Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবরারের মায়ের কান্না থামছে না...

আবু জাফর মুহাম্মদ সোহেল | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০২১, ১০:৩৮ এএম

সময় দ্রুতই বইছে। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের কথাও মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে তার মা-বাবা ও একমাত্র ভাই এই দিনের নির্মমতাকে বিন্দুমাত্র ভুলতে পারেননি। বরং দিন যত যাচ্ছে তাদের কষ্টের পাহাড় দীর্ঘ হচ্ছে। এদিকে আবরারের খুনের সাথে জড়িতদের বিচার এগিয়ে চলছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এই বছরের নভেম্বরেই প্রথম সপ্তাহে মামলাটির বিচার শেষ হবে।

বাড়ির পাশে নীরবে শুয়ে আছে আবরার। প্রতিদিন সেদিকে ছুটে যায় তার মা। দূর থেকে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন। কারো পায়ের শব্দ পেলেই আঁচলে মুখ ঢাকেন। পরক্ষণেই ছুটে আসেন বাড়িতে। মনোযোগী হতে পারেন না কোনো কাজেই। ভাবেন, এই বুঝি আবরার মা বলে ডাক দিলো।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর শিবিরের তকমা লাগিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বী (২২)কে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। কষ্টের পাথর বুকে নিয়ে এভাবেই কেটে গেল মা রোকেয়া খাতুনের দুই বছর। এখন প্রতিটি ক্ষণই তার কাছে অসহ্য, যন্ত্রণার। কারণ এক মুহূর্তের জন্য প্রিয় সন্তানকে ভুলে থাকতে পারেন না তিনি। তার স্মৃতি আক্টেপিষ্ঠে এমনভাবে তাকে জড়িয়ে আছে যে তা কোনোভাবেই ভুলবার নয়।

আবরারের জন্মের কথা স্পষ্টই মনে আছে রোকেয়া খাতুনের। যেদিন তার জন্ম হয়েছিল সেদিন চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। পুত্র সন্তানের মা হয়ে রোকেয়া। এমন কথা গর্বের সাথে অনেকেই বলেছে হাস্যোজ্জল মুখে। তার (আবরারের) দাদা বলতেন, বউমা তোমার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকেয়া খাতুন। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, তার দাদার কথায় সত্যি হয়েছে। আবরার অনেক বড় হয়েছে। ওকে সবাই চিনে। সে এখন এলাকাবাসীর গর্ব। কিন্তু আমার বুক খালি। এই বুকের হাহাকার মিটাবে কে। আবরারকে তো ওরা মেরে ফেলেছে। সেদিন আবরারের সাথে আমাকেও যদি মেরে ফেলতো তারা, তাহলে মুক্তি পেতাম। এত কষ্ট আর সইতে পারি না। এমন ছেলেকে হারিয়ে কে ভালো থাকতে পারে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোকেয়া খাতুন বলেন,‘দেখতে দেখতে দুই বছর হয়ে গেলো আবরারকে হারিয়েছি। স্বামী, বাবা-মা মারা গেলে সহ্য করা যায়। কিন্তু সন্তান যদি এভাবে মারা যায় তাহলে কোন মা সহ্য করতে পারে। তারপরও বুকে কষ্ট চেপে নিয়ে কোনো রকমে চলছি। ওর কথা তো একটা সেকেন্ডের জন্যও ভুলতে পারি না। বাবা-মায়ের কাছে সবচেয়ে ভারী বোঝা সন্তানের লাশ। নেই বোঝা নিয়েই কাটাতে হবে। এরচেয়ে আর কষ্টের কি হতে পারে।’

তিনি বলেন,‘ওরা ওকে এত নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে। ওই কথা মনে পড়লে আল্লাহর কাছে বলি, হে আল্লাহ তুমি আমাকে আর দীর্ঘায়িত করো না। কিন্তু ওর ছোট ভাই আবরার ফায়াজের তো আর কেউ নেই। সে বলে, আম্মু তুমি আর আব্বু ছাড়া কো আমার আর কেউ নেই। তখন কিছু বলতে পারিনা। ফায়াজের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল ওর ভাই। সে ফায়াজকে যেভাবে দাঁড় করাতে পারতো আমরা তো তা পারবো না। আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো। ওরা যদি আবরারের একটা হাত বা পা কেটে ফেলতো, তাও সব সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে ওকে চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে আসতাম। তারপরও তো আমার সন্তান আমার সামনে থাকতো।’

রোকেয়া খাতুন বলেন,‘আসামিদের শাস্তি হোক, মৃত্যুদ- হোক। ওদের বাবা-মা যখন সন্তানের লাশ দেখতে পাবে তখন তারা বুঝবে আমার মত সন্তান হারানো এক মায়ের কষ্ট। এত কিছুর পরও আমার মনে হয়, আবরার আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। পরক্ষণেই যখন মনে পড়ে সে তো মারা গেছে। তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। ওদের (আসামি) কাছে আমার জানতে ইচ্ছে হয়, ওরা কেন আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। দুনিয়াতে ছেলের সাথে আমাকে থাকতে দিলো না। আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করি, জান্নাতে যেন ওর সাথে আমার বেশি সময় দেখা হয়।’

আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন,‘ ছেলেটাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার দুই বছর পার হয়ে গেলো। এখন মনে হয় সব জায়গায় পিছিয়ে যাচ্ছি। মামলার বিচার কিছু পিছিয়ে যাওয়ায় মনটাও খারাপ। কিছুট সংশয় কাজ করছে। তবুও আশায় আছি। একটাই আশা, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা।’

তিনি বলেন,ভাগ্যের পরিহাস। করোনার কারণে দুই দফায় আদালত বন্ধ ছিল। আবার এখন বিচারক করোনায় আক্রান্ত। যাই হোক, এখন আর যেন বিচারটা বিলম্ব না নয় সেই প্রত্যাশা করছি। যত দিন যাচ্ছে, ছেলের কথা তত বেশি মনে পড়ছে বলে জানান বরকত উল্লাহ।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। আগামি ২০ অক্টোবর মামলাটি রাষ্ট্্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ধার্য রয়েছে।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি থেকে অচেতন অবস্থায় আবরার ফাহাদকে উদ্ধার করা হয়। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরার ফাহাদকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। গত বছরের ১৩ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ আত্মপক্ষ শুনানি হয়। কয়েক আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। এখন মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে রয়েছে।

আবরার বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আবরার হত্যা

১০ ডিসেম্বর, ২০২১
৯ ডিসেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ