Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মেগা প্রকল্পে মহাদুর্ভোগ

চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ধীরগতি সমন্বয়হীনতা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

বিপর্যস্ত প্রধান সড়কে স্থায়ী যানজট নর্দমায় মৃত্যুফাঁদ

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ধীরগতি আর সমন্বয়হীন খোঁড়াখুড়িতে প্রধান সড়কটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সড়ক, ফুটপাত, নালা, নর্দমা ভেঙ্গেচুড়ে একাকার হয়ে মৃত্যু ফাঁদ তৈরি হয়েছে। নিত্য যানজটে স্থবির চট্টগ্রাম বন্দর-ইপিজেড এলাকা। এতে সীমাহীন জনদুর্ভোগের সাথে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসাসহ সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে নেই কোন সমন্বয়। এরফলে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম নগরীর সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকায় নেয়া এ মেগা প্রকল্পটি এখন নগরবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাজে সম্ভুক গতি, দফায় দফায় নকশা বদলে বাড়ছে প্রকল্পের সময় ও ব্যয়। তাতে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পের মেয়াদ তৃতীয় দফায় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হলেও এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে কী না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। যদিও প্রকল্প পরিচালক দাবি করেন ইতোমধ্যে ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে বাকি কাজও শেষ করা যাবে। তবে এখনও বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং এবং দেওয়ান হাট থেকে লালখান বাজার অংশে ফাইলিং শুরু হয়নি। পতেঙ্গা থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত পিলারের কাজ শেষ হলেও গাডার বসেছে পতেঙ্গা থেকে স্টিলমিল বাজার পর্যন্ত।
বারিক বিল্ডিং থেকে আগ্রাবাদ হয়ে দেওয়ান হাট অংশে ফাইলিং চলছে। প্রকল্পের নকশা নিয়ে বন্দরের সাথে সমঝোতা হলেও আপত্তি দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি লাগোয়া টাইগার পাস পাহাড় ও সবুজ প্রকৃতি সুরক্ষায় এক্সপ্রেসওয়ে লালখান বাজারের বদলে দেওয়ানহাট পর্যন্ত করার প্রস্তাব দিয়ে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী সিডিএকে চিঠি দিয়েছেন। এখনও সেই চিঠির ব্যাপারে কোন সাড়া দেয়নি সিডিএ। তবে প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।

বিগত ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগেই শুরু হয় ফাইলিংয়ের কাজ। সেই থেকে নগরীর প্রধান সড়কের ওই ১৬ কিলোমিটার অংশের মেরামত, সংস্কারসহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিডিএর। তবে একদিকে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি অন্যদিকে সংস্কারের অভাবে সড়কের বিরাট অংশ এখন যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দেওয়ানহাট থেকে বারিক বিল্ডিং এবং সল্টগোলা থেকে ইপিজেড মোড় হয়ে বন্দরটিলা অংশের অবস্থা বেশি নাজুক। ওই এলাকার ফুটপাত, নালা, নর্দমা ভেঙে গেছে। আশপাশের ভবনের নালা, নর্দমার পানি সড়কে জমে যাচ্ছে। ভারী যানবাহনের চাকায় ডুবে থাকা সড়ক খালের আকার ধারণ করেছে। কাদায় সয়লাব আশপাশের দোকানপাট, বাড়িঘর। নালা, নর্দমা একাকার হয়ে যাওয়ায় ঘটছে দুর্ঘটনা।

কয়েক দিন আগে আগ্রাবাদে এমন একটি নর্দমায় পড়ে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়া মারা যান। এই ঘটনার পর সড়কটি সংস্কার না করায় সিটি মেয়র এম রেজাউলি করিম চৌধুরী সাদিয়ার মৃত্যুর জন্য সিডিএকে দায়ী করেন। সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ জবাবে বলেন, সিডিএকে দোষারোপ করা ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের কোন কাজ নেই। সাবেক সিটি প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, টেন্ডারের কার্যাদেশ অনুযায়ী সড়কে ওই ১৬ কিলোমিটার অংশের সংস্কারের দায়িত্ব সিডিএর। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স সড়ক সংস্কার না করে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।

সড়কের দুই পাশে বড় বড় গর্ত। এসব গর্তে আটকা পড়ছে যানবাহনের চাকা। এতে নিত্য যানজট হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের হিসাবে সড়কের ওই অংশে দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে। যার ৮০ ভাগই আমদানি-রফতানি পণ্য ও কন্টেইনারবাহী ভারী যানবাহন। সড়কের বেহাল দশার কারণে ওই এলাকায় যানজট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। আধা ঘণ্টার সড়ক পাড়ি দিতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক (বন্দর) শাকিলা সুলতানা বলেন, কাটগড় থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিয়মিত সংস্কারের অভাবে সড়কটির দুইপাশ যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাতে ভারী যানবাহন আটকে তীব্র যানজট হচ্ছে। বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং অংশে কাজ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে আবারও এক্সপ্রেসওয়ের নকশা বদলের দাবি উঠেছে। লালখান বাজারের বদলে দেওয়ানহাটে এক্সপ্রেসওয়ে শেষ করার দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন রাস্তায় নেমেছে। সিটি কর্পোরেশন, সচেতন নাগরিক সমাজ এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি টাইগারপাস হয়ে লালখান বাজার পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য পাহাড় এবং গাছপালা কাটা পড়বে। আর তাতে ওই এলাকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হবে। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নেতা প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন, টাইগারপাস সড়কে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে শুধু পাহাড় আর প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হবে তা নয়, এক্সপ্রেসওয়েও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার ও ওভারপাসের উপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে আনতে হলে এর উচ্চতা ৮০ ফুট করতে হবে। ১৬ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের শেষ প্রান্তে এসে উচ্চতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়বে।

বারবার নকশা বদলের ফলে এক্সপ্রেসওয়ের মান নিয়ে সংশয় দেখা দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্প প্রণয়নের সময় সংশ্লিষ্টদের সাথে সমন্বয় না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় এবং ব্যয় দুটোই বাড়ছে। অপরদিকে প্রকল্পের সুফল নিয়েও সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন রয়েছে। বলা হচ্ছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগামী কিছু যাত্রী এর সুফল পাবে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর অন্য কটি ফ্লাইওভারের মত এ ফ্লাইওভারেও গণপরিবহন চলাচল করবে না। ফলে ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। যে ধীরগতিতে কাজ চলছে তাতে এর সুফল কবে মিলবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

তবে প্রকল্পের পরিচালক সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ করা যাবে। বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত অংশে আগামী সপ্তাহে এবং দেওয়ানহাট থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত অংশে আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে ফাইলিং শুরু হবে। সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাব গ্রহণের সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আগের নকশা অনুযায়ী লালখান বাজারেই এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হবে। তবে টাইগারপাসের পাহাড় এবং গাছপালার সুরক্ষা করা হবে। ফ্লাইওভারে পর্যাপ্ত র‌্যাম্প থাকবে, ফলে সব ধরনের যানবাহন ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করতে পারবে। প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়বে বলেও জানান তিনি।

মহানগরীর অব্যাহত যানজট কমাতে এবং কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সাথে বন্দরনগরীর সংযোগ তৈরি করতে এ প্রকল্পটি নেয়া হয়। একইসাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সিটি আউটার রিং রোড হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং অদূর ভবিষ্যতে মীরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভওয়ের সাথে সংযুক্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম সফরকালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ঘোষণা দেন। এরপর ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় তিন হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এ প্রকল্প যখন অনুমোদন পায়। তখন তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেগা প্রকল্প

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০
১৭ মার্চ, ২০১৭
১ জানুয়ারি, ২০১৭
২১ ডিসেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ