পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের কথা। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে অনেকে আছেন যারা জীবিত থেকেও ‘মৃত’। মৃত অবস্থা থেকে তারা ‘জীবিত’ হওয়ার লক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন অন্যরকম এক লড়াই। রেকর্ডপত্রে তারা ‘মৃত’ থাকায় ‘জীবিত’ হওয়াটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এটির ওপর নির্ভর করছে বেশ কিছু মৌলিক বিষয়। সম্পত্তি রক্ষা, ওয়ারিশ ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ অনেক কিছু।
নিজেকে ‘মৃত’ দেখিয়ে স্ত্রী সালমা তাহিনুরকে বিধবা ভাতা দিচ্ছেন ফেনীর ফুলগাজী দরবারপুর ৬নং জগৎপুর ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার কামরুজ্জামান কামরুল। ভাতা হাতিয়ে নিতে তাহিনুরকে দেখা হয়েছে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা’ নারী। কামরুজ্জামান একাধারে ইউপি মেম্বার এবং স্থানীয় কৃষকলীগ নেতা। তবে এর বিপরীত ঘটনাই বেশি।
কীভাবে যে মারা গেলেন- বুঝতেই পারছেন না পাবনার সুজানগর গুপিনপুর গ্রামের লোকমান হোসেন মন্ডল (৭০)। নিজের মৃত্যুর ঘটনা স্মরণে আসছে না কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার কবুরহাট গ্রামের রাজিয়া সুলতানারও (৩৩)! খেয়ে-পরে দিব্যি স্বামীর সংসার করছেন তিনি। কিন্তু মানুষজন বলাবলি করছে রাজিয়া নাকি মারা গেছেন। এটিও কি করে সম্ভব? কেমন করে মারা গেলেন- ভেবে পাচ্ছেন না যশোর ঝিকরগাছা সেন্ট লুই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক বজলুর রহমান (৬৫)। একই গোলক ধাঁধাঁয় রয়েছেন বগুড়া শেরপুর বনমরিচা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা বদিউজ্জামান বদি, সিলেট জকিগঞ্জ ভটপাড়ার স্কুল শিক্ষক আব্দুল কাদির, জামালপুর বকশীগঞ্জ আবুল পাড়া গ্রামের জোহরা বেগম, তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী নজরুল ইসলামও। তারা দিব্যি বেঁচে আছেন। হাঁটা-চলা করছেন। স্বাভাবিক জীবনযাপনও করছেন। কিন্তু কিছুতেই প্রমাণ করতে পারছেন না যে, তারা এখনও জীবিত। বেঁচে থাকা এই ‘মৃত’ মানুষগুলোর প্রকৃতপক্ষে বেঁচে আছেন- এটি প্রমাণ করতেই তারা অবতীর্ণ হতে হয়েছে ভিন্নরকম এক লড়াইয়ে।
জানা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সরকার যেক’টি ডাটাবেজ অনুসরণ করছে তার মধ্যে অনেক জীবিত ব্যক্তিকে ‘মৃত’ দেখানো হচ্ছে। প্রথম বিষয়টিকে ‘তথ্যগত ত্রুটি’ হিসেবে মামুলি মনে করা হতো। কিন্তু তত্ত্ব-তালাশে বেরিয়ে আসছে অনেক রহস্য। উদ্ধার হচ্ছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্যও। জীবিত থেকেও মৃত- এমন বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে সম্পত্তি আত্মসাৎ, জাল-জালিয়াতি, সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার ও সুবিধাদি আদায়ের মতো বহুমাত্রিক স্বার্থ হাসিলের নির্মম প্রয়াস। বিষয়টি নিছক এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) তথ্য সংগ্রহকারীদের হেয়ালিপনার মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা অনিচ্ছাকৃত মুদ্রণ প্রমাদ নয়। স্থানীয় পর্যায়ের স্বার্থান্বেষী, লোভী, ধূর্ত ব্যক্তিদের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য থেকেই এটি হচ্ছে। ধূর্ত শ্রেণিটির সঙ্গে ডাটাবেজ প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের গাঁটছড়া রয়েছে। সমন্বিতচক্র অর্থের লেনদেনে জীবিত মানুষদের নাম লিপিবদ্ধ করছে ‘মৃত’দের ঘরে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ আর বিড়ম্বায় পড়তে হচ্ছে ‘জীবন্মৃত’ মানুষগুলোকে।
শতায়ু-উত্তীর্ণ লোকমান হোসেন মন্ডলের বয়স্কভাতা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ অনুসন্ধানে জানা গেল, হালনাগাদ ভোটার তালিকায় তিনি মৃত। তথ্য সংগ্রহকারীরা তালিকা হালনাগাদের সময় ভুল তথ্য সন্নিবেশিত করেন। ভোটার তালিকায় ‘মৃত’ লোকমান হোসেন মন্ডল বলেন, ‘কীভাবে যে আমি মারা গেলাম বুঝতে পারছি না!’ লোকমান মন্ডলের স্বজনরা জানান, তিনি ছিলেন কৃষক। এনআইডি নং-৭৬১৮৩৭৬৩৩৫৫২৬। তার দুই ছেলের মধ্যে একজন মারা গেছেন। মৃত ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে চলে তার সংসার। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৮ বছর আগে তাকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড দেয়া হয়। সেটির বিপরীতে মাসে ৫শ’ টাকা করে ভাতা পেতেন। গতবছর সেপ্টেম্বর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সুজানগর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় জানিয়েছে, লোকমানের মতো ভোটার তালিকায় কণিকা রাণী সাহাকেও ‘মৃত’ দেখানো হয়েছে।
জকিগঞ্জ ভটপাড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আব্দুল কাদির কোভিড-১৯ এর টিকা নিতে পারেননি। তার বেতনও বন্ধ হয়ে গেছে। ফিক্সেশন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ভোটার তালিকার ডাটাবেজ অনুযায়ী তিনি মারা গেছেন!
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নের কবুরহাট গ্রামের খাদেমুল ইসলামের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা। কোনো নির্বাচনেই তিনি ভোট দিতে পারেননি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না। ব্যাংক কর্মকর্তারা সন্দেহ করেন, তিনি অন্যের আইডি কার্ড ব্যবহার করছেন কি-না। মোবাইলের সিম কিনতে গিয়েও পড়েন একই দুর্ভোগে। করোনা টিকাও নিতে পারেননি। পরে স্থানীয় নির্বাচন কমিশনে গিয়ে জানতে পারেন, নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজে তার ‘স্ট্যাটাস’র ঘরে উল্লেখ রয়েছে ‘মৃত’। নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে রাজিয়া সুলতানাকে মৃত দেখানো হয়েছে। তার এনআইডি নং-৫০১৭৯৫০১৯৯২০৯।
কথিত এই ‘মৃত’দের তালিকায় ছিলেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বনমরিচা গ্রামের বাসিন্দা বদিউজ্জামানও। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি ছিলেন ইউপি মেম্বার প্রার্থী। ভোটার তালিকায় তাকে ‘মৃত’ দেখানো হয়। এ জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুস সোবহান এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হেলেনা বিবিকে দায়ী করেন। এ বিষয়ে থানায় যে জিডি করা হয়। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালে গাড়ীদহ ইউনিয়নের বনমরিচা গ্রামের আব্দুল মোত্তালেব নামের একজন মারা যান। সেই নামের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা বদিউজ্জামান বদির নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরজুড়ে দিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা হয়। আর এটি করেছেন তথ্যদাতা আব্দুস সোবহান। এ বিষয়ে বদিউজ্জামানের বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচন থেকে আমাকে দূরে রাখতেই এই ক‚টকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
যশোর ঝিকরগাছা পৌরসভার কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা ‘মো. বজলুর রহমান’। এনআইডিতে লেখা শুধু ‘বজলুর রহমান’। নামে ‘মো:’ শব্দটি জুড়তে গিয়েছিলেন স্থানীয় তথ্য সেবাকেন্দ্রে। কিন্তু সার্ভারে এ নামের বিপরীতে পাওয়া তথ্যগুলো মিলছে না। অগত্যা ছুটলেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অফিসে। ওখান থেকে জানতে পারেন, বেশ কয়েক বছর আগেই তিনি ‘মারা গেছেন’। এ কারণে হালনাগাদ সার্ভারে তার নাম নেই।
মেহেরপুর গাংনি তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামে শিলিলপাড়ার প্রতিবন্ধী নজরুল ইসলামের এনআইডি থাকলেও তাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়া হয়। তার স্বজনরা জানান, এনআইডি জালিয়াতি করে সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে কিংবা কোনো অসদুদ্দেশ্যে অপরাধীচক্র তার নাম দিয়ে থাকতে পারে। তবে তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, নজরুল ইসলামকে পুনরায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যুর জন্য গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর একটি প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের মতে, এমন ঘটনা দু’-চারটি নয়। জীবিতকে মৃত দেখানো হয়েছে শত শত। ত্রুটিযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে হাজার হাজার। সবগুলো আলোচনায় আসছে না। সংবাদ মাধ্যমে চাউর হচ্ছে না। কিন্তু জ্বলজ্যান্ত মানুষকে নির্বিঘ্নে ‘মৃত’ দেখানোর ঘটনা জাতীয় তথ্য ভান্ডারের একটি বাস্তবতা। ভোক্তভোগীদের মতে, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এখন দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই ত্রুটিযুক্ত এনআইডি নিয়ে মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এনআইডিতে ত্রুটি থাকায় কারও চাকরি হচ্ছে না, কেউবা বেতন পাচ্ছেন না। কেউবা ব্যাংকের নিয়মের বেড়াজালে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় অনেক হতদরিদ্র ভিজিএফসহ বিভিন্ন ত্রাণ নিতে পারছেন না।
জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখানোকে তথ্য বিভ্রাট দাবি করেন নির্বাচন কমিশনের এনআইডি নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) আব্দুল বাতেন। এছাড়া এনআইডি’র ত্রুটি সংশোধনে ভোগান্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, কোভিড পেন্ডামিকের কারণে ইসিতে রোস্টারভিত্তিতে এনআইডি বিভাগের কিছু অস্থায়ী কর্মী কোনো কোনো কর্মকর্তার অধীনে কাজ করছেন। তবে এনআইডি সংশোধনের এতো বেশি আদেন জমা পড়ছে যা সময় মতো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।