দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি ও দরবেশ হযরত শেখ শাহজালাল মুজার্রাদ ইয়ামনী (রাহ:)। উনার পুরো নাম শেখ শাহ জালাল, কুনিয়াত মুজাররাদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টীয় সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে, তদুপরি হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত ফার্সি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। ফার্সি ভাষায় লিখিত ফলক-লিপি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সিলেটে উনার মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। সিলেট বিজয়ের পরে শাহ জালাল (রাহ:) এর সঙ্গী-অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর-দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
প্রাথমিক জীবন:
হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরায়েশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর পিতার নাম মুহাম্মদ বা মাহমুদ। উনার দাদার নাম ইব্রাহিম।
হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর মাজারে প্রাপ্ত ফলক-লিপি সুহেলি ইয়ামনী অনুসারে, হযরত শাহ জালাল (রাহ:) ৩২ বছর বয়সে ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট আগমন করেন। সুহেলি ইয়ামনী-তে উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায় যে, ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে) হযরত শাহ জালাল (রাহ:) জন্মগ্রহণ করেছেন। উনার জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়ামেন দেশের কুনিয়া নামক শহরে। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) যখন তিন মাসের শিশুবালক, তখনই উনার মাতার ইন্তেকাল হয়।
হযরত শাহ জালাল (রাহ:) শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবির আরবী ভাষায় কোরআন-হাদিস শিক্ষা দেয়া সহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন। পরবর্তিতে আহমদ কবীর হয়রত শাহ জালাল (রাহ:) কে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হুজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সাথে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) কেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।
শিক্ষক পরিচিতি:
হযরত শাহ জালাল (রাহ:)-এর মামা ও শিক্ষাগুরু শায়েখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি, সাধারণত; আহমদ কবির নামে তিনি বহুল পরিচিত। সৈয়দ আহমদ কবিরের পিতার নাম সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী। সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী হযরত শাহ জালাল (রাহ:) জন্মগ্রহণ করার আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের লক্ষে মোলতানের নিকট আউচে এসে বসবাস করেন এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দির পিতা সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী ছিলেন তার পীর ও মুরশীদ।
হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর পীরদের ঊর্ধ:স্তন পীরগণের তালিকা নিম্নরূপ-
১. হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
২. হযরত আলী (রা:)
৩. শেখ হাসান বসরী (রাহ:)
৪. শেখ হবিব আজমী (রাহ:)
৫. শেখ মারুফ কর্খী (রাহ:)
৬. শেখ সিংরি সুকতি (রাহ:)
৭. শেখ মমশাদ সিকন্দরী (রাহ:)
৮. শেখ আহমদ দিন্নুরী (রাহ:)
৯. শেখ আমুবিয়া (রাহ:)
১০. শেখ আজি উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রাহ:)
১১. শেখ আবু নজিব জিয়াউদ্দিন (রাহ:)
১২. শেখ হিসাব উদ্দীন (রাহ:)
১৩. শেখ মাখদুম (রাহ:)
১৪. শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (রাহ:)
১৫. সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী (রাহ:)
১৬. সৈয়দ শায়েখ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি (রাহ:)
১৭. হযরত শাহ জালাল (রাহ:)
আধ্যাত্মিকতা: হযরত শাহ জালাল (রাহ:) কে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই আহমদ কবিরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে জানা যায়, যে কারণে আহমদ কবির হযরত শাহ জালাল (রাহ:) কে নিয়ে মক্কায় আসেন। মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত খানকায় (মরমী স্কুল) তৎকালে আহমদ কবির ছিলেন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। আহমদ কবির শাহ জালাল (রাহ:) কে ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয়ধারায় শিক্ষাদানে দীক্ষিত করেন।
দরবেশী জীবন: জন্মগতভাবে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) দরবেশ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। জানা যায়, উনার পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ, ইয়ামনে ধর্ম যুদ্ধে তিনি শহিদ হন এবং উনার মাতার দিক দিয়ে তিনি সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন। তদুপরি দরবেশ আহমদ কবির উনার মামা, যাঁকে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর শিক্ষা গুরু হিসেবে পাওয়া যায়। তিনিও তৎকালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। আহমদ কবির যখন হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন সেই ছোটবেলা থেকেই উনাকে দরবেশী তর্জ-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালী শিক্ষা দিয়েছেন বলেও পাওয়া যায়।
সিলেটে আগমন: হযরত শাহ জালাল (রাহ:) উনার মামা ও শিক্ষাগুরু সৈয়দ আহমদ কবিরের আস্তানায় আরব দেশে ছিলেন। হযরত শাহ জালাল (রাহ:) ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখার পরে সৈয়দ আহমদ কবির-এর কাছে ব্যক্ত করেন। মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে তা জানান। আহমদ কবির এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) কে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে আহমদ কবির হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেন: যে স্থানে এই মাটির স্বাদগ্ধ গন্ধগ্ধ ও বর্ণেরগ্ধ মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রাহ:) এর দোয়া নিয়ে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) ধর্মপ্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে একা-একাই যাত্রা শুরু করেন।
হিন্দুস্থানে প্রবেশ: হযরত শাহ জালাল (রাহ:) মক্কা হতে বিদায় কালে যে কয়েক জন সঙ্গী উনার সাথে যাত্রা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলীল, হাজী দরিয়া এবং আরেকজন সঙ্গী চাশনী পীর ছিলেন মৃত্তিকার তহবিলদার। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরকন্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজাম উদ্দীন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করলেন। এরপর পাঞ্জাবের মুলতান থেকে আরিফ, গুজরাট থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখ উনার মুরীদ হয়ে উনার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবে দিল্লী পর্যন্ত এসে পৌঁছালেন তখন শিষ্যদের সংখ্যা ২৪০ জন বলে ধারণা পাওয়া যায়।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ:) এর সাক্ষাত: দিল্লিতে আসার পর হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ:) এর জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর কুৎসা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ:) অন্যের কুৎসা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তিস্বরূপ দরবার থেকে তাড়িয়ে দেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর কাছে সালাম পাঠান । হযরত শাহ জালাল (রাহ:) সালামের উত্তরে উপঢৌকনস্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠান। নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহ জালাল (রাহ:) এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে উনাকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ:) উনাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর। যা জালালি কবুতর নামে খ্যাত। (চলবে)
লেখক : কর্মরত- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।