দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ইস্তেগফার বহুল প্রচলিত ও পরিচিত একটি আরবী শব্দ। পৃথিবীতে কোন ভাষাবাসি এমন কোন মুসলমান পাওয়া যাবে না, যে ইস্তেগফার শব্দটি জানে না বা শোনে নি। ইস্তেগফার এমন একটি শব্দ, যা শুনলে অপরাধীর মনে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠে। হৃদয়ের নিভে যাওয়া আলো আবার জ্বলে উঠে। দুঃখ ভারাক্রান্ত, চিন্তাক্লিষ্ট মন আনন্দে নেচে উঠে। হৃদয় গহীনে শান্তি ফল্গুধারা বইতে থাকে। এটি একটি শব্দ নয়, এটি যেন এক সঞ্জীবনী অমৃত সুধা, ব্যর্থ বা নষ্ট জীবনে সর্বোচ্চ সফলতা, ফেটে চৌচির মাঠে রহমতের বৃষ্টি।
ইস্তেগফার অর্থ ক্ষমা চাওয়া, আবৃত করা, ঢেকে দেওয়া ইত্যাদি। ইস্তেগফারের মাধ্যমে মাওলা তাঁর বান্দার পাপ সমূহ দুনিয়াতে ঢেকে দেন, পরকালে এই পাপের শাস্তি মওকুফ করে দেন। অন্য কথায় ইস্তেগফারের মাধ্যমে বান্দার পাপ সমূহ এমন ভাবে মুছে দেন, যেন তার কোন পাপই ছিল না। এমন কি পাপের সামান্য দাগও আর তার আমলনামায় অবশিষ্ট থাকে না। ইস্তেগফার এবং তাওবা প্রায় সমার্থক শব্দ। ইস্তেগফার অর্থ অতীতের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জিত হয়ে মহান রবের নিকট ক্ষমার কাকুতি মিনতি, আরজি পেশ করা, পাপের জন্য অন্তরের ব্যাথা অনুভব করা। আল্লাহর শান স্মরণ করে, তার অবাধ্যতার জন্য পেরেশানী বোধ করা। তাঁর শাস্তির ভয়ে হৃদয় প্রকম্পিত হওয়া আর তাওবা হলো ভবিষ্যতে তার দ্বারা মাওলার অবাধ্যতার কোন কাজ সংঘঠিত হবে না বলে দৃঢ় সংকল্প করা।
ইস্তেগফার এর মূল অক্ষর গাইন-ফা-রা গাফরু বা গুফরানুন এই মূল শব্দের সাথে সমন্ধযুক্ত শব্দ কোরআনুল কারিমের ২০২ আয়াতে মোট ২৩৪ বার মহান রব ব্যবহার করেছেন। এই আয়াতে কারীমাগুলোকে মহান রব কোথাও ইস্তেগফার করার জন্য বান্দাকে নির্দেশ দিয়েছেন, কোথাও ইস্তেগফারের গুরুত্ব, উপকারিতা আলোকপাত করেছেন, কোথাও তিনি ক্ষমা কারী, পাপ মোচন কারীরূপে নিজের গুনাবালী বর্ণনা করেছেন। মহান রর গাফেরুজ্জানব গুনাহ ক্ষমাকারী এর ব্যখ্যায় ইমাম গাজ্জালী রাহঃ বলেন, গাফ্ফার এমন সত্ত্বার নাম যিনি সুন্দরকে প্রকাশ করেন, মন্দ ও অসুন্দরকে ঢেকে দেন। পাপ সেই মন্দ সমূহের অন্তর্ভূক্ত পার্থিব জীবনে পর্দা ঝুলিয়ে আল্লাহ তা ঢেকে দেন এবং পরকালে তার শান্তি ক্ষমা করে দেন। ইমাম খাত্তাবী বলেন, গাফ্ফার এমন এক সত্ত্বা যিনি বার বার বান্দার পাপ রাশি ক্ষমা করে দেন। বান্দা যতবার গুনাহ হতে তওবা করে আল্লাহ তায়ালা তত বার পাপ ক্ষমা করতে থাকেন। গাফ্ফার সেই মাবুদের নাম যিনি তাঁর বান্দার পাপ সমূহ ঢেকে দেন এবং তার উপর তার দয়ার চাদর আবৃত করে দেন। দুনিয়ার মানুষের নিকট একবারের বেশি দুই বার, তিন বার অপরাধ করার পর আর ক্ষমা পাওয়ার আশা করা যায় না। তিনি এমন ক্ষমাকারী বার বার ক্ষমা করতেই থাকেন। বান্দা যতবার তার নিকট হাত পাতে, তত বার হাত ভরে তার চাওয়া পূরণ করেন। কিন্তু বিষয় হলো, আমার ইস্তেগফার এর মধ্যে মনের আকুতি, পাপের অনুতাপ, লজ্জা, প্রভুর শান ও মানের ভয়, ভালবাসা অনুপস্থিত থাকে। তখন এমন মনে হয়, রায়েবা বসরীর রাহঃ এর সামনে এক নওজোয়ান ইস্তেগফার পড়ছিল। তার চেহারায় মাওলার ভয় ভালবাসা পরিলক্ষিত হচ্ছিল না, ইস্তেগফারের দিকে তার মন নির্লিপ্ত ছিল। তখন রাবেয়া বসরী বলেছিলেন, আমাদের ইস্তেগফারেরও ইস্তেগফারের মুখাপেক্ষী। অর্থাৎ ইস্তেগফারেরও ইস্তেগফারের প্রয়োজন। কোন এক কবি বলেছেন, যবানের ইস্তেগফার হাতে তাসবীহ অথচ অন্তরের ঘৃণা এবং গুনাহের মজা উভয়টাই আমার মধ্যে বিদ্যমান এমন তওবা ইস্তেগফারকারীর উপর বিপদেরও হাসি পায়।
ইস্তেগফার সকল প্রয়োজন পূরণে এক বিরাট নেয়ামত। গুনাহের ক্ষমায়, বিপদে আপদে, কামনা বাসনায়, রিজিকের প্রশস্ততায়, পরিবার পরিজনের কল্যাণে অর্থাৎ জীবনের সকল প্রয়োজনে ইস্তেগফার এক মহৌষধ। আমরা একে একে ইস্তেগফারের উপকারিতা, ফজিলত জেনে নিতে পারি:
হযরত হাসান রাহঃ একদিন বসে আছেন। তার সাক্ষাতে অনেক মানুষ আসেন, পরামর্শও নেন। এক ব্যক্তি এসে আরজ করল, আমি অনেক গুনাহগার, গুনাহ মাফের জন্য আমি কী করলে আমার এই অগনিত পাপ ক্ষমা পেতে পারি, আমাকে আপনি একটি আমল বাতলে দিন। হাসান রাহঃ তাকে বললেন, তুমি ইস্তেগফার পড়ো। তুমি ক্ষমা পেয়ে যাবে।
একটু পর অন্য এক ব্যক্তি আসল। সে এসে বলল, মুহতারাম অনেক দিন যাবত বৃষ্টি হচ্ছে না। ফসলের বীজ ফেলা যাচ্ছে না। মাঠে যে ফসল ছিল তাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘাসের অভাবে গৃহপালিত পশুগুলো খুব কষ্টে আছে। আমরা নিরুপায়। মহান রবের নিকট বৃষ্টির জন্য আমরা কোন আমল করতে পারি, আমাদের বলে দিন। জবাবে হাসানা রাহঃ বললেন, ইস্তেগফার পড়ো।
তারপর তৃতীয় ব্যক্তি এসে আরজ করল জনাব, আমি গরীব। সহায় সম্পদ নেই। ব্যবসা বানিজ্য নেই। চাকুরী নেই। কোন রুজি নেই। সংসার চালাতে অনেক ঋণ হয়ে গেছে। এই ঋণ পরিশোধের কোন পথ পাচ্ছি না। ঋণ দাতার সাথে ওয়াদা দিয়ে ঠিক রাখতে পারি না। লজ্জায় মুখ দেখানো কঠিন। আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যে আমল করলে মহান রব আমার এই সমস্যা দূর করে দিবেন। আমার রোজগারের পথ খুলে দিবেন। আমার রিজিকে প্রশস্ততা দান করবেন। আমার ঋণ পরিশোধের পথ করে দিবেন। আমার লজ্জা থেকে মুক্তি দিবেন। জবাবে হাসান রাহঃ বললেন, ইস্তেগফার পড়ো।
চতুর্থ আর এক ব্যক্তির আগমন হল। তারও যে একটি জিজ্ঞাসা, একটি পরামর্শ, একটি আরজি রয়েছে। সে এসে বলল মুহতারাম, আমার সন্তান সন্তুতি নেই। আমি মাওলার কাছে একটি ছেলে সন্তান চাই। সে আমার কর্মে সহযোগিতা করবে। আমরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে আমাদের জন্য দোয়া করবে। আমি কোন আমল করলে মহান মালিক আমার ডাক খুব দ্রুত শোনবেন। আমাকে একটি ছেলে সন্তান দিবেন। আপনি আমাকে পরামর্শ দিন। জবাবে হাসান রাহঃ একই উত্তর দিলেন, ইস্তেগফার পড়ো।
কি এক আশ্চর্য ব্যাপার একে একে লোক আসছে। প্রত্যেকের বিভিন্ন হাজত পূরণের পরামর্শ চাচ্ছে। তারপর পঞ্চম ব্যক্তি এলেন, সে এসে আরজ করল, হযরত আমার বাগান আছে, ব্যবসা আছে, মাঠে বকরীর পাল আছে। আমাকে বাগানে যেন ভাল ফলন হয়। ফলগুলো যেন সুস্বাদু হয়। ব্যবসা যেন ভাল হয়। আমার বকরীর পালে যেন বরকত হয়। অসুস্থ বকরীটা যেন ভাল হয়ে যায়। এর জন্য আমি কোন আমল করতে পারি, আপনার কাছে পরামর্শ চাচ্ছি। জবাবে হাসান রাহঃ বললেন, ইস্তেগফার পড়ো।
দেখতে না দেখতে ৬ষ্ঠ ব্যক্তির আগমন হল। তারও যে একটি আরজি, একটি পরামর্শ চাওয়ার আছে। তার একটি কুপ ছিল। মাঝে মাঝে কুপে পানি থাকে না। আবার পানি থাকলে কুয়োর পানি সুস্বাদু হয় না। কেমন যেন একটু আষ্টে আষ্টে স্বাদ। সে আরজ করল, হযরত। আমার কুপে যেন কখনো পানির ঘাটতি না হয়। সব সময় যেন পর্যাপ্ত পানি থাকে। আর কুপের পানি যেন সুপেয় হয়। আমি কোন আমল করতে পারি? জবাবে তিনি বললেন, ইস্তেগফার পড়ো।
হযরত হাসান রাহঃ এর পাশে এক লোক বসা ছিলেন। তিনি সকল আগন্তুককে দেখছিলেন। সকলের প্রশ্ন এবং হযরতের জাবব শোনছিলেন। সবার শেষে ঐ ব্যক্তি হাসান রাহঃ কে প্রশ্ন করল। অতি আশ্চর্যের বিষয়, আপনার কাছে ছয় জন ব্যক্তি আসল। সকলে তার হাজতের কথা আপনার নিকট পেশ করল। প্রত্যেকের হাজত ভিন্ন ভিন্ন ছিল। সকলে আপনার নিকট আমলের পরামর্শ চাইল। আপনি সকলকে একই আমল বাতলে দিলেন যে, ইস্তেগফার পড়ো। জবাবে হাসান রাহঃ বললেন, দেখো মহান আল্লাহ তায়ালাই এই ছয়টি সমস্যায় কোরআনুল কারীমের সুরা নুহের ১০-১২ আয়াতে এই আমলটি করার জন্য বলে দিয়েছেন:
১. ইস্তেগফারে গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভ: তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো (ইস্তেগফার পড়ো) তিনি তো মহা ক্ষমাশীল।
২. ইস্তেগফারে প্রচুর বৃষ্টিপাত: তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো (ইস্তেগফার পড়ো) ইস্তেগফার পড়ার কারণে তিনি তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাবেন।
৩. ইস্তেগফারে ধন সম্পদ প্রাপ্তি: তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো (ইস্তেগফার পড়ো) ইস্তেগফার পড়ার কারণে তিনি তোমাদের ধন সম্পদের মাধ্যমে সাহায্য করবেন।
৪. ইস্তেগফারে সন্তান লাভ: তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো (ইস্তেগফার পড়ো) ইস্তেগফার পড়ার কারণে তিনি তোমাদের ছেলে সন্তানের মাধ্যমেও সাহায্য করবেন।
৫. ইস্তেগফারে বাগানে প্রচুর ফলন: তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো (ইস্তেগফার পড়ো) ইস্তেগফার পড়ার কারণে তিনি তোমাদের বাগানে প্রচুর ফল দান করবেন।
৬. ইস্তেগফারে সুপেয় পানি লাভ: তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো (ইস্তেগফার পড়ো) ইস্তেগফার পড়ার কারণে তিনি তোমাদের সুপেয় পানির নহর দান করবেন।
৭. ইস্তেগফারে অভাব অনটন দূর: ইস্তেগফার এমন এক মহৌষধ। ইস্তেগফারকারী জীবন চলার পথে কোথাও কোন কিছুর অভাব বোধ করবে না। তার প্রয়োজনীয় সকল জিনিসে সে উত্তমটি পাবে। অর্থাৎ মহান রব জীবন চলার পথের সকল উপকরন দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা সুরা হুদের তৃতীয় আয়াতে বলেন, “আর যেন তোমাদের প্রভুর কাছে ইস্তেগফার করো, তারপর তাঁর দিকে ফিরে আসো, তিনি তোমাদের সুন্দর জীবনোপকরণ উপভোগ করতে দেবেন এক নির্দিষ্ট কালের জন্য (হায়াতে জিন্দিগিতে), আর তিনি প্রত্যেক প্রাচুর্যের অধিকারীকে তাঁর আরো প্রাচুর্য প্রদান করেন। আর যদি তোমরা ফিরে যাও তবে নিঃসন্দেহ আমি তোমাদের জন্য আশংকা করি এক মহাদিনের শাস্তির।”
৮. ইস্তেগফারে আজাব আর গজব থেকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি: আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য দুটি নিরাপত্তার গ্যারান্টি রেখেছেন। এই নিরাপত্তা এমন সুনিশ্চিত যে তার বিপরীতে কোন আজাব গজব, বিপদ আপদ বান্দাকে ঘ্রাস করতে পারে না। কোন বিপদ আপদ এই নিরাপত্তার দেয়াল টপকাতে পারে না। বান্দার ধারে কাছেও আজাব আর গজব ঘেষতে পারে না। একটি হল খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপরটি হল ইস্তেগফার। মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা আনফালের ৩৩তম আয়াতে বলেন, “আর আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন না যতক্ষণ আপনি (আল্লাহর রাসুল) তাদের মধ্যে রয়েছেন। আর আল্লাহ্ তায়ালা তাদের শাস্তি দাতা হবেন না যতক্ষন তারা ইস্তেগফার পড়ে (ক্ষমা প্রার্থনা করে)।”
৯. ইস্তেগফারে দুনিয়াতে শক্তিশালী হওয়া: ইস্তেগফার কারী দুনিয়াতে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। তার অর্থ বল, জন বল, গায়ের বল, মনোবল সব দিকে সে শ্রেষ্টত্ব লাভ করে। তাকে পরাস্ত করা কার সাধ্য। যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাকে শক্তিশালী করে দেন। সেখানে কে তার দিকে চোখ তুলে তাকাবে? মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা হুদের ৫২ তম আয়াতে বলেন, আর হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রভুর কাছে ইস্তেগফার করো (ক্ষমা প্রার্থনা কর), তারপর তাঁর দিকে ফিরে আসো, তিনি আকাশকে তোমাদের প্রতি পাঠাবেন বর্ষণোন্নুখ করে, আর তোমাদের শক্তির উপরে তোমাদের শক্তি বাড়িয়ে দেবেন, আর অপরাধী হয়ে ফিরে যেও না।’’ (চলবে)
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।