Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপকূলের সোয়া দুই লাখ হেক্টর বনভূমি ক্ষতবিক্ষত

একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ

নাছিম উল আলম : | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০১ এএম

বঙ্গোপসাগর থেকে ধয়ে আসা সিডর, আইলা, মহাসেন, আম্পান ও ইয়াসের মত বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত কারণে দেশের বিশাল উপকূলীয় বনভূমি ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ হিসেবে কাজ করলেও তা এখন অনেকটাই ক্ষত-বিক্ষত। ১৯৬৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা ও সাহায্য সংস্থার অর্থায়ন ছাড়াও দেশের নিজস্ব সম্পদে যে প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর উপকূলীয় বনভূমি সৃজন করা হয়েছে, তার অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ ইতোমধ্যে বিনষ্ট হয়েছে। প্রতিটি ঝড়-ঝঞ্ঝায় উপকূলীয় বনভূমির বিপুল সংখ্যক গাছপালা বিনষ্ট হলেও সে ক্ষতি পূরণের উদ্যোগ জোড়ালো নয়।

বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উপকূলীয় এলাকায় নতুন বন সৃজনে কোন প্রকল্প না থাকায় বিদ্যমান ও ক্ষতিগ্রস্থ বনভূমির স্থায়িত্ব ও টেকসই ধারা অব্যাহত থাকছে না। এর সাথে সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ছত্রাকবাহী এক ধরনের রোগে শিশু গাছের ব্যাপক মড়ক শুরু হয়েছে। ফলে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনি প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন রাস্তা ও বেড়িবাঁধে সৃজিত হাজার হাজার শিশুগাছ মরে যাচ্ছে।
১৮৭৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর থেকে ৪৮ বার তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও ৪৯ বার ঘূর্ণিঝড় ও ২০ বার হেরিকেন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে। বন বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে উপকূলীয় বনের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টরের প্রায় ১৪ হাজার চারা ও ৪৬৫টি গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় পৌঁনে ৪শ’ কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে প্রায় ১২ হাজার হেক্টরের বনবাগান ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

সবশেষ গত মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরের ম্যানগ্রোভ বাগান, পৌনে ২শ’ হেক্টরের স্ট্রীপ, গোলপাতা ও ঝাউ বাগান ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরের নার্সারি চারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ২৪৮ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ভোলা ও বরিশালের প্রায় ১ কোটি সরকারি-বেসরকারি গাছপালা বিনষ্ট হয়।

সম্প্রতি ভারত, ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন গবেষক সুন্দরবনসহ বরিশাল অঞ্চলের উপকূলীয় বনবাগান পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। তাদের গবেষণা ফলাফল আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘এলসেভিয়ায়ের এষ্টুয়ারিন, কোষ্টল এন্ড সেলফ সায়েন্স জার্নাল’ এ প্রকাশিত হয়েছে। ওই গবেষণাপত্রে আম্পানসহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বনের ক্ষতি ৫৬.১৯ শতাংশ এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি আম্পানের কারণে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বা লবনাম্বুজ বনের সব অংশেরই অবনতিসহ ভাঙন দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে বছর তিনেক আগে ১০৪ কোটি টাকার সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টরে নতুন বনায়নসহ এক হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। উপকূলের ১০টি জেলায় চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ বনায়ন সম্পন্ন করার কথা থাকলেও আরো ১ বছর মেয়াদ বৃদ্ধিসহ প্রকল্প ব্যয় সোয়া ৩ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ৪০ হাজার বসতবাড়িও বনায়ন করার কথা। এছাড়াও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের সহায়তায় উপকূলীয় এলাকায় আরো বনায়নের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

সরকার বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখার ১৯টি জেলার ৪৮টি উপজেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে উপকূলীয় এলাকা হিসেবে চিহিৃত করেছে। যা দেশের মোট আয়তনের ৩০%। মোট জনসংখ্যার ২৮% মানুষ এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করে। উপকূলীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীসহ সম্পদকে রক্ষায় ১৯৬৬ সাল থেকে যে বনায়ন শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উপকূলভাগে ইতোপূর্বে দুই লক্ষাধিক হেক্টর সরকারি খাস জমিতে লবনাম্বুজ বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে।

কিন্তু বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করতে গিয়ে এসব উপকূলীয় বনভূমি ইতোমধ্যে অনেকটাই ক্ষতবিক্ষত। সিডরের ক্ষতি পূরণের আগেই পরবর্তী ৩ বছরে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন ও আইলা উপকূলীয় বনবাগানসহ বিশাল জনপদকে আরো বিপন্ন করে তোলে।

এবার বর্ষা মৌসুমের শুরুতে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ পাশর্^বর্তী ভারতে বৃষ্টির অভাবে উজান থেকে নদ-নদীর প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাসের ফলে সাগরের লবণাক্ত পানি উপকূল থেকে বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরে ভাটিতে মেঘনার হিজলা পর্যন্ত পৌছে যায়। উপকূলীয় এলাকা ও এর নদ-নদীগুলোতে লবণাক্ততার মাত্রা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাবার কারণেও বনের ক্ষতি হচ্ছে। আবার অনেক চরাঞ্চলে ক্রমাগত পলি পড়ে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলেও গাছ পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। ফলে তার টেকসই স্থায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পলি জমে উপকূলের নদী ও খাল ভরাট হবার কারণেও বনের ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

আবার নদী ভাঙনেও সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর বনভূমি বিলীন হয়েছে। উপকূলীয় বনায়নে আর্থিক সহায়তাকারী বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি হ্রাস পাবার কথা বলা হয়েছে।
ইয়াস, বুলবুল ও আম্পানের ছোবলে দক্ষিণ উপকূলের কুয়াকাটা সংলগ্ন উপকূলীয় বনভূমি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গত ১৫ বছরে কুয়াকাটা সংলগ্ন উপকূলীয় বনাঞ্চলের প্রায় ৬৪ ভাগ বনভূমি সাগরের ঢেউসহ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলেও জানা গেছে। কুয়াকাটা ইকোপার্ক, নারিকেল বাগান ও ঝাউ বাগানসহ লবনাম্বুজ বনের বেশিরভাগ এলাকাই বিলীন হয়েছে।

দেশের উপকূলভাগে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ হেক্টরে লবনাম্বুজ বন, সাড়ে ৮ হাজার হেক্টরে মূল ভূমির নন-ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বন, প্রায় ৩ হাজার হেক্টরে গোলপাতা, ২শ’ হেক্টরে বাঁশ ছাড়াও অরো কয়েকশ’ হেক্টরে নারিকেলসহ বিভিন্ন ধরনের ফলজ বনায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধসহ বিভিন্ন ধরনের রাস্তার ধারে ১ লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বনভূমির কারণে দেশের বিশাল উপকূলীয় এলাকায় ইতোমধ্যে অনেক ভূমি উদ্ধারও সম্ভব হয়েছে। অনেক চরাঞ্চল মূল ভূ-খণ্ডের সাথেও যুক্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে পরিবেশবিদদের মতে ভূ-খণ্ড উদ্ধারের চেয়েও এসব সৃজিত বনভূমি সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলভাগকে রক্ষায়।

এসব ব্যাপারে বন বিভাগের বরিশাল কোস্টাল সার্কেলের সংরক্ষক জানান, বনভূমির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কোন প্রকল্প বা কর্মসূচি না থাকলেও চলমান প্রকল্পটির আওতায় আমরা যতটা সম্ভব ক্ষতি মেরামতের চেষ্টা করছি। উপকূলীয় বন দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের রক্ষা কবজ বলে উল্লেখ করে এ বন বাঁচলে উপকূল বাঁচবে বলে মন্তব্য করে যেকোন উপায়ে তা রক্ষাসহ আরো সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ