মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
আর কে চৌধুরী
খুলনার দাকোপ উপজেলার একটি গ্রাম তিলডাঙ্গা। একসময় তিল উৎপাদনে আধিক্যের কারণেই এ নাম রাখা হয় গ্রামটির। নদীবাহিত হালকা পলিজ বালির কারণে এখানকার ভূমি তিলের জন্য বিখ্যাত ছিল। অথচ মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসলটির আবাদ বন্ধ হয়েছে পাঁচ-সাত বছর আগেই। এখন ধান আবাদও বন্ধের পথে। শুধু তিলডাঙ্গা নয়; লবণাক্ততার ভয়াবহ গ্রাসে সত্যপীর, চটবালিয়া, আঁধারমানিক ও নলডাঙ্গাসহ উপকূলীয় এ অঞ্চলের আরো অনেক গ্রাম। এখন আর কৃষিপণ্য উৎপাদন আগের মতো হচ্ছে না এসব গ্রামে। কয়েক বছর আগেও কিছু ধান আবাদ করা গেলেও এখন তাও করা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের আশঙ্কা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলে দিন দিন লবণাক্ততার প্রভাব বাড়ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী ৩৫ বছরে এই অঞ্চলের আড়াই কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হবে।
লবণ পানির ঊর্ধ্বমুখিতা বা প্রভাবের কারণে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ যাচ্ছে কোথায়? এমন প্রশ্নের অংশবিশেষের জবাব রয়েছেÑ শহর-বন্দরের বস্তিতে। বাস্তুভিটা ছেড়ে এদের বৃহৎ অংশই কাজের খোঁজে শহর-বন্দরে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানে তারা থাকছে বস্তিতে বা সরকারি পরিত্যক্ত জায়গায় ঝুপড়ি তুলে। এদের পুরুষরা রিকশা চালায় বা জন-মজুরির কাজ করে। মেয়েরা ঘর সামলানোর পাশাপাশি বাসাবাড়ি বা মেসে কাজ করে। শহর-বন্দরে আসা বাড়তি এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বাইরেই থেকে যায়। দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদে এদের শিশুরা থাকে শিক্ষাবঞ্চিত। নারী-শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা, পুষ্টি সমস্যা থাকে মূল ধারার বাইরে। নগরে-বন্দরে এসে ঠাঁই নিলেও স্বপ্নহীন, সাধ্যহীন এক জনগোষ্ঠীই বেড়ে উঠছে এভাবে। শহর-বন্দরে এদের ঠাঁই দিতে বেড়ে উঠছে বস্তি ও ঝুপড়ি।
জাতিসংঘের আশঙ্কা সত্য হলে আগামী ৩৫ বছরে যে আড়াই কোটি মানুষ শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হবে, তারাও ঠাঁই নেবে এখানে। তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে সহজেই তা অনুমেয়। তাই এ ব্যাপারে করণীয় এখনই ঠিক করা দরকার।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার ১৪৮টি উপজেলার মধ্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে ১০টি উপজেলার নদীর পানি। এগুলো হলোÑ সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মংলা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া। এসব উপজেলায় এখন ১০ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা বিরাজ করছে। আগামীতে তা ১৫-২৫ মাত্রায় উন্নীত হবে।
জানা গেছে, উপকূলীয় এসব অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা বেশি থাকায় মাইক্রোবিয়াল অণুজীবের কার্যক্রম এবং মাটির জৈবপদার্থ, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কপার আর জিংকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের জন্য কিছুটা লবণাক্ততা হ্রাস পায় বলেই বেশ কিছু এলাকায় ধান বিশেষ করে আমন আবাদ হয়। তবে মৌসুমের শেষের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফসলে দানার সংখ্যা কমে যায়। এতে ফলন ঠিকমতো পান না কৃষক। আর বৃষ্টিপাত কমার কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। এ ছাড়া সিডর ও আইলার মতো উচ্চমাত্রার জলোচ্ছ্বাসের কারণে এ অঞ্চলের অনেক এলাকায় এখন শস্য আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।
এর মধ্যে আইলা উপদ্রুত দাকোপ উপজেলার দুটি ইউনিয়নের প্রায় ৭ হাজার ২০০ হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমির মধ্যে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টরে আমন চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ উপজেলার কামারখোল ও সুতারখালী ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম আমন চাষাবাদে সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আইলাদুর্গত খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নে দুই বছর ধরে তিন হাজার বিঘা জমিতে ধান চাষ করা যাচ্ছে না। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থান এবং উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে খুলনা অঞ্চলে একসময় উদ্ভিদের সমারোহ থাকলেও কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে। অর্ধ শতকের ব্যবধানে দেশের দক্ষিণাঞ্চল খাদ্য উদ্বৃত্ত থেকে এখন ঘাটতির জেলায় পরিণত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষ কোথায় আশ্রয় নিল তার চেয়ে বড় কথাÑ কেন মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, কীভাবে তা রোধ করা যায় তার উপায় এখন খুঁজে বের করা।
প্রাকৃতিক সম্পদগুলো টেকসইভাবে ব্যবস্থাপনা করা ও সুরক্ষিত রাখা আমাদের দায়িত্ব। এই বিষয়ের সম্মুখীন হওয়া কারও ইচ্ছার ওপর নিহিত নয়। এটা অপরিহার্য। আমাদের জন্য আমাদের সন্তানদের প্রজন্মের জন্য, আমরা যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তার জন্য।
ষ লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।