বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
বঙ্গোগাপসাগর থেকে ধয়ে আসা ‘সিডর’, ‘আইলা’, ‘মহাসেন’ ‘আম্পান’ ও ‘ইয়াস’এর মত বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছাস প্রতিহত করনে দেশের বিশাল উপকুলীয় বনভুমি ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ হিসেবে কাজ করলেও তা এখন অনেকটাই ক্ষত বিক্ষত। ১৯৬৬ সাল থেকে বিশ^ব্যাংক সহ বিভিন্ন দাতা ও সাহায্য সংস্থার অর্থায়ন ছাড়াও দেশের নিজম্ব সম্পদে যে প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর উপক’লীয় বনভ’মী সৃজন করা হয়েছে, তার অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ ইতোমধ্যে বিনষ্ট হয়েছে। প্রতিটি ঝড়ঝঞ্ঝায় উপক’লীয় বনভ’মীর বিপুল সংখ্যক গাছপালা বিনষ্ট হলেও সে ক্ষতি পুরনের উদ্যোগ যোড়াল নয়।
বিগত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে উপক’লীয় এলাকায় নতুন বন সৃজনে কোন প্রকল্প না থাকায় বিদ্যমান ও ক্ষতিগ্রস্থ বনভ’মীর স্থায়িত্ব ও টেকসই ধারা অব্যাহত থাকছে না। এরসাথে সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ছত্রাকবাহী এক ধরনের রোগে শিশু গাছের ব্যাপক মড়ক শুরু হয়েছে। ফলে ‘উপক’লীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প’র আওতায় দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক’লীয় এলাকার বিভিন্ন রাস্তা ও বেড়ী বাঁধে সৃজিত হাজার হাজার শিশুগাছ মড়ে যাচ্ছে।
১৮৭৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর থেকে ৪৮ বার তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও ৪৯ বার ঘূর্ণিঝড় ও ২০ বার ‘হেরিকেন’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপক’লীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে। বন বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’এর আঘাতে উপক’লীয় বনের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টরের প্রায় ১৪ হাজার চাড়া ও ৪৬৫টি গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর্থিক ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় পৌনে ৪শ কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’এ প্রায় ১২ হাজার হেক্টরের বনবাগান ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আর সবশেষ গত মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’এর প্রভাবে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরের ম্যানগ্রাভ বাগান, পৌনে ২শ হেক্টরের স্ট্রীপ, গোলপাতা ও ঝাউ বাগান ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরের নার্সরী চারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর রাতে ২৪৮ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’এর আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ভোলা ও বরিশালের প্রায় ১ কোটি সরকারী-বেসরকারী গাছপালা বিনষ্ট হয়।
সম্প্রতি ভারত, ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন গবেষক সুন্দরবন সহ বরিশাল অঞ্চলের উপক’লীয় বনবাগান পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। তাদের গবেষনা ফলাফল আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘এলসেভিয়ায়ের এষ্টুয়ারিন, কোষ্টল এন্ড সেলফ সায়েন্স জর্নাল’এ প্রকাশিত হয়েছে। ঐ গবেষনাপত্রে আম্পান সহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বরিশাল উপক’লীয় অঞ্চলের বনের ক্ষতি ৫৬.১৯ শতাংশ এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি আম্পানের কারণে উপক’লীয় ম্যনগ্রোভ বা লবনাম্বুজ বনের সব অংশেরই অবনতি সহ ভাঙন দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বছর তিনেক আগে ১০৪ কোটি টাকার সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টরে নতুন বনায়ন সহ এক হাজার কিলোমিটার উপকুলীয় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। উপকুলের ১০টি জেলায় চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ বনায়ন সম্পন্ন করার কথা থাকলেও আরো ১ বছর মেয়াদ বৃদ্ধি সহ প্রকল্পব্যায় সোয়া ৩ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ৪০ হাজার বসতবাড়ীও বনায়ন করার কথা।
এছাড়াও ‘গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড’এর সহায়তায় উপক’লীয় এলাকায় আরো বনায়নের একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ প্রাথমিক পর্যয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকার বঙ্গোসাগরের কোল ঘেসে দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকুলীয় তটরেখার ১৯টি জেলার ৪৮টি উপজেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘উপকুলীয় এলাকা’ হিসেবে চিহিৃত করেছে। যা দেশের মোট আয়তনের ৩০%। মোট জনসংখ্যার ২৮% মানুষ এসব ঝুকিপূর্ণ এলাকায় বাস করে। উপক’লীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী সহ সম্পদকে রক্ষায় ১৯৬৬ সাল থেকে যে বনায়ন শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উপকুলভাগে ইতোপূর্বে দুই লক্ষাধীক হেক্টর সরকারী খাশ জমিতে ‘লবনাম্বুজ বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে।
কিন্তু বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাশ প্রতিহত করতে গিয়ে এসব উপক’লীয় বনভ’মী ইতোমধ্যে অনেকটাই ক্ষতবিক্ষত। সিডরের ক্ষতি পুরনের আগেই পরবর্র্তি ৩ বছরে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাশেন’ ও ‘আইলা’ উপক’লীয় বনবাগান সহ বিশাল জনপদকে আরো বিপন্ন করে তোলে।
এবার বর্ষা মৌসুমের শুরুতে দেশের উত্তরাঞ্চল সহ পাশর্^বর্তি ভারতে বৃষ্টির অভাবে উজান থেকে নদ-নদীর প্রবাহ আশংকাজনক ভাবে হ্রাসের ফলে সাগরের লবনাক্ত পানি উপক’ল থেকে বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরে ভাটিতে মেঘনার হিজলা পর্যন্ত পৌছে যায়। উপক’লীয় এলাকা ও এর নদ-নদীগুলোতে লবনাক্ততার মাত্রা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাবার কারণেও বনের ক্ষতি হচ্ছে। আবার অনেক চরাঞ্চলে ক্রমাগত পলি পড়ে ভ’মির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলেও গাছ পর্যাপ্ত পানি পচ্ছেনা। ফলে তার টেকসই স্থায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পলি জমে উপক’লের নদী ও খাল ভরাট হবার কারণেও বনের ইকোসিষ্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
আবার নদী ভাঙনেও সুন্দরবন সহ উপক’লীয় এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর বনভুমি বিলীন হয়েছে। উপক’লীয় বনায়নে আর্থিক সহায়তাকারী বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার বনভ’মি হ্রাস পাবার কথা বলা হয়েছে।
ইয়াশ, বুলবুল ও আম্পানের ছোবলে দক্ষিন উপক’লের কুয়াকাটা সংলগ্ন উপক’লীয় বনভ’মি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গত ১৫ বছরে কুয়াকাটা সংলগ্ন উপক’লীয় বনাঞ্চলের প্রায় ৬৪ ভাগ বনভ’মি সাগরের ঢেউ সহ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলেও জানা গেছে। কুয়াকাটা ইকোপার্ক, নারকেল বাগান ও ঝাউ বাগান সহ লবানাম্বুজ বনের বেশীরভাগ এলাকাই বিলীন হয়েছে।
দেশের উপকুলভাগে এ পর্যন্ত প্রায় ২লাখ হেক্টরে লবনাম্বুজ বন, সাড়ে ৮ হাজার হেক্টরে মূল ভুমির নন-ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বন, প্রায় ৩ হাজার হেক্টরে গোলপাতা, ২শ হেক্টরে বাঁশ ছাড়াও অরো কয়েকশ হেক্টরে নারকেল সহ বিভিন্ন ধরনের ফলজ বনায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার উপকুলীয় বাঁধ সহ বিভিন্ন ধরনের রাস্তার ধারে ১ লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগান হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বনভ’মির কারনে দেশের বিশাল উপকুলীয় এলাকায় ইতোমধ্যে অনেক ভুমি উদ্ধারও সম্ভব হয়েছে। অনেক চরাঞ্চল মূল ভু-খন্ডের সাথেও যূক্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে পরিবশেবীদদের মতে ভু-খন্ড উদ্ধারের চেয়েও এসব সৃজিত বনভুমি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক ভুমিক রাখছে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়-জলোচ্ছাসের হাত থেকে উপকুলভাগকে রক্ষায়।
এসব ব্যপারে বন বিভাগের বরিশাল কোষ্টাল সার্কেলের সংরক্ষক জানান, বনভ’মির ক্ষয়ক্ষতি পূণর্বাশনে কোন প্রকল্প বা কর্মসূচী না থাকলেও চলমান প্রকল্পটির আওতায় আমরা যতটা সম্ভব ক্ষতি মেরামতের চেষ্টা করছি। উপক’লীয় বন দেশের ‘প্রাকৃতিক ভারসাম্যের রক্ষা কবজ’ বলে উল্লেখ করে ‘এ বন বাঁচলে উপক’ল বাঁচবে’ বলে মন্তব্য করে ‘যেকোন উপায়ে তা রক্ষা সহ আরো সমৃদ্ধ কারার চেষ্টা চলছে’ বলেও জানান তিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।