Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলছে

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হচ্ছে আজ কম টাকায় কর্মী যাবে কোনো সিন্ডিকেট থাকছে না : প্রবাসীমন্ত্রী

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের দ্বার খুলছে আজ। দেশটিতে কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেটের দৌরাত্মসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে সেটি বন্ধ করে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান শেষে গত রাতেই প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি সংক্রন্ত উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক আজ রোববার কুয়ালালামপুরে স্বাক্ষরিত হবার কথা। বৈশ্বিক মহামারি করোনার পর দেশটির বিভিন্ন খাতে অভিবাসী কর্মীর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কর্মী সঙ্কটের দরুন দেশটির শিল্প কারখানাগুলোতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশটির কেবিনেট বাধ্য হয়েই অতিসম্প্রতি বিভিন্ন খাতে অভিবাসী কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে।

তবে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন যে তার দেশের মন্ত্রিসভা তাকে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুমতি দিয়েছে। ‘এমওইউ’ স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ শুরু হবে। দেশটির কেবিনেট এবার সব খাতেই বিদেশি কর্মী নিয়োগে সম্মত হয়েছে যার মধ্যে আছে বৃক্ষরোপণ, কৃষি, নির্মাণ, সেবা, খনি ও গৃহকর্মসহ আরো কয়েকটি খাত’। এছাড়া নিয়োগকর্তার ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে মন্ত্রিসভা আগামী পহেলা জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন স্তরে লেভি বাস্তবায়ন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, গত ১০ ডিসেম্বর রাতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান আনুষ্ঠানিক এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদকে জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য দেশটিতে আমন্ত্রণ জানান। নানা নাটকীয়তায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, কোভিড-১৯, অর্থনৈতিক ধস, অবশেষে অভিবাসী কর্মী সঙ্কট মোকাবিলা সামাল দিতেই এই একবিংশ শতাব্দীর কলিং ভিসা চালুর চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে।

মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান এবং প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ স্ব স্ব দেশের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করবেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশটির সকল খাতেই বাংলাদেশি কর্মীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিবাসন ব্যয় কত হবে তা’জানা যাবে চুক্তি স্বাক্ষরের পর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের অত্যন্ত চমৎকার সর্ম্পক বিরাজ করছে। দেশটিতে বর্তমানে ছয় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। বহু ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টার পর অবশেষে দীর্ঘ তিন বছর পর মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে জনশক্তি রফতানি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি তরুণ উদ্যোক্তা এম টিপু সুলতান গতকাল শনিবার এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে কোনো সিন্ডিকেট মেনে নেয়া হবে না। তিনি আরো বলেন, সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি যদি কর্মী নিয়োগের সুযোগ পায় তবে অভিবাসন ব্যয় মাত্র এক লাখ টাকায় নেমে আসবে।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে দশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় একজন কর্মীর কাছ থেকে তিন লাখ টাকা থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এতে সিন্ডিকেট চক্র রাতারাতি কালো টাকার মালিক বনে গেছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের আশ্বাসে অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলোও লাখ লাখ কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্নকারী অধিকাংশ কর্মীই দেশটিতে যেতে পারেনি।

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে কোনো সিন্ডিকেটের সুযোগ থাকবে না। গতবারের অভিবাসন ব্যয়ের অনেক কম টাকায়ই কর্মীরা মালয়েশিয়ায় যাবার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, আমাদের গরিব মানুষগুলো কিভাবে বাঁচবে সে দিকে নজর রেখেই অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অনেক কম টাকার বিনিময়েই কর্মীরা দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পাবে ইনশাআল্লাহ।

তবে এবারের কলিং-এ কিছু পরিবর্তন আনা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জি টু জি প্লাস পদ্ধতি উল্লেখ থাকছে না, যুক্ত হচ্ছে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সি, কর্মীদের বাধ্যতামূলক বিমা থাকছে। এছাড়া কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা ও খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান, চুক্তি মেয়াদে কর্মীদের দায়িত্ব নিতে হবে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিকেও। কর্মীদের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮-৪৫ বছর পর্যন্ত। তবে কর্মীদের মালয়েশিয়া যেতে প্রকৃত অভিবাসন ব্যয় বা খরচ কত হবে, তা জানা যাবে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর।
মালয়েশিয়া কমিউনিটির নেতা রাশেদ বাদল সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় মালয়েশিয়া সরকারকে মোবারকবাদ জানিয়ে বলেন, গত দু’বছরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের মানুষ। আশাকরি সরকার অভিবাস খরচের বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। তিনি বলেন, সোর্সকান্ট্রিগুলো থেকে একজন কর্মী মালয়েশিয়ায় আসতে মাত্র ষাট হাজার টাকা ব্যয় হয়। সে দিকে খেয়াল রেখেই অভিবাসন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। তিনি দেশটিতে বর্তমানে বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগের ব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানান।

মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগের বিষয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছিল ১৯৯২ সালে। কিন্তু কয়েক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৬ সালে আবার কর্মী প্রেরণ শুরু করে বাংলাদেশ কিন্তু বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি ধরা পড়ার পর ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর আবার দু’দেশের মধ্যে আলোচনার পর ২০১২ সালে নতুন চুক্তি হয় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে।

মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী সাংবাদিক এম এ আবির বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে দশ সিন্ডিকেট চক্রের অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দু’পক্ষের মধ্যে ক‚টনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া সরকার কর্মী নিয়োগে রাজি হওয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য অচলাবস্থার অবসান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো।

এদিকে, বিদেশি কর্মী প্রবেশের মধ্যস্থতায় মালয়েশিয়ার ১ হাজার ৪০টি নিবন্ধিত সংস্থা করোনার মহামারির পরে অর্থনীতির অনেক খাত আবার চালু হওয়ার পরে দেশের সকল সেক্টরে শ্রমিকের গুরুতর ঘাটতি মেটাতে বিদেশি কর্মী নিয়োগে সরকারের উদ্যোগকে সময়োপযোগী বলে মনে করা হচ্ছে। ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব প্রাইভেট সার্ভিস অ্যাজেন্সিস মালয়েশিয়ার (পিএপিএসএমএ) মহাসচিব ড. সুকুমারন নায়ার গত ১৫ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন, এ প্রচেষ্টায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এবং দেশে বিদেশি কর্মীদের প্রবেশ ত্বরান্বিত করতে ১ হাজার ৪০টি বিদ্যমান নিবন্ধিত বিদেশি কর্মী নিয়োগকারী সংস্থাকে জড়িত করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সেসব খারাপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে প্রত্যাশা করছে। অন্যথায় মালয়েশিয়ায় ফোর্স লেবার ও মানব পাচারের যে সমস্যা মোকাবিলা করছে তা থেকে বের হতে পারবে না।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজর উন্মুক্ত হতে যাওয়ায় বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান গতকাল শনিবার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীসহ মালয়েশিয়া সফররত বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রবাসী মন্ত্রী আমাদের নিশ্চিত করেছেন যে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হলে কোনো সিন্ডিকেট হবে না। সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিই দেশটিতে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে কর্মী পাঠাতে পারবে। আজকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে উভয় দেশের মাঝে জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে তারই প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করছি।

বায়রার সাবেক মহাসচিব আরো বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিবাসন ব্যয় যাতে কোনো ক্রমেই সরকার নির্ধারিত টাকার অধিক না হয় সে দিকে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। বায়রার সাবেক নেতা নোমান বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সব সময় চালু থাকে না। এবার দেশটির শ্রমবাজার চালু হলে অন্যান্য সোর্সকান্ট্রিগুলোর ন্যায় সব সময় যাতে বাজারটি চলমান থাকে সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। করোনা মহামারির পর দেশটির কেবিনেট সকল খাতে অভিবাসী কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়ায় তিনি মালয়েশিয়া সরকারকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মালয়েশিয়া

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ