Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তবুও রিমান্ড : মানা হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা

এভাবে সভ্য সমাজ চলতে পারে না : হাইকোর্ট

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত : ড. শাহদীন মালিক
আদালত শক্ত অবস্থান নিলেই অপব্যবহার রোধ হতে পারে : মনজিল মোরসেদ
হাইকোর্ট, আদালত
প্রায় দুই দশক আগে (২০০৩ সালে) উচ্চ আদালত রিমান্ডের বিষয়ে একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই নির্দেশনায় কোনো মামলায় আসামি গ্রেফতার এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়। এরই মধ্যে রিমান্ড ইস্যুতে বহু ঘটনার জন্ম দিলেও সংশোধিত হয়নি ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা দু’টি। যদিও সংবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশনা প্রতিপালন সরকার কিংবা ব্যক্তি মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক। রিমান্ড ইস্যুতে সর্বশেষ চিত্রনায়িকা পরীমণিকে মাদকের মামলায় পরপর ৩ বার রিমান্ডে নেয়া হয়। এই রিমান্ডকে চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত রিটের শুনানিকালে গত ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, পরীমণির ক্ষেত্রে রিমান্ডের অপব্যবহার হয়েছে। এভাবে একটি সভ্য সমাজ চলতে পারে না। আইনজ্ঞরাও বলছেন, প্রতিনিয়তই রিমান্ডের চরম অপব্যবহার হচ্ছে। একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই পারে রিমান্ডের অপব্যবহার বন্ধ করতে।

আইনের পর্যালোচনা করে দেখা যায, ‘রিমান্ড’ শব্দটি ফৌজদারি মামলায় আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮—এর ২টি ধারায় ‘রিমান্ড’ শব্দের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কার্যবিধির কোথাও ‘রিমান্ড’ শব্দটির সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ধারা দু’টি হচ্ছে- ১৬৭ ও ৩৪৪। ১৬৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি পুলিশ কতৃর্ক গ্রেফতার—পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কাজ সমাপ্ত না হলে এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটবর্তী আদালতের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড চাইতে পারেন। এ রিমান্ড একসঙ্গে ১৫ দিনের বেশি হবে না। ৩৪৪ নম্বরে বলা হয়েছে, আসামির অপরাধ সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য পাওয়ার পর যদি প্রতীয়মান হয় রিমান্ডের মাধ্যমে অধিকতর সাক্ষ্যপ্রাপ্তি সম্ভব, সেক্ষেত্রে একটি মামলার তদন্ত বা বিচার চলাকালীন আদালত একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন।

১৬৭ ধারার অধীন রিমান্ডের ক্ষেত্রে পুলিশি হেফাজত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করে রিমান্ড চাওয়া হয়। ৩৪৪ ধারার রিমান্ডের ক্ষেত্রে একজন আসামি বিচারিক হেফাজতে থাকাকালীন আদালতের কাছে রিমান্ড চাওয়া হয়। একজন আসামির আদালতের নির্দেশনায় কারাগারে অবস্থানকে বিচারিক হেফাজত বলা হয়। ৩৪৪ ধারায় আদালত বলতে ম্যাজিস্টে্রট ও দায়রা আদালতগুলোকে বোঝানো হয়েছে।

তবে রিমান্ডের বিষয়ে সাম্প্রতিক বাস্তবতা ভিন্ন। রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় এবং সেই জবানবন্দি মামলার বিচারে আসামির বিরুদ্ধেই ব্যবহার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, নারী আসামিদের ধর্ষণ এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে গত কয়েক দশক ধরে ‘রিমান্ড’ একটি বিতর্কিত বিষয়। উচ্চ আদালতে এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছে বহুবার। আদালত থেকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও বেড়েছে রিমান্ডের অপব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের পর রিমান্ডের অপব্যবহারের অভিযোগটি আলোচনায় আসে। মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের দাবি, তার মেয়েকে (মিন্নি) নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে।

১৯৯৮ সালে ডিবি অফিসে হেফাজতে মারা যান ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শামীম রেজা রুবেল। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করে। ওই রিটে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ৬ মাসের মধ্যে ফৌজদারি আইন সংশোধন করতে সরকারকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৫ মে ওই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। হালের বাস্তবতা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা অজুহাতে আসামিদের রিমান্ডে নিচ্ছে, নির্যাতন করছে। কখনওবা জোর করে আসামিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেও বাধ্য করছে। এ নির্যাতনের ফলে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। এসব বিচেনায় সুপ্রিম কোর্ট ১৫টি নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে রয়েছে : (১) আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। (২) কাউকে গ্রেফতার দেখানোর সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। (৩) গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে। (৪) গ্রেফতারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ। (৫) গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে পুলিশকে। (৬) বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যদি কাউকে আটক করা হয় তাহলে আটক ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে। (৭) আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। (৮) জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্টে্রটের আদেশক্রমে কারাগারের কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। (৯) কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। (১০) জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে। (১১) পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে, ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। (১২) পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্টে্রটকে জানাতে হবে। (১৩) পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয়, ঐ ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন তাহলে ম্যাজিস্টে্রট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন।

আইনজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিকের মতে, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তি আদায় করা সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, তা মানা উচিত। যদি পালন করা না হয়, সেটি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ জন্য সংশ্নিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তার মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আদেশ প্রতিপালনের বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল নন। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।

একই বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)—এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলায় বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে রিমান্ড দরকার হতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ৯৫ ভাগ মামলার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামির রিমান্ড চাইছে। আমরা জানি না রিমান্ডে আসামির সঙ্গে কী ব্যবহার করা হয়। তবে ধারণা করা যায়, রিমান্ডে নিলে তদন্ত কর্মকর্তার জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা মেলে। অনেক সময় ‘উপরের নির্দেশে’ও রিমান্ড হয়। এটি এখন একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিমান্ডের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা আজকের রিমান্ড সেটির ধারেকাছেও নেই। এখন সুপ্রিম কোর্ট যদি মনে করে এভাবে আর রিমান্ড নিতে দেয়া যাবে না’ তাহলে আদালতই পারে এই প্রবণতা রোধ করতে। আদালত শক্ত অবস্থান নিলেই কেবল এটি বন্ধ হতে পারে।

 

 



 

Show all comments
  • Parvez ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৭:০২ এএম says : 0
    এসব প্রতিবেদন না লেখাই ভাল। কারণ এগুলো বাস্তবায়িত হয় না, হয়তো কক্ষনো হবেও না। এসব পরে শুধু মনের কষ্ট বাড়ে আর দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া হয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাইকোর্ট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ