বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নাম আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যে দল একটি দেশের জন্ম দিয়েছে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এই দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতার মাত্র ৪৬ বছরে বাংলাদেশ ৬ শতাংশের প্রবৃদ্ধির বৃত্ত ভেঙে ৭ শতাংশে উন্নীত করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের কাছে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। যদিও দলটির নাম শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল। প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। নতুন নাম হয়-‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৫০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ওই বছরের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দুবছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় এই দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থার স্থান তৈরি করে।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসনের নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসাবে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। পরবর্তীতে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে। আর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত দিয়ে যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে তেমনি তার কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে এসেছে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। সাফল্য স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা অর্জন করেছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ
১. এজেন্ট অফ চেঞ্জ পুরস্কার, ২০১৬ : গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এজেন্ট অফ চেঞ্জ’ পুরস্কারে ভূষিত করে গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম। নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য ও সাহসী ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সকল নারীকে এই অর্জন উৎসর্গ করেন।
২. প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, ২০১৬ : নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউএন ওম্যান। গত ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এক উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
৩. চ্যাম্পিয়নস অফ দ্য আর্থ : ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অফ দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ ইত্যাদিসহ তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করে ‘পলিসি লিডারশিপ’ শাখায় তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
৪. সাউথ-সাউথ ভিশনারি পুরস্কার, ২০১৪ : ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ ভিশনারি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু, সর্বসাধারণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে বিশ্বের দরবারে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপনের জন্য তাঁকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এই পুরস্কার গ্রহণ করেন।
৫. শান্তি বৃক্ষ, ২০১৪ : নারী শিক্ষায় অনবদ্য অবদানের জন্য ২০১৪ সালে ইউনেস্কো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘শান্তি বৃক্ষ’ স্মারক তুলে দেয়। ৮ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক স্মারকটি হস্তান্তর করার আগে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী শিক্ষায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন জোরালো বক্তা। রাজনৈতিক ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
৬. গ ক এধহফযর পুরস্কার : সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ব, অহিংসা, সামাজিক বোঝাপড়া এবং তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের উত্থানের স্বীকৃতিস্বরূপ অসলোভিত্তিক গ ক এধহফযর ঋড়ঁহফধঃরড়হ, ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনাকে গ ক এধহফযর পুরস্কারে ভূষিত করে।
৭. ঈঊজঊঝ মেডেল : ক্ষুধার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা নিরলস সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ খাদ্য এবং কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) ২ আগস্ট, ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ঈঊজঊঝ মেডেল দিয়ে ভূষিত করে।
৮. চবধৎষ ঝ. ইঁপশ পুরস্কার : ২০০০ সালের ৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের জধহফড়ষঢ়য গধপড়হ ডড়সবহং ঈড়ষষবমব শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য, সাহস এবং অর্জনের জন্য চবধৎষ ঝ. ইঁপশ পুরস্কার প্রদান করে।
৯. পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫ বছরব্যাপী পাহাড়ী-বাঙ্গালী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই পুরস্কার প্রদান করে।
১০. ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার : ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ এবং উন্নয়নের জন্য তার নিরন্তর সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন।
১১. জাতিসংঘ পুরস্কার-২০১০ : শিশুমৃত্যুর হার ৫০% কমিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০ সালে এই স্বীকৃতি প্রদান করে। জাতির পক্ষ থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিশেষে বলছি, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, বাঙালি জাতির অর্জনের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১ সালে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনসহ গণতন্ত্র অর্জনের সব আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-কূটনৈতিকসহ অসংখ্য সাফল্যই এসেছে এই দলের মাধ্যমে। আগামী ২২-২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল। আসন্ন কাউন্সিল অত্যন্ত সফল সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
য় লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সাবেক মন্ত্রী, বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।