বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ
কথায় কথায় আমরা অনেক গর্ব করি। প-িতি ভাব প্রদর্শন করি। সবাইকে অজ্ঞ ভাবি। নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবি অথচ আমরা নিজের মৃত্যুর তারিখটিও জানি না। বিশ্বের তামাম গবেষকরা চেষ্টা করেও মানুষের মৃত্যু কোন সময়, কোন দিন তা আজ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেননি। ঘর থেকে বের হলে নিশ্চিন্তে অফিস বা ব্যবসার কাজ করে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবে কিনা সেটাও মানুষ জানে না। ঈদের ছুটিতে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে সারা দেশে চার দিনে শতাধিকের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিকের ওপর। এরা কি জানত কোরবানির ঈদে বাড়িতে যাওয়া এবং আসার পথে তাদের প্রাণহানি ঘটবে, পাঁচ শতাধিক মানুষকে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাতে হবে। আমরা এ ধরনের ঘটনা ছাড়াও আরো বহু কিছু জানি না। ধরুন ভূমিকম্প হয়ে কোনো একদিন গোটা দেশ তছনছ হয়ে যাবে। এটাও আমরা জানি না। জানা সম্ভব নয়। তবে বিশ্ব ভ্রমা-ের যিনি নিয়ন্তা তিনিই সব কিছু জানেন এবং বোঝেন।
আমরা অনেক কিছুই পারি না। যেমন ধরুন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র এই ভূখ-টিও আমরা সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারিনি বিগত ৪৫ বছর ধরে। এই ব্যর্থতা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতির এই ঢাকা নগরীকেও আমরা সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছি। ঢাকা নগরীকে একটি পরিকল্পনাহীন মেগাসিটি বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। আমাদের এত বড় বড় প-িত মানুষ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক ছেলেমেয়ে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের কিছু অভিজ্ঞ মানুষ এখনো বেঁচে আছেন। অথচ ৪৫ বছরে ঢাকা মহানগরীর করুণ দশার রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা ব্যর্থ। এপ্রিল ২০১৬ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ২১ দিন অবস্থান করে যা দেখলাম বা বুঝলাম মনে হলো বিগত ৪৫ বছরে তারা যতটুকু এগিয়েছে তার সিকিভাগও আমরা পারিনি। কলকাতা আর ঢাকার ব্যবধান এখন অনেক। ’৭১-এর পূর্বে কলকাতা ও করাচি শহর ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহর। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে খবরও বেরিয়েছিল। কিন্তু আজ করাচি ও কলকাতা ঢাকার চেয়ে অনেক এগিয়ে বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে। কলকাতার ভিক্টোরিয়া পার্ক সাজানো-গোছানো। মনে হচ্ছিল কলকাতার পার্কের ঘাসগুলো এইমাত্র গজিয়েছে। গড়ের মাঠ, রেসকোর্স, মোহাম্মদ আলী পার্ক, চায়না টাউন, গোল্ডেন পার্ক, মার্বেল প্যালেস, রাইটাস বিল্ডিং, বিবেকানন্দ পার্ক, ইডেন পার্ক, দেশবন্ধু পার্ক, দেশপ্রিয় পার্ক, ফোট রেডিসন রিসোর্ট, গোল্ডেন পার্ক, চৌরঙ্গী, সেন্ট্রাল এভিনিউ, প্রেসিডেন্স ইউনিভার্সিটি, হুগলি রিডার, গঙ্গা নদী এবং হাওড়াব্রিজ সবকিছুই সাজানো-গোছানো। অথচ, দুঃখ হয় ঢাকার পার্কগুলো দেখলে। ইদানীং পার্কগুলো দোকানপাট, স্বাধীনতার মনুমেন্ট, মন্দির, মসজিদ, সেমিনার হল, চাইনিজ রেস্তোরাঁ, মাদকসেবী, বখাটে দুষ্টচক্র এবং ভাসমান পতিতাদের অবৈধ কর্মকা-ের স্থানে রূপ নিয়েছে। ধানমন্ডির আবাহনীর মাঠটিও বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থলে রূপ নেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখা হয়েছে, নবম তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। বেইলী রোডে প্রায় শত বছরের পুরনো নার্সারিটিতে নির্মাণ করা হয়েছে পার্বত্যবাসীদের কল্যাণের নামে এক বিশাল ভবন। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কটিও এখন মৃত প্রায়। ঢাকার ঐতিহাসিক স্থানগুলো এখন জরাজীর্ণ। প্রতœতাত্ত্বিকরাও চুপচাপ।
এত বুদ্ধিজীবী, সুনাগরিক এবং জ্ঞানদানকারী মানুষের সমাগম ঢাকা মহানগরীতে, অথচ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন সকলেই। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে ঢাকা নগরী যে বিশ্বের অকার্যকর রাজধানীর তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করে বসে আছে সেদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত বায়ুর শহর ঢাকা। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে আমাদের নদীর পানি বেশি দূষিত। মান্যবর বিজ্ঞজনরা এসব নিয়ে একটু ভাবুন। আজকাল অনেকের মুখে শুনি ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে তারাই বলছে বাংলাদেশ কত নোংরা। আব্বা-আম্মার সাথে নেটে কথা বলে জানায় নাগরিকত্ব নিয়ে দেশ ত্যাগ কর। এ দেশে থাকা যাবে না। অনেক মানুষ। পায়ে পায়ে মানুষ, গায়ে গায়ে মানুষ যেন মানুষের মিছিল চলছে ঢাকা শহরে। তাই রাজনৈতিক ব্যবসা যারা করেন মন্ত্রী-মিনিস্টার থেকে শুরু করে অপজিশনে যারা আছেন তাদের ছেলে সন্তানরাও বিদেশে। বহু আগ থেকেই নাগরিকত্ব নিয়ে ওসব দেশে থাকছে। পলিটিক্যাল ক্রাইসিস দেখা দিলে এদেশের রাজনীতিকরা সেসব দেশে নিরাপদে আশ্রয় নেন। অনেকেরই স্থায়ী নাগরিকত্বও আছে বলে শোনা যায়। রাজনীতি থেকে যে আয়-রোজগার হয় তা দিয়েই বিদেশে তারা দ্বিতীয় বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
দেশ উন্নয়নের মডেল হোক তা কখনই তাদের প্রধান বিবেচ্য ছিল না। যদি থাকত তাহলে এই ছোট দেশটি গড়তে সময় লাগত মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের বর্তমান অবস্থানে পৌঁছতেও সময় লেগেছে মাত্র ২০ বছর। আমাদের ভৌগোলিক আয়তন তাদের মতোই। সবচেয়ে বড় কথা ৩২ কোটি হাত ওসব দেশে নেই। কিন্তু আমরা ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাতকে দেশ গড়ার কাজে লাগাইনি। কাজ যে করিনি তা নয়, তবে সে হয়েছে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে সিকি অংশ ব্যয় করেছি মাত্র। ৪৫ বছর দুই দলই পরনিন্দায় ব্যস্ত ছিল, এখন তা আরো বেগবান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এবং শহীদ জিয়াÑ এই দুজনই তাদের রাজনীতির বিষয়বস্তু, রাষ্ট্র এখানে অনুপস্থিত। অনুপস্থিত রাষ্ট্রের ১৬ কোটি নাগরিক যারা গাধার খাটুনি খেটে এখনও জীবন চালাচ্ছে। বেতন যা পায় তার অর্ধেক অংশই ব্যয় হয় সরকারি খাতের বিভিন্ন উৎসে যেমনÑ বাড়ি ভাড়ায়, হোল্ডিং ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল এবং পরোক্ষ যত কর আছে সবই মানুষের পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি কর্মচারীরা মোটামুটি ভালো আছে। কারণ এদের দুই বড় দলেরই প্রয়োজন, তারা ভালো থাকলে ক্ষমতাটা সুরক্ষিত থাকে। সাধারণ জনগোষ্ঠী সেই দুইশ বছর ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল ২৪ বছর এবং বাংলাদেশের ৪৫ বছরের শাসনামলে তাদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি।
দেশের বৃহৎ দুটি দল নকল কথা যত বলে তার ১০ শতাংশও আসল কথা বলে না বলেই দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াÑ এসব দেশে যত মানুষ নিত্যদিন মারা যায় তার কৈফিয়ৎ তলব করার জায়গাটা হলো জাতিসংঘ। সেটাও পরাশক্তির দখলে। কথা বলার জায়গাটাও ওদের নিয়ন্ত্রণে। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ একটি জাতীয় দৈনিকে চমকে ওঠার মতো একটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়, সংবাদটি হলো বিশ্বের চতুর্থ ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন ভারতের মাওবাদীরা। ’৭০-এর দশকে নকশালপন্থি আন্দোলনের জোয়ার বইছিল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। অতি কঠোর বামপন্থি সংগঠন হিসেবে পরিচিত নকশালপন্থিদের সেই সময় ভারত সরকার নিষিদ্ধ করে। এবার সিপিআই মাওবাদী সংগঠনকে বিশ্বের চতুর্থ ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নাম উঠল আন্তর্জাতিক মানদ-ে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, তালিবান, আইএস ও বোকো হারামের পরই নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে মানুষ খুন করে সিপিআই মাওবাদীরা। আর এতেই রীতিমতো নড়েচড়ে বসে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সমীক্ষায় আরো বলা হয় ২০১৫ সালে ভারতে মোট ৭৯১টি জঙ্গি হামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৪৩ শতাংশ হামলাই চালিয়েছে মাওবাদী সংগঠনটি। এতে প্রাণ হারিয়েছে ২৮৯ জন। উক্ত সমীক্ষায় আর ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য প্রকাশ পায়। সেখানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে গোটা বিশ্বে মোট ১১ হাজার ৭৭৪টি জঙ্গি হামলা হয়। আর এসব হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ২৮ হাজার ৩২৮ জন মানুষ। এর মধ্যে ভারতে মাওবাদী হামলা হয়েছে ৩৪৩টি। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, আইএস বিশ্বজুড়ে ৯৩১টি আক্রমণ এবং বোকো হারাম ৪৯১টি আক্রমণ চালিয়েছে। ফলে সংখ্যাতত্ত্বের বিন্যাসে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর ভারতেই জঙ্গি হামলা বেশি হয়েছে। হত্যাকা- চালানোর পাশাপাশি মাওবাদীরা ৮৬২ জনকে অপহরণও করেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বিশ্বের ৩৭টি দেশের ওপর চালানো পরিসংখ্যানে শুধু ২০১৫ সালে গবেষকরা ৭৬৬টি গুমের ঘটনার হদিস পেয়েছে। ২০১৪ সালের সংখ্যার তুলনায় ২০১৫ সালে গুমের সংখ্যা তিনগুণ বেশি। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং আইনের সুরক্ষার অবনতি ঘটে এসময় সবচেয়ে বেশি। গোটা বিশ্বে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বছর ছিল ২০১৫ সাল। ২০১৬ সালের বিগত ৮ মাসের সংখ্যাতত্ত্ব ২০১৫ সালকে বহু আগেই অতিক্রম করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আগামী দিনগুলো আরো ভয়ঙ্কর রূপ নেবে বলেও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশে চলমান কয়েকটি উদারণই প্রমাণ দেবে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ কতটা নি¤œগামী হয়েছে। ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ স্যাটেলাইট টিভিতে দেখানো হয়েছে মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে আছাড় মেরে হত্যা করেছে পাষ- পিতা। নেত্রকোনা জেলায় এ ঘটনা ঘটে। ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকের আরেকটি ভয়ঙ্কর সংবাদ, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রামের নিতু ম-লকে (১৪) নির্মমভাবে কুপিয়ে খ-িত কয়েক টুকরা দেহকে বস্তাবন্দী করে খালে ফেলে দেয় একই গ্রামের যুবক মিলন ম-ল। প্রেমে সাড়া না দেওয়ায় নিতুর এই ভয়ংকর পরিণতি গোটা সমাজ ব্যবস্থার এক দানবীয় চিত্র। এ ছাড়া নিত্যদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষদের খ--বিখ- দেহ দেখলে হৃদয়ের হার্টবিট বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে সবার নয়, যারা মানবিক মূল্যবোধ চিত্তে ধারণ করেন এমন সব মানুষের কথা আমি বলছি।
কারণ আজকাল মানুষ আর মানুষ নেইÑ যার মধ্যে হুঁশজ্ঞান লুপ্ত সে মানুষ বলে বিবেচিত নয়, সে বিবেকহীন পশুর সমতুল্য। আমরা অনেকেই নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে আশপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে একটুও ভাবি না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্ঘটনার তালিকার সাথে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিল অনেক দীর্ঘতম বলা যায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনে এর একটি চিত্র তুলে ধরেছে প্রথম আলো পত্রিকায় ১৯ সেপ্টেম্বর মতামত কলামে। বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। আহতের সংখ্যাও সর্বাধিক। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫ দশমিক ৫। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই হার প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মাত্র ৩। পুলিশের তথ্য আংশিক সত্য বলে প্রতীয়মান। তারা বলছে সারা বছর ৩ থেকে চার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়, কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে তা ২০ থেকে ২১ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামের এক বেসরকারি সংস্থা তাদের হিসেবে উল্লেখ করেছে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৮ হাজার ৬৪২ জন। কিন্তু ২০১৬ সালের ৯ মাসেই এই সংখ্যা অতিক্রম করেছে। গত এপ্রিল মাসে ভারতের তামিলনাড়– (ভারত) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থপেডিক হাসপাতালে এক বাঙালি রোগীর সাথে পরিচয় হয়। তিনি ঢাকার মিরপুরে থাকেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। দুর্ঘটনায় দুই পা-ই অকেজো হয়ে যায়। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নেন প্রায় দুই মাস। কোনো উন্নতি হয়নি। ডাক্তাররা বলেছেন, আপনার পা দুটো কেটে ফেলতে হবে। হুইল চেয়ার ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। আল্লাহর অপার কৃপায় চেন্নাই গিয়ে সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। হাঁটতে পারেন। তার হাসিমুখ খানি দেখে বুঝলাম ঢাকার হাসপাতালের ডাক্তারের উক্তিতে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, যা এখন তাকে আলোর পথের সন্ধান দিয়েছে। বলল, আল্লাহর দরবারে হাজারো শোকরগুজারি করছি। হাসপাতালটি ঘুরে দেখলাম অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়া এই হাসপাতালে কোথাও কোনো অনিয়ম চোখে পড়ল না। সাধারণ জনগণের ওয়ার্ডগুলোও আমাদের দেশের ভিআইপি কেবিনের চেয়ে সুন্দর দেখতে। অত্যন্ত ছিমছাম সাজানো গোছানো। ভোগান্তি নেই বললেই চলে। প্রায় দুই ঘণ্টা রোগীর পাশে অবস্থান করে বুঝলাম সে নিজেই বলেছে আল্লাহর দয়ায় এই হাসপাতালের খোঁজ পাই ঢাকার এক বন্ধুর কাছ থেকে। সে-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমাদের দেশে হাড়ের সমস্যায় ভুগছে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ। খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে হাড়ের সমস্যা ও জয়েন্ট পেইন এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলা যায়। সে তুলনায় মানসম্মত ডাক্তার ও হাসপাতাল নেই। মসজিদে ইদানীং চেয়ারের সংখ্যা বাড়ার কারণও এই দুষ্ট ব্যাধি।
এবার একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরব। আমাদের দেশপ্রেমের মধ্যে খাদ কী পরিমাণ বিদ্যমান তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম এপ্রিল মাসে ভারত সফরে গিয়ে। স্থানটি ছিল কলকাতা। এক কথায় বাঙালির রাজধানী শহর। বর্তমান ভারতের বাংলা রাজ্য নিউ মার্কেট সংলগ্ন পাইকারি মার্কেটে বাংলাদেশের মানুষই বেশি বলে মনে হলো। তৎক্ষণিকভাবে এর উত্তরটা পেয়ে যাই ভারতের বাঙালি এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। আমাকে দাদা সম্বোধন করে বললেন, আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? উত্তরে বললাম, হ্যাঁ। চিকিৎসা না বেড়াতে এসেছেন। না, ব্যবসায়ী কোনো কাজে এসেছেন। খুব আলাপি মানুষ। তার মুখ থেকে যা শুনলাম, তাতে আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, প্রচুর মানুষ কলকাতায় আসে। এতে আমাদের প্রচুর লাভ হচ্ছে। আপনারা আমাদের বড় উপকার করে দিয়েছেন। ’৭১-এর আগে আমাদের ব্যবসা আজকের মতো জমজমাট ছিল না। আপনারা আমাদের বড় কাস্টমার। দুই ঈদে ও পুজোর সময় ভারতে প্রচুর মানুষ ওপার বাংলা থেকে আসে কেনাকাটা করতে। খরচ বেশি লাগে না, ভিসার জটিলতা কেটে গেছে। আমাদের বেচাকেনা ভালো। ডাক্তার ও হাসপাতালগুলো সচল হয়েছে গোটা ভারতবর্ষে। কথাগুলো অত্যন্ত সহজ-সরলভাবেই বলেছেন। ভাবলাম আমাদের ১৬ কোটি মানুষের ব্যবসা এখন ভারতের দখলে। অথচ, ষাটের দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দুই বেলা ভাত খেতে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত। দুই আনা সের দরে সীমান্তে তখন ফেন (ভাতের মার) বিক্রি হতো। পশ্চিম বাংলার মানুষ ফেন কেনার জন্য সীমান্তে লুকিয়ে আসত, ইপিআরের ভয়ে সাহস পেত না বর্ডার এলাকায় আসতে। সেই ভারত বিশেষ করে বর্তমান বাংলা রাজ্য কতটা এগিয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্য। কারণ দেশপ্রেম আছে বলেই তারা স্বনির্ভর শুধু নয়, বিশ্বে অন্যতম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।
পত্রিকায় দেখলাম ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দুই দেশে বাণিজ্যে সমতা কখনই ছিল না। ভারত আমাদের দেশ থেকে আমদানি করে মাত্র ১০ শতাংশ আর আমরা ভারত থেকে আমদানি করি ৯০ শতাংশ পণ্যসামগ্রী। চোরাপথ তো আছেই। বৃটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফসলটা এখনো ঘরে তুলতে পারিনি। এ ব্যর্থতা আমাদের থেকেই গেল।
লেখক : গ্রন্থগার, গবেষক ও কলামিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।