৎ একটি অংশ ১/৩/৫ দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। দেখা যায়, ৩ দিনের প্রশিক্ষণ পেলে তার প্রথম দিনের অর্ধবেলা নিবন্ধন ও পরিচয় এবং শেষ দিনের শেষ বেলা বিদায় সম্ভাষণের মধ্য দিয়েই প্রশিক্ষণ শেষ হয়। তবে দু’সপ্তাহের কম সময় প্রশিক্ষণ হলে যথাযথ মানে উন্নিত করা কারো কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমার শিক্ষকতার ১০ বছরের মধ্যে যতগুলো প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছি, সব সময়ই প্রশিক্ষকদের বলতে শুনেছি, ‘এই প্রশিক্ষণের জন্য যতটুকু সময় নির্ধারণ করা হয়েছে তা যথেষ্ট নয়।’ আবার একই সাথে সারাদেশের সর্বস্তরের সকল প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করতে হবে। সকল শিক্ষককে মাস্টার ট্রেইনারদের মতো ১২/১৮ দিন প্রশিক্ষণ দেয়া না গেলেও অন্তত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একজনকে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলে তার মাধ্যমে অন্যসব শিক্ষককে যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিয়ে প্রশিক্ষণ দিলে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। এজন্য প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক উভয়কে আন্তরিক হতে হবে। তাছাড়া ‘ইনহাউস প্রশিক্ষণ’ বেশ কার্যকর। আর যারা দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা যদি বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণবিহীন অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন তাহলে কম সময়েই অধিক পরিমাণ শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেতে পারেন। আর ইনহাউজ প্রশিক্ষণকে আরো কার্যকর করতে বিদ্যালয়ভিত্তিক মনিটরিং জোরদার করতে হবে। একই সাথে শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতিতে দক্ষ করে তুলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম সেসিপের বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। যাতে করে দেশের সকল শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের আওতায় আসতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আবার যেসব শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার মেয়াদ ১-৩ বছর আছে, তাদের অনেকেই এসব প্রশিক্ষণে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন না। তারা মনে করছেন আমি তো বেশি দিন চাকরি করবো না। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার লাভ কী? কোনো মতে দিনটি পার হলেই চলে। এই ধরনের মনোভাব পোষণকারী শিক্ষককে অযোগ্য বললেও কম বলা হবে।
মানসম্মত একটি প্রশ্ন তৈরি করতে শিক্ষককে পর্যাপ্ত সময় দিতে হয়। অধিকাংশ শিক্ষকরা সেই সময়টুকু পান না। কেউ আবার সেই সময়ও দিতে চান না। অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন তৈরির জন্য শিক্ষককে কোনো ধরনের সম্মানী দেয়া হয় না বলে দায়সারাভাবেই তারা প্রশ্ন করেন। তখন বাজারের গাইডগুলোই তাদের একমাত্র চাহিদা পূরণ করে। আবার যারা ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে পারেন তারা অনলাইন পত্রিকার পড়াশোনা পাতা থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে কিছুটা সংযোজন বিয়োজন করে প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। এভাবে প্রশ্ন পত্র তৈরি করা হলে দেখা যায় একই প্রশ্ন বারবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সৃজনশীল পদ্ধতি না বুঝে যারা পড়াচ্ছেন তাদের পাঠ যথাযথ হওয়া নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সৃজনশীল প্রশ্ন করার আগে শিকক্ষকে সৃজনশীল হতে হবে। মুখস্থ বিদ্যার গ-ি থেকে বেরিয়ে প্রত্যেককে নতুন নতুন চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে। শিক্ষক কতটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, শিক্ষার্থী কতটা চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাল তা অনুসন্ধান করা দরকার। নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীলতা হলে চলবে না। শিক্ষক যখন মাথা খাটিয়ে প্রশ্ন করতে চায় না, তখন শিক্ষার্থীর অবস্থা আর না বললেও চলে। নোট-গাইড বন্ধ না করে সৃজনশীল প্রশ্ন কপি করার প্রবণতাকে ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। গাইড থেকে প্রশ্ন করলেই শিক্ষকের চাকরি চলে যাবে শিক্ষামন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরেই শিক্ষকরা নিজ থেকে প্রশ্ন তৈরি করবেন তা মনে করারও কোনো কারণ নেই। শিক্ষকরা শ্রম, মেধা ও সময় দিয়ে নিজে কেন প্রশ্ন করছেন না তা অনুসন্ধান করে শিক্ষকদের সেই সব সুবিধা প্রদান করলে আশা করা যায় তার এ ঘোষণা ফলপ্রসূ হতে পারে। গাইডনির্ভর সৃজনশীল কিংবা জোরাতালির সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন সময়ের দাবি। তবে শিক্ষার নামে যারা বাণিজ্য করছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিছু দিন আগে কোচিং বন্ধে খুব তোড়জোড় চলছিল। কেউ কেউ বিদ্যালয়ে ভালো পাঠ উপস্থাপন না করে বরং বাসায় বা কোচিং-এ খুব ভালো করে পড়াচ্ছেন এই অভিযোগ থেকে শিক্ষককে মুক্ত থাকতে হবে। টিভিগুলোতে কোচিং বন্ধের কার্যক্রম লাইভ দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু ফলোআপ না করার কারণে কোচিং ব্যববসা আবারো জমজমাট হয়ে উঠছে।
সর্বোপরি, বাজার থেকে প্রশ্ন ক্রয় করার মানসিকতা দূর করে নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করতে হবে। গাইড ও কোচিং নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝেন না, ঢালাওভাবে এমনটা বলাও ঠিক না। যারা মাস্টার ট্রেইনার তারাওতো শিক্ষক। শিক্ষকরা যদি সৃজনশীল পদ্ধতি না বুঝেতেন তাহলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে শিক্ষার জন্য পাঠতেন না। তারপরেও সকল অক্ষমতাকে স্বীকার করেই বলবো মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদন সামনে রেখে শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।