Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নৌ-পথ সুরক্ষা আইন মানছে না কেউ

লঞ্চে আগুন : সুষ্ঠু তদন্ত, ক্ষতিপূরণ ও দায়ীদের শাস্তি চায় ব্লাস্ট লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এটাই প্রথম

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এর ৫৬ ধারায় বিস্ফোরণ, আগুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। অভিযান-১০ লঞ্চের ঘটনায় তার সুস্পষ্ট ব্যত্যয় ঘটেছে। ঝুঁকি বাড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের নৌ-পথের যাত্রীদের। দেশে গত ৩০ বছরে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ সংঘটিত নৌ-দুর্ঘটনায় ঘটেছে। তবে দেশের লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এটা প্রথম বলে জানা গেছে। দেশে প্রতি সংঘটিত নৌ-দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। অনেকে প্রতিবেদন দিয়েছেন, অনেকেই প্রতিবেদন দেয়নি। তবে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে সব সময় সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু কিছুদিন পরে কিছুই করা হয় না। প্রতি বছর ঝড়ের মৌসুম আসলেই নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলে নৌ-দুর্ঘটনায় যাত্রীদের প্রাণহানি ঘটে। নৌ-পথ সুরক্ষায় যে আইন রয়েছে তা কেউ মানছে না এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

এদিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি অভিযান-১০’ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। গতকাল শুক্রবার ব্লাস্টের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এ পর্যন্ত দেশে নৌপথে লঞ্চডুবি, অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন কারণে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নৌযান মালিক, পরিচালনাকারী ও তদারকি কর্তৃপক্ষ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ লঙ্ঘন করে আসছে। ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ এর ৫৬ ধারায় বিস্ফোরণ, আগুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, অভিযান-১০ লঞ্চের ঘটনায় তার সুস্পষ্ট ব্যত্যয় ঘটেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্লাস্ট এ হতাহতের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ, দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছে। এ ছাড়া, ধারা ৩৩ এর অধীনে সার্ভে সনদ ছাড়া নৌযাত্রা নিষিদ্ধ করা এবং ধারা ৫৮ (ক) অনুযায়ী বীমা বা নৌ-দুর্ঘটনা ট্রাস্ট ফান্ড ছাড়া নৌযাত্রা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তদারকি কর্তৃপক্ষ যেন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সে ব্যাপারে জোর দাবি জাননো হয়।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স) অনুযায়ী গঠিত নৌ আদালতে এ রায় হয়। সে সময় আইনে এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও সংশোধনীতে তা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর করা হয়। ক্ষতিপূরণ ১ লাখ টাকার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা করা হয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। নৌ-দুর্ঘটনায় বড় ধরনের প্রাণহানি হলেও শাস্তির এমন বিধান নামমাত্র বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে অধ্যাদেশের কয়েকটি ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশের ৫৫ ধারা বলছে, ঝড়ের সঙ্কেত থাকাবস্থায় নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধারার শর্ত ভঙ্গ হলে অভ্যন্তরীণ নৌযান মাস্টারের তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। অধ্যাদেশের ৭০ ধারায় অসদাচরণ ইত্যাদির কারণে জাহাজ বিপদাপন্ন করার শাস্তি বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। ধারাটির (২) অনুসারে যেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ নৌযান দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি বা কোনো ব্যক্তি আহত বা নৌযানের বা অন্য কোনো নৌযানের সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে এবং এ ধরনের কোনো নৌযানের ত্রুটি বা অভ্যন্তরীণ নৌযানের মালিক, মাস্টার বা কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্যের অযোগ্যতা বা অসদাচরণ বা কোনো আইন ভঙ্গের দরুন ঘটে থাকে, তবে ওই নৌযানের মালিক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্য বা তাদের প্রত্যেকেই পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারেন।
অভিযোগ রয়েছে নিয়মনীতি ছাড়াই বিভিন্ন রুটের নৌ-যানগুলো যাত্রী নিয়ে বেপরোয়াভাবে চলাচল করে। ঢাকা-বরিশাল রুটের দোতলা, তিন তলা লঞ্চ থেকে শুরু করে এমএল টাইপের ছোট লঞ্চ এমনকি ট্রলারগুলো (ইঞ্জিন চালিত নৌ-যান) নিয়মনীতি না মেনে ইচ্ছে মাফিক যাত্রী পরিবহন করে আসছে। এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে নৌ-যান। বেসরকারি লঞ্চগুলোই সিংহভাগ যাত্রী পরিবহন করে। প্রায়বছরই দক্ষিণাঞ্চলে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। দুর্ঘটনার পরপরই বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় নানান তৎপরতা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে রহস্যজনক কারণে সবকিছু থেমে যায়। লঞ্চমালিকরা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী নৌযান পরিচালনা করে থাকেন।
নৌ-আদালতে নৌ-দুর্ঘটনা দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলাগুলোতে অভিযুক্ত প্রভাবশালী নৌযান মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের যথাযথ সাজা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সেজন্য দিনের পর দিন আসামিদের মামলায় উপস্থিত না হওয়া এবং তাদের গ্রেফতারে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতাকে দায়ী করছে সংশ্লিষ্টরা। এমনকি বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত নৌ-দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও তা জমা দেয়ার পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনা করেও অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পার পেয়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। মূলত দেশের অধিকাংশ নৌ-দুর্ঘটনাই তদন্ত এবং প্রতিবেদন দাখিলের মধ্যেসীমাবদ্ধ থাকে। ওসব প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় না বললেই চলে। কখনো কখনো দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা কিংবা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দিয়েই দায় এড়ানো হয়। পরে ওই লঘু শাস্তিমূলক পদক্ষেপও উঠিয়ে নেয়া হয়। আর তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলোরও বাস্তবায়ন হয় না।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এটাই প্রথম। লঞ্চ এমভি অভিযান-১০ একেবারে নতুন। এর মালিকের নাম হাম জালাল। আগামী ২২ সাল পর্যন্ত ফিননেছ আছে। লঞ্চটির ধারণ ক্ষমতা ৭৬০। আর গতকাল যাত্রী ছিল ৩১০ জন। আমাদের ছাড়পত্র (ভয়েস ডিগলারেশন) দেওয়া ছিল। আর অগ্নিকাণ্ডের বিষয় কিছু বলতে পারব না বলে জানান তিনি।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত ৩০ বছরে দেশে সংঘটিত নৌ-দুর্ঘটনায় সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ তদন্ত কমিটি হয়েছে। অনেকে রিপোর্ট দিয়েছেন, অনেকেই দেয়নি। তবে জমা দেয়া রিপোর্টে সব সময় সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। সেগুলো যদি সঠিক সময়ে ঠিকমতো বাস্তবায়ন হতো, তাহলে নৌ-দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। এদিকে বাংলাদেশের ভয়াবহ ৫টি লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ ঢাকার পোস্তগোলা সংলগ্ন এলাকায় মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চডুবির ঘটনার পর বাংলাদেশে নৌপথে নিরাপত্তা দুর্ঘটনার বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে। সেই লঞ্চ দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৩ জন নিহত হন। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ১৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
সংস্থাটির একজন যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ মুজিবুল হক মুনির বলেছেন, লঞ্চডুবির বড় ঘটনার অনেকগুলোই ঘটেছে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে। কিন্তু লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা এটাই প্রথম। প্রাণহানির হিসেবে দেশের নৌপথে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার কয়েকটি সম্পর্কে জানান।



 

Show all comments
  • বেলায়েত হোসেন ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:১১ এএম says : 0
    ঘুষের বিনিময়ে নৌযানের ফিটনেস সনদ প্রদানের সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে রাষ্ট্র অসহায়। ফলে থামছে না দুর্ঘটনা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ