বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. ইশা মোহাম্মদ
সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে- অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছেন। এবং ইতোমধ্যেই বুদ্ধি খরচ করে করের আওতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ধারণা করি, এতে কর সংগ্রহের পরিমাণ যথেষ্টই বাড়বে। কিন্তু ঐ বাড়তি করের কারণে সরকারের ‘ত্যাগ স্বীকার’ কতটা হবে? তার কোনো আর্থিক হিসাব নেই। মন্ত্রী মহোদয় মনে হয় ভুলেই গেছেন যে, শেখ হাসিনার সরকার মূলত গণতান্ত্রিক সরকার। গণতান্ত্রিক সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বদলায়। সে কারণে সাবধানে চলতে হয়। ইচ্ছামত সদাচার করা গেলেও কদাচার করা যায় না। করের বিষয়ে কড়াকড়ি সবসময়েই কদাচার হিসেবে গণ্য হয়। কর মানেই সরকারের কদাচার কেন হবে? মূলত কেউই কর দিতে চায় না। আদিকাল থেকে অদ্যাবধি খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, কোনো কালেই মানুষ স্বেচ্ছায় কর দিতে চাইনি। কর যত কম বা বেশি হোক না কেন, যে দেয় সে মনে করে অকারণ গচ্চা দেয়া হলো। যে কারণে সরকারকে কর আদায় করতে হয়। শান্তিসুখে জনগণের কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারে না।
অতীতে দেখা যায়, কেবলমাত্র ধনীরাই কর দিত। কারণ কি? দেশটা ছিল ধনীদের। তারা দেশ চালানোর জন্য নিজেরা খরচ ভাগাভাগি করে বহন করত। যে কারণে সাধারণ মানুষকে কর দিতে হতো না। তবে সাধারণ মানুষ ঐ করের বোঝা বহন করত অপ্রতক্ষ্য কর হিসেবে। ধনীরা শোষণের মাধ্যমে দেয় করের বহুগুণ আদায় করে নিত। বেগার খাটা ছিল সাধারণ বিষয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে দেখা গেল ধনী ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক। আবার এদের কারোরই কোনো মানসম্মান জ্ঞান নেই। যে কারণে ধনী ব্যবসায়ীরাও কর না দেয়ার ফাঁক-ফোকড় খুঁজতে গিয়ে নিজেরাই কর আইন তৈরি করে তার জালে আটকা পড়ল। এ ক্ষেত্রেও দেখা যায়, এই ধনী ব্যবসায়ীরা কর ফাঁকি দেয় অপ্রতক্ষ্যভাবে। তারা তাদের পণ্যমূল্যের যৎসামান্য টাকা বাড়িয়ে সরকারকে দেয় কর উসুল করে নেয়। তাহলে শেষমেষ দাঁড়াচ্ছে কী? কর দেয় সাধারণ মানুষ। অন্যেরা ফাঁকি দেয়। এখনে পর্যন্ত এই বড় ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে ফাঁকির টাকা আদায়ের কোনো কৌশল আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।
যেকোনো দেশের যে কোনো মন্ত্রী বলতে পারেন, সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু ঐ কথা বলার পরিণতি কী হতে পারে তা ভাবলে তারা তা বলতেন না। সবাইকে করের আওতায় আনার কুবুদ্ধি ব্রিটিশদের। তারা যখন বিশ্বব্যাপী কলোনি তৈরি করে শোষণ করছিল, তখন অত্যন্ত সহজ উপায়ে অত্যধিক আয়ের চিন্তা করেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তরিকা চালু করেছিল। যেখানে আখে টাকা আসে সেখানে আখে এবং যেখানে করে টাকা আসে সেখানে করের উপরে কর বসিয়ে কামাই করেছিল অঢেল টাকা-পয়সা। ভারতের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাংলায় করের ব্যাপারটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সকলকে করের আওতায় আনার কুপরিকল্পনা ছিল এক ব্রিটিশ আমলার। তিনি দেখেছিলেন, করের যে নীতিমালা তাতে সবার কাছ থেকে কর আদায় সম্ভব নয়। হতদরিদ্রদের কাছ থেকে কর নেয়ার নীতি তখন পর্যন্ত ব্রিটিশদের ছিল না। কিন্তু আয় বাড়ানোর অন্য কোনো উপায়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই ব্রিটিশ আমলা ইংল্যান্ডে তার বিশেষ এক ডেসপাচে লিখলেন, প্রায় উলঙ্গ বাস্তুভিটাহীন সর্বহারাদের কাছ থেকে কর আদায় করা সম্ভব নয়। এদের সংখ্যাই সর্বাধিক। ধনীর সংখ্যা খুবই কম। করের মাধ্যমে আয় বাড়াতে হলে সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? একমাত্র উপায় হচ্ছে অপ্রত্যক্ষ কর চাপানো। জনসংখ্যার বিশাল অংশ হতদরিদ্র হলেও, এরা ভূমিহীন বাস্তুভিটাহীন হলেও পুষ্টিকর খাদ্য না খেলেও শুধুভাত হলেও খায়। শুধু ভাত খাওয়ার সময় তারা যৎসামান্য হলেও লবণ খায়। সবাই যেহেতু লবণ খায় সেহেতু লবণ কর বসিয়ে বাড়াবাড়ি হলেও প্রভূত আয় করা সম্ভব। আমলার পরামর্শ গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীরা। কিন্তু তাতে কামাই হয়েছিল ভালো, ফল হয়েছিল খারাপ।
ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়, বাংলার সাধারণ মানুষ নির্বিকার
ছিল। মোগল বাংলায় সাধারণ মানুষের শত্রু ছিল জমিদার নবাবরা নয়। ব্রিটিশের প্রথম পর্বেও একই অবস্থা ছিল। জমিদাররাই সাধারণ মানুষের শত্রু, ব্রিটিশরা নয়। কারণ ব্রিটিশরা সরাসরি খাজনা কিংবা কর আদায় করত না। কিন্তু এই অবস্থা সিপাহী বিপ্লবের পরে পাল্টে যায়। ব্রিটিশরা সরাসরি কর আদায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। খাজনা ছাড়াও বিভিন্ন আবগারি শুল্ক আদায় করতে থাকে। জনসাধারণ ব্রিটিশদের চিনতে শুরু করে। ব্রিটিশদের খুব ভালোভাবে চিনেছিল, নীলকরদের অত্যাচারের কারণে। যখন ব্রিটিশবিরোধী গণআন্দোলন বিস্তারিত হচ্ছিল তখন নেতারা সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে নিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন। এর আগে কেবলমাত্র ধনীরাই ব্রিটিশ রাজত্বের বিরোধিতা করেছিল। সাধারণ মানুষকে গণআন্দোলনে নামানোর সবচেয়ে বড় কৌশল ছিল সত্যাগ্রহ।
গান্ধী এ সময়ে লবণ লংমার্চও করেছিলেন। লবণ কর সকল মানুষকে অসন্তুষ্ট করেছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সকল রকমের অসন্তোষকে কাজে লাগাচ্ছিলেন নেতারা। গান্ধী ঠিকই বুঝেছিলেন লবণ কর অসন্তোষ তৈরি করেছে। তাই তিনি গণআন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ নিয়ে লবণ লংমার্চ করেছিলেন। গান্ধীর লংমার্চ ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনে সার্বিক অর্থে গণসম্পৃক্ততা বেড়ে ছিল। লবণ কর পুরো জাতিকে গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছিল। ব্রিটিশরা গণঅসন্তোষের বিভিন্ন কারণ নিয়ে গবেষণা করেছিল। কারণগুলোর মধ্যে কর শুল্ক খাজনার নামে জবরদস্তি আদায়গুলোও ছিল। গণঅসন্তোষ এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, যারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে ব্রিটিশদের দালালি করত, সেইসব আমলা-কামলা, রায়বাহাদুর, খানবাহাদুররা পালানোর পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অনেকেই জীবন বাঁচানোর জন্যে আন্দোলনকারীদের গোপনে চাঁদাও দিত। এ সময়েই ব্রিটিশরা পুরোপুরি গণধিকৃত হয়ে যায়।
সাধারণ মানুষকে অসন্তুষ্ট করে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না। বাংলাদেশের সব মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে মজা করে সরকার চালানো যাবে না। সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে সম্মান করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় ছোট-খাট ভুল সিদ্ধান্তের কারণে খুব বড় রকমের অসন্তোষ তৈরি হয়। যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্ত খুব বড় রকমের অসন্তোষ তৈরি করেছিল। তার জনপ্রিয়তাও কমে গিয়েছিল। এধরনের বিতর্কিত বিষয় সবসময়েই বিরোধী দলকে আন্দোলনের এজেন্ডা দিয়ে দেয়। অবশ্য গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনো কোনো সময় বিরোধী দলকে তাজা রাখার জন্যে সরকার তাদের হাতে আন্দোলনের এজেন্ডা তুলে দেয়। প্রকৃত দেশপ্রেমীরা এমন কাজ প্রায়ই করে থাকে।
খাজনার ব্যাপারটা বাংলাদেশে সবসময়ই উৎকট। প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকরা খাজনা দিতে চাইত না। শতকরা নব্বই শতাংশ খাজনা আদায় ছিল জবরদস্তি। দশ শতাংশ দিতেন সম্ভ্রান্ত বংশীয়রা। ভয়ের কারণেই সঠিক সময়ে খাজনা দিয়ে দিত। খাজনা দেয়ার গড়িমসির ব্যাপারটি বুঝতে পেরেই ইংরেজরা সূর্যাস্ত আইন তৈরি করেছিল। বঙ্গবন্ধু আটচল্লিশ থেকে উনসত্তর পর্যন্ত তার জনসভাগুলোতে গরিবের খাজনা মাফ করে দেয়ার কথা বলতেন। ক্ষমতায় গিয়েই তিনি প্রকৃত গরিবের এবং প্রান্তিক চাষিদের সকল প্রকার খাজনা মাফ করে দিয়েছিলেন। সে সময়েই জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলেছিলেন ঐ কারণে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বেড়ে গেছে। সাথে ছিল প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ব্যাপার। সাধারণ মানুষ তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে স্থান দিয়েছিল। এখন উল্টো বাতাস বইছে। গরিব কিংবা ধনী সবাইকে খাজনার আওতায় আনা হচ্ছে। ভাবাই হচ্ছে না যে, ঐ কারণে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়বে নাকি কমবে?
জনপ্রিয়তা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতাটা অনন্য। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করেছিলেন যে, কোনো ব্যক্তির হাজারো ভালো কাজের সাফল্য শুধুমাত্র একটি খারাপ কাজের কারণেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে বাঙালি মনস্তত্ত্বেই এটা দেখা যায়। রাজনীতিবিদের জনপ্রিয়তার বিষয়টিতে এই সমীকরণ খুবই যুঁৎসই। দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ভালো মানুষটিই রাতারাতি খারাপ হয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ করায় তার জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। আবার শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ত্যাগ করে মুসলিম লীগে পুনরায় যোগ দেয়ায় তার জনপ্রিয়তা কমে ছিল। ঋণ শালিসেই কিন্তু তার জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, বারাক ওবামার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। কয়েকটি বিতর্কিত কথাবার্তাতেই তিনি অপাংক্তেয় হয়ে গেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে দেখা গেছে, জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট তাদের শেষ বেলাতেও সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে হোয়াইট হাউস ছেড়েছেন। কিন্তু নিক্সন কিংবা ওবামার ক্ষেত্রে তা হয়নি, হবে না। ক্লিনটনও অপছন্দকৃত হয়েছেন। তাদের ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যাপারটা এক বা দু’টার্মে শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে না পারলে কি বহুদিন থাকা সম্ভব?
বেশকিছু বিষয় আছে যা খুবই স্পর্শকাতর। তার মধ্যে খাজনার ব্যাপারটি সর্বজনীন। বাঙালিরা ধনী হচ্ছে। ধনী হয়ে গেছে, এসব বাজে কথা লোকেরাই কেবল বলছে। প্রকৃত অবস্থা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি গরিব। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়- অবস্থা এখনো কাটেনি। যে কারণে দশ টাকায় চাল দেয়ার ব্যাপারটা তারা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। কিন্তু যাদের প্রকৃত অর্থে ভাতের অভাব নেই তারা ঐ কারণে আহ্লাদ অনুভব করবে না। আর বাংলাদেশেই প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক সচেতন মানুষ স্বাচ্ছন্দিক। এরা খুব বড় লোক নয় কিন্তু গরীবও নয়। মধ্যবিত্ত বলাই ভালো। আর মধ্যবিত্তের একাংশ এতই স্বার্থপর যে, রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে নির্বিকার থাকে। যে অংশ সচেতন সে অংশের সবাই খাজনা দেয়। ফাঁকিও দেয়। এরা চটলে খুব বেশি ক্ষতি হয় না। কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার গরিবরা চটলে খবর খারাপ হয়। আওয়ামী লীগ কি জানে না যে, গরিবরাই তাদের প্রধান সমর্থক? গরিবি হঠাও এর সাথে গরিবি চটাও গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।