Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হজরত শাহ জালাল (রাহ:) এর জীবনী: {১২৭১-১৩৪১}

সৈয়দ আহমাদ উল্লাহ কামালী | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

শেখ বুরহানুদ্দিন এর সাথে সাক্ষাত: উল্লেখ্য যে, শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে শ্রীহট্টে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠে ছিল। সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে তৎকালে মুসলমানরা বসতি গড়েছিলেন। এ সময় শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে গৌড়-গোবিন্দ নামে এক রাজা ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান (হিন্দুরাজ্যে বসবাসকালে) নিজ ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে গোবিন্দ রাজা বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে এরূপ মত প্রচলিত আছে।

বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের অভিযোগ করলে রাজা তার ভাগিনেয় সিকান্দর গাজীকে প্রকান্ড সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দের সেনারা বীরত্বের সাথে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। গোবিন্দের শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে সম্রাট তার রাজ দরবারী আলেম-উলামা সহ জ্যোতিষিদের সাথে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, গৌড় গোবিন্দ জাদুশক্তির সাহায্যে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। জ্যোতিষিদের মতে সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তার নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় করা সম্ভব হবে।

জ্যোতিষিরা উক্ত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলে ছিল, আগামী দুই/এক রাত্রের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির বিষম ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথাও কোন প্রদীপ থাকবে না। একটি মাত্র তাবু ব্যতীত। সম্রাট জ্যোতিষিদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে পেলেন একজন সাধারণ সৈনিক একটি তাঁবুতে একাগ্র মনে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি ছিলেন হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দীন সিপাহসালার। সম্রাটের আদেশে সম্মত হলে সম্রাট তাকে সিপাহসালার সনদের সাথে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় হযরত শাহ জালাল (রাহ:)ও উনার সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। ঐতিহাসিক আজহার উদ্দীন ধারনা করে দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী উনার নিকট বর্ণনা করেন ।

নাসির উদ্দিন সিপাহসালার এর সাথে সাক্ষাত: হযরত শাহ জালাল (রাহ:) দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনকে সহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন হযরত শাহ জালাল (রাহ:) সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ হযরত শাহ জালাল (রাহ:) নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাত ও ব্রহ্মপুত্র নদী পার হওয়া: হযরত শাহ জালাল (রাহ:) সোনারগাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটিল। সিকান্দর গাজী হযরত শাহ জালাল (রাহ:) কে সসম্মানে গ্রহণ করলেন। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) তার সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যগ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। এদিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজস্ব গুপ্তচর দ্বারা হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর সমাগম সংবাদ পেয়ে এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন।

সিলেটে প্রবেশ: খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্টভূমি লাউড় জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। উক্ত রাজ্য গুলোর মধ্যে গৌড় অন্যতম রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমা রেখা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলা সহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে বিস্তৃত থাকায় গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমাভূমি নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) উনার সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নিবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়; কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) পূর্বের মতো জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রিযাপন করেন। উল্লিখিত তথ্য-সংবলিত প্রাচীন গ্রন্থ তাওরিখে জালালীতে উল্লেখ আছে:

সর্ব প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড়গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফলে হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে যাদুমন্ত্রসহ এক প্রকান্ড লৌহধনুক হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর কাছে প্রেরণ করে; যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) উনার দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাযা হয়নি বা বাদ পড়েনি একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুকজ্যাগ্ধ করতে। অত:পর মুসলিম সৈন্যদলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন।
সুরমা নদী পার হওয়া: উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে ধর্তব্য এ নদীগুলো প্রাচীন কালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাতো। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সুরমা নদীকে নহরি আজরফ বলে আখ্যায়িত করেছেন । হযরত শাহ জালাল (রাহ:) ফতেহপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন, এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর কারামতি ও অলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্তে¡ও হযরত শাহ জালাল (রাহ:) নদী পার হন।

হযরত শাহ জালাল (রাহ:) বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে অনায়াসে নদীর ওপারে চলে গেলেন।

গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্তগিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়ি প্রথমে দখল করেন।

সিলেটে প্রথম আযান: সিলেট শহরে সর্বপ্রথম হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর আদেশে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালার (রাহ:) আজান দেন।

গৌড়গোবিন্দের আত্মগোপন: গৌরগোবিন্দের মুসলিম নির্যাতনের কথা জানতে পেরে বাংলার তৎকালীন সুলতান ফিরুজ শাহ গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলে ফিরুজ শাহ সিকান্দার শাহের সহযোগিতা নিয়ে নাসির উদ্দীন নামের একজন সেনাপতিকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সময় হযরত শাহ জালাল (রাহ:) তার সেনাবাহিনীসহ সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছিলেন। এই উভয় বাহিনী হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর নেতৃত্বে গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এই খবর শুনে গৌরগোবিন্দ পলায়ন করেন।

লেখক : কর্মরত-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হজরত শাহ জালাল (রাহ:) এর জীবনী: {১২৭১-১৩৪১}
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ