Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ওরা দুজন বরখাস্ত

ইনকিলাবে ‘করোনা টেস্টে তুঘলকি’ খবর প্রকাশ সিণ্ডিকেটের মূল হোতারা এখনো পর্দার আড়ালে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০১ এএম

অবশেষে বরখাস্ত হলেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের আলোচিত ওই দুই কর্মচারী। নিম্নস্তরের কর্মচারী হওয়ার পরও করোনা টেন্টের নামে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন অর্থ। এই করোনার ভুয়া টেস্ট সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে ২০২০ সারের ২৭ ডিসেম্বর ইনকিলাবে ‘করোনা টেস্টে তুগলকি’ শিরোনামে খবর প্রচার হয়। অতপর সত্যিই শিশু হাসপাতালে শুরু হয় তোলপাড়। হাসপাতালের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। অভিযুক্ত কিংকর ঘোষ ও আতিকুল ইসলাম রাজুর কাছে প্রশাসনিক ভাবে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে বার্থ হওয়ায় তাদের বরখাস্ত করা হয়। যদিও এখনো করোনার ভুয়া সেন্টের সিণ্ডিকেটের মূল হোতারা এখনো পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছেন।

বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে শিশু হাসপাতালের চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আরটিপিসিআর ল্যাবে ফ্রি টেস্ট করিয়ে অবৈধভাবে ৫ হাজার টাকা আদায় করা চক্রের দু’জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এই দু’জন হলেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের এই রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ এবং জুনিয়র অফিসার আতিকুল ইসলাম রাজু। তবে এখনো ধরাছোয়ার বাইরে এই চক্রের মূল হোতারা।

সূত্র মতে, ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা শিশু হাসপাতালে আবারও চাঞ্চল্যকর অনিয়ম ‘করোনা টেস্টে তুঘলকি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রশাসন। প্রথমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনিয়মের বিষয়ে দু’জনের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে আতিকুল ইসলাম রাজু গত ৫ জানুয়ারি এবং কিংকর ঘোষ ৬ জানুয়ারি ব্যাখ্যার জবাব দেয়। কিন্তু তাদের জবাব প্রশাসনের নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে দু’জনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত করোনা পরীক্ষার অনিয়মে জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্ত কমিটির কাছে সঠিকভাবে প্রতীয়মান হয়। পরে কমিটির প্রতিবেদন গত ৬ মার্চ শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ৩৭৮ তম সভায় উপস্থাপন করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে বোর্ড দু’জনকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়। পরে দু’জনের আত্মপক্ষ সমর্থনের জবাব ব্যবস্থাপনা বোর্ডের গত ১১ মে অনুষ্ঠিত ৩৭৯ তম সভায় উপস্থাপন করা হয়। এ সভায় বোর্ড আরও অধিকতর তদন্তের জন্য ১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। অধিকতর তদন্ত শেষে গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ৩৮১ তম সভায় তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।

প্রতিবেদনে করোনা আরটিপিসিআর টেস্ট বাবদ অতিরিক্ত টাকা গ্রহণে দু’জনের সংশ্লিষ্টতা প্রমান পায়। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে এ ধরণের কর্মকান্ডে হাসপাতালের সুনাম দারুনভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। যা ঢাকা শিশু হাসপাতাল চাকরি ও নিয়োগ বিধিমালার পরিপন্থী হওয়ায় দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ঢাকা শিশু হাসপাতাল চাকরি ও নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা (গুরুদন্ড) প্রদানে বোর্ড সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ এবং জুনিয়র অফিসার আতিকুল ইসলাম রাজুকে ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

সূত্র মতে, পদ্মা মেডিক্যাল, জিকেজিসহ বিভিন্ন হাসপাতালের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে শিশু হাসপাতালের আওতাধীন চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আরটিপিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা করিয়ে অবৈধভাবে ৫ হাজার টাকা আদায় করতো শিশু হাসপাতালের এই চক্র। শিশু হাসপাতালের এই আরটিপিসিআর ল্যাবের টেস্টের দায়িত্বে ছিলেন রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ। এই চক্রের হোতা হিসেবেও কাজ করেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের এই রোগতত্ত্ববিদ এবং জুনিয়র অফিসার আতিকুল ইসলাম রাজু। টেস্ট প্রতি ৩৫শ’ টাকা আদায় করছেন দু’জনে। আর এই টাকা ভাগাভাগি করা হয়েছে কিংকর ঘোষ ২৫শ’ এবং আতিকুল ইসলাম রাজু ১ হাজার টাকা এভাবে। আর বাকি ১৫শ’ টাকা পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টার বা অন্যান্য হাসপাতাল নিয়েছে। তবে এই চক্রটি শুধু পদ্মা মেডিক্যাল সেন্টারই নয়, বহুল আলোচিত করোনা টেস্ট কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত জিকেজি গ্রুপেরও নমুনা পরীক্ষা করিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ বাণিজ্য করেছেন।

এদিকে করোনা টেস্টের নামে বড় অঙ্কের বাণিজ্য করা কিংকর ঘোষ ও আতিকুল ইসলাম রাজু ফাঁসলেও ধরাছোয়ার বাইরে সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা। সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের মালিক বর্তমান সংসদ সদস্য ও শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আব্দুল আজিজ। যিনি শিশু হাসপাতালের পরিচালক থাকাকালে অনিয়মের মাধ্যমে এই দুজনকে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়েছেন। আর যে কারণে তাদের দু’জনই বাধ্য করিয়েছেন এসব অনিয়ম করতে।

কিংকর ঘোষ : শিশু হাসপাতালে যার নিয়োগই সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে। ২০১৮ সালের ৬ মে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে নোট অনুমোদনপূর্বক পরিচালক ও উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) একই বছরের ১৫ মে অবৈধভাবে ৭ম গ্রেডে এডহক ভিত্তিতে এক বছরের জন্য নিযোগ দেয়। প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তাকে এভাবে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ পরিচালকের নেই। ওই সময়ে হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন ডা. আব্দুল আজিজ, উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. তৈয়ব এবং সহকারী পরিচালক ছিলেন ডা. আইয়ুব আলী। অরগানোগ্রাম জালিয়াতি করে কিংকর ঘোষকে ওই সময়ে নিয়োগ দেয়া হয়।

২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় নোটের মাধ্যমে অনুমোদন করে ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজকাল ও বাংলাদেশ টুডে পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। যা পরের মাসে অর্থাৎ ১৭ অক্টোবরে নির্বাচন সংক্রান্ত কমিটি-১ এর মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে পরবর্তী মাস নভেম্বরের ২৪ তারিখের ৩৫৬তম সভায় কিংকর ঘোষকে চাকরিতে নিয়মিত করা হয়। এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ই শুধু অনিয়ম নয়; এই পদে চাকরি নিয়েও রয়েছে সমস্যা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মূলত: এই পদটি ছিল চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ। তৎকালীন পরিচালক বড় অঙ্কের বাণিজ্যের মাধ্যমে অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে ৭ম গ্রেডে তাকে নিয়োগ দেয়। এছাড়াও কিংকর ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার সাবেক কর্মস্থল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের জয়পুরহাট কেন্দ্র থেকে অনিয়মের কারণে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। সে সব তথ্যও ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।
মো. আতিকুল ইসলাম রাজু : ২০১৪ সালের ২২মে শিশু হাসপাতালে প্রকল্পে কম্পিউটার অপারেটর পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তী মাস জুনের ১ তারিখে তিনি শিশু হাসপাতালে যোগ দেন। পরে ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ সালে যথাক্রমে এক বছর করে চাকরি বৃদ্ধি করা হয়। এক বছর পর স্থায়ী হওয়ার কথা থাকলেও তার কাজে সন্তুষ্ট না হওয়ায় বছর শেষে প্রতিবার ১ বছর করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়। যদিও পরবর্তীতে কোন ধরণের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মো. আতিকুল ইসলাম রাজুর চাকরি রাজস্ব বিভাগে নিয়মিত করা হয়।

রাজুর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এক পর্যায়ে হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগে বদলি করা হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালের পরিচালক (মামা) সংসদ সদস্য হলে বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর পরিচালক নোট অনুমোদন করে পরের দিন ১১ অক্টোবর আরও দু’জন সিনিয়র সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটরকে ডিঙ্গিয়ে তাকে জুনিয়র অফিসার (এডমিন) হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. শফি আহমেদ মুয়াজ ইনকিলাবকে বলেন, শিশু হাসপাতালের রোগীদের নমুনা নেয়ার জন্য চাইল্ড হেলথ্ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কিংকর ঘোষকে। কিন্তু দায়িত্বের আড়ালে করোনা আরটিপিসিআর টেস্ট বাবদ অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করে হাসপাতালের চাকরি ও নিয়োগ বিধিমালার পরিপন্থী কাজ করেছে। এ ধরণের কর্মকান্ডে হাসপাতালের সুনাম দারুনভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে তাই গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যবস্থাপনা বোর্ডের ৩৮১ তম সভায় সর্বসম্মতভাবে ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে তাদেরকে হাসপাতালের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ