Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিশোর গ্যাং-টিকটক-লাইকি

২০২১ সালের আলোচনায় সর্বনাশের তিন ক্যাটাগরি রাজধানীসহ সারাদেশে পাঁচ শতাধিক গ্যাং সক্রিয়

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

বিদায়ী বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল কিশোর গ্যাং, টিকটক ও লাইকি। করোনাভাইরাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রচলিত মাদকের পাশাপাশি দেশে আসে নতুন নতুন মাদক। মাদককে ঘিরে কিশোর-তরুণরা গড়ে তুলে গ্যাং বা গ্রুপ। তারা লিপ্ত হয় নানা অপকর্মে। পাড়া-মহল্লায় বড় ভাইদের (ক্যাডার) ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠে কিশোর গ্যাং।
খুন, ধর্ষণ, চাঁদা আদায় ও এলাকার আধিপত্যসহ নানা অপরাধে ২০২১ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ছিল কিশোর গ্যাং। অন্যদিকে যে কয়টি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর মধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর সোহেল ও তার সহযোগী খুন, লঞ্চের কেবিনে গৃহবধূ খুন এবং টাঙ্গাইলে ট্রিপল মার্ডার ঘটনা উল্লেযোগ্য।
কিশোর গ্যাংয়ের পাশাপাশি টিকটক-লাইকি নতুন মাত্রা যোগ করে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। টিকটক হচ্ছে ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ। টিকটকের মতো লাইকি নামে আরো একটি অ্যাপ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিনোদন জগতের সেলিব্রেটিরাও এই দুটি অ্যাপে বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার করেন। টিকটক ভিডিও তৈরি করতে অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর ও তরুণীদের মধ্যে অনেক টিকটকাররা উচ্ছৃঙ্খল পোশাকে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও মহানগর মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। সারা দেশে ছড়ানো এইসব গ্যাংয়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার সদস্য জড়িত। এরমধ্যে রাজধানীতে অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং গ্রæপে দেড় থেকে দুই হাজার কিশোর সক্রিয়।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, কিশোরদের রাজনৈতিক এবং প্রভাবশালী চক্র ব্যবহার করছে। এটা বন্ধ করে তাদের আইনের আওতায় আনা গেলে কিশোর গ্যাং বন্ধ হবে। এক গ্রুপ ধরা পড়বে। আরেক গ্রুপ তৈরি হবে। মূল অপরাধীরা থাকে ধরাছোয়ার বাইরে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এলাকাভিত্তিক টিকটকের গ্যাংগুলো বিভিন্ন পার্ক, খোলা জায়গায়, ফুটপাথ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্রিত হয়। তারা ভিডিও কনটেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভটিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়াসহ নানা অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। আবার টিকটক করতে এসে অনেক কিশোরী-তরুণী ধর্ষণের শিকারও হয়েছে। এমনকি টিকটকারদের ফাঁদে পড়ে পাচারের শিকার হচ্ছেন অনেক নারী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজ ব্যবস্থায় দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস, অস্ত্র ও মাদকের বিস্তারসহ নানা কারণে গ্যাং কালচারে জড়াচ্ছে কিশোররা। জুনিয়রদের নিরাপত্তাহীনতা, বিদেশি কালচারের অনুপ্রবেশ, বিশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ, কর্মহীনতা এবং হতাশা বোধ থেকে বখাটে হচ্ছে তারা। খারাপ সহচার্য ও আড্ডা অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা থেকে অনেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। এছাড়া রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার হাতছানি, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি, হীনমন্যতা থেকে ব্যক্তি সত্তা প্রমাণের চেষ্টা, দস্যুপনা, দূরন্তপনা ও চরমপন্থা মনোভাব থেকেও গ্যাংয়ে যোগ দেয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। এজন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আক্তার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর গ্যাং, টিকটক ও লাইকির সাথে সম্পৃক্ত কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের অনেকেই নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। খুন, মারামারি, চাঁদাবাজি ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা। যে বয়সে স্কুল-কলেজে থাকার কথা সে বয়সে অপরাধে জড়িত পড়ে তারা পরিবারসহ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ জন্য পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং খেলাধুলার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের কিশোর গ্যাং, টিকটক ও লাইকি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, দেশে আইনের শাসন না থাকা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা সীমাবদ্ধতা, স্কুল কলেজ বন্ধ, করোনায় মানুষের আয় কমে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয় বা সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি, পারিবারিক অনুশাসনের অভাব, দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা বা মানসম্মত শিক্ষার অভাব, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, খেলাধুলার বব্যস্থা না থাকা, দুষ্ট সহচার্য এবং ব্যক্তিত্ববোধের অভাবসহ নানা কারণে মাদক, কিশোর গ্যাং, টিকটক এবং লাইকি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এসব সমস্যা সমাধানে সমাজের নের্তৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে এগিয়ে আসতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজের আট দিন পর গত ২৩ মে হাফিজুর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের লাশ শনাক্ত করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হাফিজ নিজেকে জড়িয়েছিলেন গ্যাং কালচারে। এই গ্যাংয়ের দলনেতা সাদমান সাকিব ওরফে রুপল। গত ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে সাত বছর বয়সী শিশু সন্তানের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দিন নামের এক যুবককে। এর নেপথ্যেও ছিল গ্যাং কালচার। সুমনের নেতৃত্বে পল্লবীতে গড়ে উঠেছিল একটি গ্যাং। কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের দ্ব›েদ্ব বিদায়ী বছরের প্রথম দিনে রাজধানীর বানানীতে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় কিশোর আরিফ (১৬)। অপহরণের তিনদিন পর গত ২১ মে কক্সবাজারের চকোরিয়া থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় মুমিন (১৬) নামের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনাতেও কিশোর গ্যাং জড়িত বলে সিআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গত ২৭ মে রাতে কুমিল্লায় উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে এক স্কুলছাত্রের হাত-পায়ের শিরা কেটে দেয় গ্যাং সদস্যরা। গত ৩০ মে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপ লাঠিসোঁটা নিয়ে পরস্পরের ওপর হামলা চালায়। গত ১৩ মার্চ আলোচিত তাহমিনা সিমি নামের এক কিশোরী গ্যাং লিডারকে গ্রেফতার করে চট্টামের পতেঙ্গা থানা পুলিশ। গত ২২ নভেম্বর কুমিল্লার পাথুরিয়াপাড়া থ্রিস্টার এন্টারপ্রাইজে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. সোহেল ও তার সহযোগী হরিপদ সাহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় আরো পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। গত ১০ ডিসেম্বর বরিশালে লঞ্চের কেবিন থেকে গৃহবধূ শারমিন আক্তারের লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই গৃহবধূকে তার স্বামীই হত্যা করেছেন। গত ৩০ অক্টোবর টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে একটি বাসায় দুই নারীসহ তিনজনকে হত্যা করা হয়। আহত করা হয় আরো একজনকে। বিষয়টি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাংগুলোয় নিম্নবিত্ত পরিবারের পাশাপাশি আছে মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোররাও। অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কিশোরেরা অপরাধে জড়াচ্ছে। এক নম্বর সমস্যা, তারা যা চাইছে তা-ই পাচ্ছে। চাইলেই পাওয়া যায় বলে সন্তানের আবদারের সীমা একপর্যায়ে মাত্রা ছাড়ায়। তারাও সুযোগ কাজে লাগায়। মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সমস্যাকে প্রকট করছে বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করছে, মারপিটের নির্দেশ দিচ্ছে অনলাইন বার্তায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কিশোর গ্যাং


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ