Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার সহ সারা দেশে ইলিশ আহরণ পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২১, ৭:৫১ পিএম

প্রজনন নির্বিঘ্নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রোববার মধ্যরাত থেকে ২২ দিনের জন্য দেশের উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ এবং অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে ইলিশ আহরন সহ সারাদেশে পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। এরফলে চলতি অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন আরো অন্তত ২৫ হাজার টন বৃদ্ধির আশা করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্য বিজ্ঞানীগন।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ইতোপূর্বে আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পরের ২২ দিন এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রজনন সময় কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে এসময় কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সারাদেশের মত দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলভাগে পুলিশ, র‌্যাব, কোষ্টগার্ড এবং বাংলাদেশ নৌ বাহিনী অভ্যন্তরীন ও উপকূলীয় নদ-নদী সহ উপকূলভাগে নজরদারী জোরদার করছে। এ লক্ষ্যে বিভাগ থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে।
টানা ২২ দিন ইলিশ আহরণে বিরত বিশাল জেলে সম্প্রদায়ের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে ২০ কেজি করে চালও প্রদান করা হচ্ছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের সাড়ে ৩ লাখ জেলের মধ্যে ৩ লাখ ৭ হাজার ১২৪ জনকে প্রায় ৭ হাজার টন চাল বিতরন করা হবে আগামী সপ্তাহেই।
আশ্বিনের ভরা মৌসুমে ভোলার পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্ট-তজুমদ্দিন, মনপুরা দ্বীপ, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট-এর ধলচর দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ ও কালিরচর দ্বীপ, মায়ানী পয়েন্ট-মিরসরাই ছাড়াও কুতুবদিয়া পয়েন্ট এলাকায় মা ইলিশের অত্যাধিক প্রাচুর্য থাকায় ঐসব এলাকার ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে আগামি ২২ দিনের জন্য সবধরনের মৎস্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকছে ।
‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ এর আওতায় ২০০৫ সালেই প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিন ও ২০১৬ সালে থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়েছে। ইলিশ নিয়ে নানামুখী বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন এক সময়ের ১.৯৮ লাখ টন থেকে বর্তমানে সাড়ে ৫ লাখ টনের ওপরে উন্নীত হয়েছে। এমনকি সারা বিশে^র ৬০%-এরও বেশী ইলিশ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এর বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২.৫০%।
প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়ান করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে, তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করতে ২০১৯-এর ২৬ জুন হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮-এর ৭-২৮ অক্টোবর আহরণ বন্ধ থাকাকালে উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পায়। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মতে প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ২০১৭ সালে ৭৩% থেকে ’১৮ সালে ৯৩%-এ উন্নীত হয়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০%-উন্নীত হয়। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের ফলে ঐ সময়ে দেশে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি উৎপাদিত ডিমের ৫০%-এর সাফল্যজনক পরিস্ফুটন সহ তার ১০% বেঁচে থাকলেও ইলিশ পরিবারে নতুন ৩ হাজার কোটি জাটকা যুক্ত হয়।
এমনকি ২০১৯ সালে মূল প্রজননকালীন সময়ে দেশের প্রধান ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র সমূহে পরিক্ষামূলক নমুনায়নে ৮৩% ইলিশের রেনু পাওয়া গিয়েছিল। সেসময়ে ঐসব এলাকায় ১৭% অন্যান্য মাছের রেনুও পোনা পাওয়া যায়। ফলে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন ২২ দিনে উপকূলে অন্যান্য মাছেরও নিরাপদ প্রজনন সাফল্যজনকভাবে স¤পন্ন হচ্ছে। যা দেশে অন্যান্য প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
আগামী ২২ দিন সারা আহরণ ও বিপন্ন নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশের সব ইলিশ মোকাম ছাড়াও বাজার এবং আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কেও আইন-শৃংখলা বাহিনী নজরদারী সহ অভিযান পরিচালনার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ