Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেখার কেউ নেই

নদী ভাঙে, কপাল পুড়ে সখিনার শেষ পর্ব

প্রকাশের সময় : ১৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : একসময় চীনের দু:খ ছিল হোয়াংহু নদী। আর নদী ভাঙনের শিকার চৌহালিবাসীর দু:খ এখন যমুনা। গত কয়েক বছরের ভাঙনে চৌহালি উপজেলা এখন টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর ও মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার সাথে প্রায় মিশে গেছে। এমনটি হওয়ার মূল কারণ, চৌহালির ৬০ শতাংশই এখন নদী গর্ভে বিলীন। নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে লক্ষাধিক মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। কেউবা পরিবার নিয়ে শহরের বস্তিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে।
সিরাজগঞ্জের সবকটি উপজেলা যমুনার ওপারে হলেও একমাত্র উপজেলা চৌহালির অবস্থান এপারে। বেশ কয়েকবার আলোচনাতেও এসেছিল-এই উপজেলাকে টাঙ্গাইলের মধ্যে দিয়ে দেয়ার। কিন্তু সিরাজগঞ্জবাসী সায় দেয়নি। চৌহালিবাসীকে এ জন্য জেলার সব কার্যক্রম চালাতে হয় যমুনা নদী পারি দিয়ে সিরাজগঞ্জে যেয়ে। নদী ভাঙনকবলিত এই এলাকার অধিবাসীর অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন একটা ভাল নয়। কৃষিই এখানকার মানুষের অর্থের মূল উৎস। যদিও ক্ষুদ্র একটি অংশ জীবিকা নির্বাহ করে যমুনা থেকে মাছ ধরে।
ভাঙনের তীব্রতা বেশি হওয়ায় চৌহালি উপজেলা সদর রক্ষার্থে ১৯৯৮ সাল থেকেই নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত কয়েকশ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে চৌহালি উপজেলা রক্ষায়। দফায় দফায় জিও ব্যাগ ডাম্পিং, ব্লক ডাম্পিং, পিসিং সবই হয়েছে। কিন্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব কাজের ভিত ছিল একেবারেই দুর্বল। ফলে নির্মাণাধীন কাঠামো টিকসই হয়নি। রক্ষা পায়নি চৌহালি উপজেলা ভবন, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাট-বাজার, ব্রিজ, কালভার্ট, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, থানা কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভবন, আবাদি জমি, বসত বাড়ি।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি হয়নি। বরং পদোন্নতি হয়েছে। আর স্থানীয়দের দাবির মুখে চৌহালিকে রক্ষায় নেয়া হয়েছে নতুন করে প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় গত দু’বছর ধরে ৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার এলাকা নদী তীর সংরক্ষণের কাজ চলছে। এডিবির অর্থায়নেই চলছে এই প্রকল্পের কার্যক্রম। যদিও এই প্রকল্পের সাড়ে ৩ কিলোমিটার ভাটিতে যে ভয়াবহ ভাঙন চলছে তা ঠেকাতে নেই কোন উদ্যোগ। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা উঁকিও দেন না। কালেভদ্রে কোন কর্মকর্তা এই এলাকার ভাঙন দেখতে আসলেও তা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগই নেয়নি।
চরসলিমাবাদের ভয়াবহ ভাঙনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘ফ্লাড এন্ড রিভার ব্যাঙ্ক ইরোশন রিস্ক মেনেজম্যান্ট প্রোগ্রাম-ফেস ১’ এর প্রকল্প পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, চৌহালি সদরের ভাটিতে ভাঙন দেখা দিয়েছে কীনা তা তার জানা নেই। তবে ভাঙন থাকলে সেখানে সমীক্ষা চালানো যেতে পারে। তিনি বলেন, এই ভাঙন কতটুকু তীব্র এবং সেখানকার মানুষ কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন তা সরেজমিন দেখতে আমি (আমিনুল ইসলাম) প্রয়োজনে আগামী সপ্তাহে চরসলিমাবাদ যাব। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্য যেখানে এরকম, সেখানে নদী ভাঙনকবলিত এই এলাকার মানুষ নিয়তির হাতেই তাদের ভাগ্য সঁপে দিয়েছেন।
সরজমিনে যেয়ে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহেই চরসলিমাবাদ বাজার, চরসলিমাবাদ দাখিল মাদ্রাসা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শত বছরের পুরনো কবরস্থান, খেলার মাঠ ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চরসলিমাবাদ ভুতের মোড় থেকে নদী আর মাত্র ৫০ থেকে ১০০ ফুট ভিতরে ঢুকলেই অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ী আবাদি জমি বিলীন হয়ে যাবে। যার মধ্যে রয়েছে-চরসলিমাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিরকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, সম্ভুদিয়া হাই স্কুল, সম্ভুদিয়া আলিম মাদ্রাসা, সম্ভুদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরবিলানুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিটুয়ানি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মিটুয়ানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আর মাসুকিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাস পুকুরিয়া বিএম উচ্চ বিদ্যালয়, খাস দিলদারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেহাই আরমাসুকিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বীর বাউলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বহলাকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাগুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পয়লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া সিকদারপাড়া বিএম কলেজ, হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাকুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌবাড়িয়া সরকারি এতিমখানা।
এলাকাবাসী জানায়, গত এক বছরে ৬টি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যার মধ্যে রয়েছে-লিজুলিয়া, কাঠালিয়া, পয়লা, সম্ভুদিয়া, হাটাইল ও চৌবাড়িয়া। এছাড়াও ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হতে চলেছে-চরসলিমাবাদ, ভুতের মোড়, পাতরাইল, আরমাসুকা, চরবিনানু, বাগুটিয়া ও মিটুয়াইল।
এ ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসী পয়লা দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি মোশাররফ হোসেন মোল্লা, চরসলিমাবাদ দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি আবদুস সামাদ ও বাকুলিয়া কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক ইনকিলাবকে বলেন, চৌহালি উপজেলায় ১৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এই এলাকার ৬০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখন নদী ভাঙনের কবলে। তাদের মতে-এখানকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ী, আবাদিজমি রক্ষায় নতুন করে প্রকল্প না নিয়ে বরং চৌহালিতে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণের যে কাজ চলছে; তার সাথে যুক্ত করা যেতে পারে এখানকার সাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকা। শুধুমাত্র ডিপিপি সংশোধন করেই এটা করা সম্ভব।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাউবোর টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাজাহান সিরাজ বলেন, চরসলিমাবাদে ব্যাপক ভাঙন চলছে। এখানে দ্রুত প্রতিরক্ষা কাজ হাতে নেয়া জরুরি। চৌহালিতে চলমান প্রকল্পের সাথে একে যুক্ত সরা যায় কীনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, চৌহালি উপজেলা প্রকল্প সম্প্রসারণে সমীক্ষা চলছে। যাতে চরসলিমাবাদকে এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত করা যায়।
এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক একেএম মমতাজ উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, চৌহালিতে চলমান ফেস-১-এর কাজ শেষ পর্যায়ে। ফেস-৩-এর জন্য সমীক্ষা চলছে। এখানে চরসলিমাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনে জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা যেতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দেখার কেউ নেই

১৮ অক্টোবর, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ