Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন কৃষক

বন্যায় উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলের ক্ষতি বানের পানি নেমে যাওয়ায় শুরু হয়েছে নতুন করে চাষাবাদ  বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল ফলানোর চেষ্টা  পানিতে ভেসে আসা

রফিক মুহাম্মদ/মহসিন রাজু | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

দেশ এগিয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূণতা অর্জনের মূলেই রয়েছেন গ্রামের কৃষক। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন যত বারই দুর্যোগে পড়েছেন; পরক্ষণেই স্বউদ্যোগে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ ও গজলডোবা বাঁধের সবগুলো কপাট খুলে দেয়ায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। বন্যায় লাখ লাখ কৃষকের জমির ফসল নষ্ট হয়। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল দুমড়ে-মুচড়ে গেছে বানের পানিতে। বানের পানি অনেক জমিতে ফলি ফেলে গেছে। সেগুলো জমির উর্বরতা বাড়াবে। পানি চলে যাওয়ায় কৃষকরা আবার ও কোমড় বেঁধে মাঠে নেমেছেন। বন্যায় বিধ্বস্ত জমিতে আবার ফসল ফলানোর লক্ষ্যে লাঙল-জোয়াল দিয়ে জমি চাষ করছেন; কেউ নতুন ধানের চারা রোপণ করছেন। ধান ছাড়াও কেউ কেউ বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে বাদাম ও সবজি চাষ করছেন। রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, নিলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা, তিস্তাবদৌত বিস্তীর্ণ এলাকায় একই দৃশ্য। ছোট-বড় সব শ্রেণির কৃষক জমিতে নতুন করে ফসল ফলানোর মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ যেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোনো নগরীকে পুনঃনির্মাণের প্রাণান্তকর চেষ্টা। যুদ্ধে বিধ্বস্ত হলে কোনো শহরকে যেমন নতুন করে গড়তে কর্মযজ্ঞ করতে হয়; কৃষকরা সে রকম চেষ্টাই করছেন। আবার ফসল ফলানোর চেষ্টায় লাখ লাখ কৃষক এখন মাঠে।

বৃষ্টিপাত ও ভারতের ঢল কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। ফলে কমতে শুরু করেছে ছোটবড় সব নদনদীর পানি। উত্তরাঞ্চলের বড় নদ নদীর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, বাঙালি, করতোয়া এসব নদীর পানি প্রবাহ এখন স্বাভাবিক, বইছে বিপদসীমার নিচে। এতে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে বিভিন্ন চরাঞ্চল। জেগে উঠছে নদী তীরবর্তী পলিপড়া ফসলি জমি। আর এরই সাথে নতুন উদ্যোমে জেগে উঠছেন চাষিরা। এক মুহূর্ত অপেক্ষায় না থেকে, সরকারি প্রণোদনার দিকে না তাকিয়ে, তারা লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে কিংবা কলের লাঙল (ট্রাক্টর) নিয়ে নেমে পড়েছেন আবাদি জমিতে। রীতিমত শুরু হয়েছে চাষাবাদের ধুম।

বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমিতে আবারও ধানের চারা লাগাচ্ছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা। প্রস্তুত করছেন জমি। তৈরি করা হচ্ছে বীজতলা। অনেকে আবার আগাম জাতের সবজি চাষ করছেন। বলা যায় বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন আশা ও উদ্দীপনায় কৃষকরা চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এ বছরও ১৫ দিনের বেশি সময় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল দেশের ১৫টি জেলার বিস্তৃীর্ণ অঞ্চল। এতে আমন ধান ও বিভিন্ন সবজির ক্ষতি হয়েছে। তবে বন্যা যেমন ক্ষতি করে, তেমনি তা কৃষকের জন্য অনেকটা আশীর্বাদও বয়ে নিয়ে আসে। কৃষিবিদের মতে, বন্যার পানিতে ভেসে আসা পলিতে জমির উর্ব্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এতে পরবর্তী ফলন অনেক ভালো হয়।

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. এম আবদুল করিম এ বিষয়ে বলেন, দেখা গেছে, যে বছর বন্যার প্রকোপ বেশি হয়, সে বছর রবি মৌসুমের (শীতকালীন) ফসলের ফলন ভালো হয়। এর কারণ হলো বন্যার মাত্রা বেশি হলে হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এসব পলিতে গাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্যোপাদান থাকে। তাছাড়া বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয়, সেসব জমিতে কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য যেমনÑ গম, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে পারে। এ ছাড়া আগাম সবজি চাষেও ভালো ফলন হয়। এতে কৃষক অনেক লাভবান হয়। আবার আগস্ট মাসের পর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে বন্যার পানি নেমে গেলে আমন ধান নষ্ট হলেও পলি পরা জমিতে নতুন ভাবে চারা রোপণ করে কৃষক বাম্পার ফলন পান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের কুড়িগাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে গাইবান্ধা, বগুড়া হয়ে সিরাজগঞ্জের নলকা পর্যন্ত এলকায় ব্রহ্মপুত্র যমুনা অববাহিকায় পলি পড়া নিচু জমিতে লাগানো হচ্ছে রোপা আমন, গাইঞ্জা এবং বোনা আমন প্রজাতির ধান। এ ছাড়া অনেকে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষও শুরু করেছেন।
তিস্তা-ধরলার জেগে ওঠা চরে লাগানো হচ্ছে শীত মৌসুমের আগাম জাতের সবজি ও বাদাম। পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের চলনবিল এলাকায় বন্যা সহায়ক বিশেষ প্রজাতির ধান চাষ হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এই ধানের বৈশিষ্ট্য হলো কোন কারণে জমিতে পানি প্রবেশ করলে পানি যত বাড়ে পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ধানের গাছও ততো বাড়ে। ফলে চাষিদের বন্যা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হয় না। চলন বিল অঞ্চলের চাষিরা প্রায় দেড় দশক ধরে আমন, আউশ ও বোরো মৌশুমে ধান উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা রাখছে।

চলতি বছরে সিংড়া অঞ্চলে কিছু এনজিওর পৃষ্ঠপোষকতায় চাষিরা গ্রিন হাউজ তৈরি করে সারা বছর শীতকালীন সবজি টমেটো, গাজর, কফি ইত্যাদি উৎপাদন করছেন। নাটোরের সিংড়া এবং বগুড়ার নন্দীগ্রামের অংশবিশেষে বর্তমানে বন্যা পরবর্তী ফসল উৎপাদনে অসাধারণ অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে।
গত (শনিবার) বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ি, ভান্ডার বাড়ি গ্রামে যমুনা তীরের প্রান্তিক চাষি জিয়াউল আলম জানান, পানি নাইমা গেছেগা, তাই দেরি করিন্যাই , মাসকালাই ব্যুনা দিসি। বাকিডা আল্লাহ ভরসা। সরকারি কৃষি প্রণোদনার ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেম্বার নাম তো লিস্টি করসে। কিসুতো পামু। কিন্তু কবে পামু সেই আশায় সময় নস্ট কর‌্যা লাভ কি?’

প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এবং চাষি পর্যায়ে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউই আর ফসল চাষে সময় ক্ষেপণ করতে রাজি নয়। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, ধুনট উপজেলা প্রশাসনে খবর নিয়ে জানা গেছে, বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে চাষিরা যাতে নতুন করে আমনসহ মৌসুমি ফসল ও আগাম শীতকালীন সবজি চাষে মনোযোগী হতে পারে তার সব ব্যবস্থাই রয়েছে।

বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি হিসেবে দেখা গেছে, এখন প্রতিবছর বগুড়ার যমুনার চরাঞ্চলেই প্রতিবছর ৮শ’ কোটি টাকার পাট, আখ, ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, বাদাম, কাউন ও মরিচের উৎপাদন হয়। এর অর্ধেকই হয় মূলত বন্যা পরবর্তী শরৎকালীন সময়ে। কৃষি বিভাগের মতে, এক দশক আগেও এই অঞ্চলে কৃষির এই চিত্র ছিল না। অতীতে দেখা গেছে, চাষিরা বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষি প্রণোদনার অর্থ ও ফসলের বীজ জমিতে না লাগিয়ে অলস সময় পার করত। এখন বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত ফসল সারাে দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকায় চাষিরা এখন প্রণোদনার আশায় বসে থাকে না। তারা সবসময় আগাম চিন্তা করে যেকোনো মৌসুমি ফসলের আগাম উৎপাদনে আগ্রহী হয় বেশি বলে জানায় বগুড়ার কৃষি বিভাগ।

বগুড়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, চলতি বছর আর কোনো বন্যার সতর্কবার্তা নেই। গরমের কারণে হিমালয়ে বরফগলা পানির প্রবাহ বা শরতের শেষে দুয়েক দফা ভারী বর্ষণ হলেও ফসলহানির মতো বন্যার আশঙ্কা আর তেমন নেই। এটা উত্তরের কৃষির জন্য সুখবর বলেই তারা মনে করছেন।



 

Show all comments
  • Md Robin Khan ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৫ এএম says : 0
    অসাধারণ প্রিয় মাতৃভূমি
    Total Reply(0) Reply
  • Jashim Uddin ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৫ এএম says : 0
    আসসালামু আলাইকুম আলহামদুলিল্লাহ সকল প্রসংশা আল্লাহর যিনি আরেকটা নতুন সকাল দেখার তৌফিক দিয়েছেন
    Total Reply(0) Reply
  • Nur Hossain ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৫ এএম says : 0
    we eat the corn which is produced by hard labour of the farmers
    Total Reply(0) Reply
  • Sohanur Sohan ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৬ এএম says : 0
    প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সত্যি খুব ভালো লাগছে
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shaien ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৬ এএম says : 0
    আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাশি
    Total Reply(0) Reply
  • সোয়েব আহমেদ ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৬ এএম says : 0
    এই কৃষক না থাকলে হয়তো আমাদেরকে না খেয়ে মরতে হতো। অভিবাদন।
    Total Reply(0) Reply
  • Sifatullah Galib ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৬ এএম says : 0
    মনটা ভরে যায়,গ্রাম বাংলার এমন অপরূপ দৃশ্য দেখে
    Total Reply(0) Reply
  • Md Jahangir Hossain ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৭ এএম says : 0
    সফল হোক এই সব শ্রমজীবী মানুষের।যারা অন্যের মুখে অন্ন দেওয়ার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।হাজার সালাম জানায় এই সব মানুষদের
    Total Reply(0) Reply
  • Mahabur ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৯ এএম says : 0
    আলু রপ্তানিতে আশার আলো দেখছেন পারে সরকারি ভাবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ