বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
রাজু আহমেদ
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ দেশবাসীকে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। জনগণের প্রতি তাদের সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হতে সময় লেগেছে ৭ বছরের কিছুটা বেশি। এরমধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা এখনো দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে প্রতীয়মান নয়। কেননা ৩০ বছরে পরে চীনের কোন প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফরে শি জিনপিং বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে তার কোন সৌজন্য সাক্ষাৎ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি বরং নবম সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে চীনা প্রেসিডেন্টের দীর্ঘসময় আলোচনা হয়েছে। অতীতের কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচনী দল পরপর ধারাবাহিকভাবে দু’বার নির্বাচিত হয়ে প্রথম মেয়াদের ৫ বছর এবং দ্বিতীয় মেয়াদের দু’বছর অতিক্রম করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যদি তারা প্রথম মেয়াদের পর দ্বিতীয়বার নির্বাচিত না হতো তবে ১০ টাকায় জনগণকে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি অধরাই থেকে যেতো! সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় বিএনপি সে নির্বাচন বয়কট করে। বাংলাদেশের ৩০০ নির্বাচনী আসনের মধ্যে ১৫৩টির প্রার্থীরা প্রতিযোগীর অভাবে মনোনীত হয়ে সংসদ সদস্য, যাদের কেউ কেউ আবার মন্ত্রিত্বের মর্যাদাও লাভ করেন। বাকিগুলোর নির্বাচন আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেয় মাত্র। কেননা মেজরিটি আসন বিনাভোটেই আওয়ামী লীগ লাভ করার মাধ্যমে তারা সরকার গঠনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করে।
বর্তমান সরকারের আমলে দেশের কৃষি খাতে নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের মানুষের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে যে দেশটি প্রতিবছর লাখ লাখ টন চাল আমদানি করেছে সেই দেশটি বর্তমান সরকারের আমলে চাল রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। যদিও এখনো দেশের মানুষের খাদ্যঘাটতি লাঘবের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানি করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। তারপরেও রপ্তানি করার মতো সৎসাহসের প্রশংসা অবশ্যই স্বীকার্য। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মাত্র ৭ কোটি মানুষের জন্য যে কৃষিভূমি ছিলো তা থেকে বর্তমান সময়ে হাজার হাজার হেক্টর কমেছে বটে কিন্তু এদেশের ১৬ কোটি মানুষের অবস্থার উন্নতি ও আর্থিক স্বাবলম্বী অর্জন হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারেই। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার ছাড়িয়েছে। দেশ এখন মধ্যম আয়ের গ-িতে উন্নীত হয়েছে। তারপরেও দেশ যেটুকু পিছিয়ে তা শুধু সীমাহীন দুর্নীতি আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফল। প্রতিবছর এদেশের যতটাকা জাতীয় বাজেট হয় তার প্রায় সমপরিমাণ দুর্নীতি হয়। বিদেশে পাচার কিংবা অভ্যন্তরীণ ঘুষ লেনদেনের কারণে দেশে অগ্রগতির চাকা ক্রমশ ধীরে চলছে। চীনা প্রেসিডেন্ট তার সফরে বাংলাদেশের সাথে চীনের ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সম্মতি দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জন্য এ টাকা বরাদ্দ হবে। মনে রাখা উচিত, চীন এ অর্থ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে; দান নয়। নির্দিষ্ট মেয়াদে এ অর্থ চীনকে পাই পাই করে ফেরত দিতে হবে। এ অর্থ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কেউ কেউ উপকৃত হবে না তা বলার সাধ্য এদেশের পরিবেশ-পরিম-লে নাই। তাছাড়া ঋণ সবসময় রাষ্ট্রের জন্য বোঝা। রাষ্ট্রের বোঝা অর্থাৎ জনগণের বোঝা। দুর্নীতিমুক্তভাবে চীনের ঋণ যদি সঠিকভাবে কাজে লাগনো যেতো তবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সম্মৃদ্ধ হতো। কিন্তু প্রাপ্ত অর্থকে দুর্নীতিমুক্তভাবে সুষ্ঠু ব্যবহারে গ্যারান্টি কি রাষ্ট্র দিতে পারবে? চীন থেকে পাওয়া ঋণের একাংশ যে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কি?
গরিবের উপকারে জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্রকে ১০ টাকা দরে প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল দেয়ার এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে। গত রমজান থেকে চালের বাজার বিশেষ করে মোটা চালের বাজার যখন ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী তখন সরকারের এ সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্তস্বরূপ। সরকারকে আলাদা করে জনবান্ধব বলার প্রয়োজন পড়ে না, কেননা যারা ক্ষমতায় থাকে তাদেরকে শপথের মাধ্যমেই জনগণের কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ভালো উদ্যোগ এই ১০ টাকা দরে হতদরিদ্রকে চাল দেয়ার প্রোগ্রামে সরকারের প্রশংসার বদলে এখন দুর্নাম কুড়াচ্ছে বেশি। অবশ্য এজন্য সরকারের সিদ্ধান্তকে দায়ী করা চলে না বরং সমস্যা সিস্টেমের। যে দুর্নীতিমূলক সিস্টেমের কাছে সরকারও কিছুটা নতজানু। গত ৭ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামে যখন প্রধানমন্ত্রী গরিবের উপকারের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন তখন তিনি বলেছিলেন, যদি কেউ ১০ টাকার চাল প্রদানের ব্যাপারে দুর্নীতিতে জড়ায় তবে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী জানেন কিনা জানি না, তবে সেই ১০ টাকার চাল নিয়ে চালবাজরা যে একের পর এক চালেসমাতি কারবার করে যাচ্ছে তা সরকারের শুভ উদ্যোগের প্রশংসার বিপরীতে এখন সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্টের প্রধান ইস্যু বানিয়েছে। দেশের প্রত্যেকটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১০ টাকার চাল বিতরণ নিয়ে নানা দুর্নীতির খবর আসছে। এ সংক্রান্ত যতগুলো সংবাদ এসেছে তার মধ্যে বিশেষ অভিযোগগুলোর প্রতি একটু আলোকপাত করা দরকার এবং সরকারে কঠোর হস্তে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের লাগাম টানা দরকার। এতে সরকারের ভাবমর্যাদা যেমন রক্ষা পাবে তেমনি উপকৃত হবে দেশের প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
গরিবের উপকারের জন্য ১০ টাকায় যে চাল দেয়া হচ্ছে তাতে এখন পর্যন্ত ১০ ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। অভিযোগগুলো হচ্ছে গরিবের বদলে ধনীরা ১০ টাকা দরে চাল পাচ্ছে, চাল ওজনে কম দেয়া হচ্ছে, ৩০ কেজি চাল দেয়ার টিপসই নিয়ে ১০-২০ কেজি দেয়া হচ্ছে, তালিকা অনুমোদনের আগেই অনেক জায়গায় চাল বিতরণ শুরু হয়েছে, অনেক এলাকায় হতদরিদ্রের নাম তালিকায় আসেনি, চাল বিতরণে অনভিজ্ঞ দলীয় নেতাকর্মীদের ডিলার নিয়োগ, তালিকায় সরকারি চাকরিজীবী, স্কুল শিক্ষক ও হউপি সদস্যদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা, খাদ্য বিভাগ থেকে নি¤œমানের চাল বিতরণ, খোলা বাজারে এ কার্যক্রমের চাল বিক্রি হওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে চাল বিক্রি না হওয়া কিংবা প্রকাশ্যে ১০ টাকার চাল ২৭ টাকায় বিক্রি হওয়ার অভিযোগ তো আছেই (সূত্র : প্রথমআলো, ১১ অক্টোবর ’১৬)। ১০ টাকার চাল নিয়ে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নামধারী কিছু সুযোগবাদী মৌসুমি নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ তথা সরকারের সুনামের যে সর্বনাশ করছে সে ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা প্রকাশ হওয়া দরকার। তাছাড়া অপরাধীর তো কোন ব্যানার থাকা উচিত নয়। অপরাধীর বিচার হবে শুধু তার অপরাধ বিবেচনায়। ৩০ হাজার টাকা বেতনভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ৩০ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত ইউপি চেয়্যারম্যান, ৫ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত ইউপি সদস্য, মৃত ব্যক্তির নামে যদি ১০ টাকার চাল বরাদ্দ হয় তবে প্রকৃত হতদরিদ্রদের দারিদ্র্য নিশ্চয়ই নীরবে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
প্রকৃত গরিবদের সচ্ছলতা আনয়নের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকায় চাল বিক্রির যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার টিলেঢালা বাস্তবায়নেই এরমধ্যে একফালি দুর্নীতির চিত্র উঁকি দেয়। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সরকারি প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতির কারণে এ কর্মসূচি গরিবের পরিবর্তে ধনীদের এবং যাদের এ চাল প্রাপ্য নয় তাদের কাছেই যাচ্ছে। তাছাড়া যে পরিমাণ চাল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী চাল বিক্রির জন্য ছাড়াও হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত ছিলো, প্রতি মাসে দেড় লাখ টন চাল বিক্রি হবে কিন্তু গত সেপ্টেম্বর ও ৭ অক্টোবর পর্যন্ত চাল বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫১১ টন। তালিক তৈরিতে অনিয়ম ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগে দেশের কয়েকটি এলাকায় চাল বিক্রি শুরুই হয়নি। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া ১০ টাকার চাল ডিলার থেকে কালো বাজারে চালান হয়ে হাটে হাটে উচ্চ দরে বিক্রি হওয়ার অভিযোগ তো থাকছেই।
সরকার জনস্বার্থে যখন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন সেটা সরকারের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করার জন্যই। কিন্তু এতে যখন হিতে বিপরীত ঘটে তখন সরকারেরই ক্ষতি হয়। কাজেই ১০ টাকা চাল বিক্রিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার যদি দুর্নীতির লাগাম টানতে বদ্ধপরিকর ও কঠোর হয় তবে সেটা সরকারেরই মঙ্গল। বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা রয়েছে তাতে বিদেশি ঋণের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে না যদি শুধু দুর্নীতিবাজদের দমন করা যায়। ১০ টাকায় চাল কিনে যদি প্রকৃত গরিবরা উপকৃত হয় তবে দেশে স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসবে এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতিও রক্ষা পাবে। ১০ টাকা মূল্যের চাল, ওএমএসের চাল, ভিজিডি কার্ডের চাল, জেলেদের সাহায্যের চাল, বয়স্কদের দেয়া ভাতাসহ গরিবদের উন্নয়নের জন্য প্রদত্ত সকল আর্থিক অনুদান যদি প্রকৃত প্রাপ্যদের কাছে দুর্নীতিমুক্তভাবে পৌঁছে দেয়া যায় তবে বাংলাদেশের সম্ভাবনাগুলো দ্রুত বিকশিত হবে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিকে আরও বৃহৎ পরিসরের করতে হবে। এদেশের উন্নতির জন্য প্রধান প্রতিবন্ধক দুর্নীতি ও জনগণের চেয়ে নেতা বেশি নীতি। সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত দুর্নীতির কালো হাত ভেঙে দেওয়া। তবে ঘরের মধ্যের ইঁদুরেই যদি ক্ষতি করে তবে সেখানে আর কিছু করার থাকে না।
য় লেখক : কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।