বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
ড. মইনুল ইসলাম
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের একজন প্রবল প্রতাপান্বিত রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন স্পিকারকে পরাজিত করে মেম্বার অব ন্যাশনাল এসেম্বলি নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর বিজয়ীর বেশে দেশে ফেরার পর তিনি বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালে তাঁকে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের জেলা-গভর্নর মনোনীত করেছিলেন। কী এক অভিমানে আশির দশকে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন এই পরম সজ্জন ব্যক্তিত্ব, কিন্তু চট্টগ্রামের সর্বাধিক প্রচার সংখ্যা অর্জনকারী দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদীর’ সম্পাদক হিসেবে আমৃত্যু চট্টগ্রামের জনসমাজ, বিদ্বৎসমাজ এবং গণমাধ্যম জগতের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। জাতির বিবেক হিসেবে তিনি ছিলেন দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অথচ স্বল্পবাক্ দিশারী। তাঁর ¯েœহের ফল্গুধারায় সিক্ত অনুজপ্রতিম হিসেবে অগ্রজপ্রতিমের উদ্দেশে নিবেদিত ‘অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতা’ প্রদানের সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত ও আবেগাপ্লুত। আমাকে এই সুযোগ ও সম্মান প্রদানের জন্যে আমি উদ্যোক্তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। যে বিষয়টি আমি স্মারক বক্তৃতার জন্যে চয়ন করেছি, সেটি অধ্যাপক খালেদের সাথে অনেকবারের আলাপচারিতায় তাঁর এবং আমার আবেগ ও উদ্বেগের অন্যতম মূল ইস্যু হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। অধ্যাপক খালেদের মৃত্যুর পর গত একযুগে প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রিভবন এদেশে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে এমন এক সুতীব্র সংঘাতের বিষয়ে পরিণত করেছে যে ঘটনা পরম্পরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল ইস্যুটি গণতন্ত্রের পথ থেকে ছিটকে গিয়ে খোদ গণতন্ত্রকেই বর্তমান পর্যায়ে গভীর সংকটে নিমজ্জিত করেছে, যা দেশের উন্নয়ন সম্ভাবনাকে যে কোনো সময় তছনছ করে দিতে পারে। তাই, এই বিষয়ে কিছু নির্মোহ আলোচনা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন এবং সরল-সত্য কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল পাকিস্তানের কারাগার থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্যে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঐ মাহেন্দ্রক্ষণ আসার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন যে, তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে চান। অতএব, পরদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ও শপথ গ্রহণ করে। ক্ষমতাগ্রহণের অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করেন। মাত্র দশ মাসে প্রণীত সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের গণপরিষদে পাস হয়, এবং ঐ সংবিধানকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকারিতা প্রদান করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এই সংবিধান বিশে^র সকল স্বাধীনতা-অর্জনকারী রাষ্ট্রের মধ্যে অপেক্ষাকৃত স্বল্পসময়ে প্রণীত ও অনুমোদিত গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। কিন্তু ৪৪ বছর পার হয়ে এসে এখন আমাদের মনে শংকা জেগেছে যে বর্তমানে বাংলাদেশ যে ‘গণতন্ত্রের সংকটে’ নিমজ্জিত হয়েছে তার মূল নিহিত রয়েছে প্রধানত এই সংবিধানেই। বিশেষত, সাংবিধানিক কয়েকটি ধারার সাথে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ার ফলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের প্রধান নির্বাহী মানে প্রধানমন্ত্রীর যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তার প্রতিবিধানের জন্য সংবিধানটিকে ‘সত্যিকার গণতান্ত্রিক সংবিধানে’ রূপান্তরিত করার আবশ্যকতাকে অপরিহার্য করে তুলেছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি। এই অবশ্যকরণীয় দায়িত্বটি যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতি পালন না করে তাহলে গণতন্ত্রের বর্তমান সংকট জাতির অগ্রযাত্রাকে চরমভাবে বিঘিœত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
সংবিধানের যে কয়েকটি ধারার কারণে প্রধানমন্ত্রীর এই একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো হলো : এক. সংবিধানের ৪৮ (৩) ধারায় বর্ণিত বিধান, যেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। ৪৮ (৩) ধারাটি নি¤œরূপ : “এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন :
তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।”
এই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের অধীনে ন্যস্ত করে ‘আজ্ঞাবহ’ করে ফেলা হয়েছে তার ফলে সংবিধানজুড়ে রাষ্ট্রপতিকে যত রকমের ক্ষমতাই প্রদান করা হোক না কেন সবগুলোই প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় রূপান্তরিত করার ব্যবস্থাই চালু করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘মাজার জিয়ারত ছাড়া বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের আর কোন ক্ষমতা নেই’। কথাটার মর্মবাণী জাতি উপলব্ধি করতে যত বিলম্ব করবে ততই ‘রাষ্ট্রপতি’ পদটির এহেন ‘ঠুঁটো জগন্নাথসুলভ’ ও প্রহসনমূলক অবমূল্যায়ন জাতিকে বিশে^র সামনে হাসির খোরাক বানাবে।
দুই. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদটি নি¤œরূপ : “কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।”
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি সংসদ-সদস্যদের ওপর রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা-নেত্রীর নিয়ন্ত্রণকে যে একচ্ছত্র ও নিরঙ্কুশ করার উদ্দেশ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটা কোনো গোপন বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রধানের এই নিয়ন্ত্রণ যে তাঁর প্রতি দলের বা জোটের সংসদ-সদস্যদের ‘প্রশ্নহীন আনুগত্যের চাবিকাঠি’র রূপ ধারণ করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংসদকে একটি গুরুত্বহীন ‘ডিবেটিং সোসাইটি’তে পরিণত করার জন্যে এই ৭০ অনুচ্ছেদই যে প্রধানত দায়ী তা এই ৪৪ বছরে সপ্রমাণিত। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পঞ্চাশ দশকের ‘পার্লামেন্টারি হর্স-ট্রেডিং’-এর অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্যে এই ধারাটি অপরিহার্য বিবেচিত হলেও এর ফলে সংসদ-সদস্যদেরকে যে দলের বা জোটের নেতা-নেত্রীর কাছে পুরোপুরি ‘জিম্মি’ করে ফেলা হয়েছে সেটা এখন সর্বজনস্বীকৃত সত্য। কিন্তু ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের অবসানের পর ২০০৭-০৮ সালের ছদ্মবেশী সামরিক শাসনের দু’বছর বাদে গত ২৩ বছর ধরে এর সুফলভোগী সরকারি বা বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীরা এই অনুচ্ছেদটি পরিবর্তনে মোটেও আগ্রহী নন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলের নেত্রীর মধ্যে পুরোপুরি মতৈক্য বিদ্যমান। অতএব, এই অনুচ্ছেদটির সংশোধনী দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব বললে অত্যুক্তি হবে না।
তিন. ২০১৪ সালে পাস হওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। সংশোধিত ৯৬ অনুচ্ছেদের (২), (৩) ও (৪) ধারা এখন নি¤œরূপ: “(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।
(৪) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।”
সংসদের কাছে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা প্রদান সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ ২-১ বিভক্ত রায়ে অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হতে হবে। কিন্তু হাই কোর্টের ঐ বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুজন বিচারপতির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছি, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের উপস্থিতিতে সংসদ-সদস্যরা যেহেতু নিজ নিজ দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে জিম্মি থাকছেন তাই সংশোধিত ৯৬ (২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে’ বাক্যাংশের বিধানটি ক্ষমতাসীন দল বা জোটের প্রধানের ইচ্ছাধীন বিষয়ে পরিণত হতে বাধ্য। এই মতামত প্রদানের ব্যাপারে সংসদ-সদস্যদেরকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের আওতামুক্ত করা না হলে দলীয়-প্রধানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই বিচারকদের অপসারণে একমাত্র নির্ধারক বিষয়ে পরিণত হবে, এটা বোঝা প্রয়োজন। এতে যে সরকারের তিনটি অঙ্গÑ সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা আরো একতরফাভাবে গেড়ে বসবে সে ব্যাপারটি কি বুঝতে পারছি না আমরা? এই অবস্থায় দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ-সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার শর্ত অন্যায়ভাবে কোন বিচারপতির অপসারণের বিরুদ্ধে কোন অর্থবহ রক্ষাকবচ হতে পারবে না, কারণ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার কোন ক্ষমতা সরকারী দল বা জোটের সংসদ-সদস্যের নেই। এমতাবস্থায়, প্রধানমন্ত্রীর যদি খায়েশ হয় যে তিনি কোন বিচারপতিকে অপসারণ করবেন তাহলে সংসদের সরকার দলীয় বা জোটভুক্ত সংসদ-সদস্যদের ভোট এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন দুটোই পাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের সংবিধান, কারণ মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও ক্ষমতা নেই এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরে কিছু করার। তাই, প্রকৃত বিচারে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের তিনটি অঙ্গের উপরেই একক ক্ষমতাধর করে ফেলার এই সাংবিধানিক ব্যবস্থাটি বিচারপতিদের নিরপেক্ষতার জন্য মহাবিপজ্জনক হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হক আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। কারণ, তাঁর নেতৃত্বে প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়গুলো এই জাতিকে সংবিধানের পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনীর কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে দাবি করেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিলে বিচারপতিদের ভয়ের কারণ নেই। আমার অজানা কোন তথ্যের ভিত্তিতে হয়তো তিনি তাঁর এই অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁর এই আশ্বাসে আমি আশ্বস্ত হতে পারছি না। তাঁকে বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে তিনি নিজেই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এর ফলে সাংসদরা নিজেদের দলের কাছে বন্দী হয়ে আছেন (প্রিজনারস টু দেয়ার ও’ন পার্টিজ)’। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশে সংসদের কাছে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকার নজির উল্লেখ করে এদেশেও তা সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার যে যুক্তি তিনি তুলে ধরেছেন তা কতখানি যুক্তিসঙ্গত হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। বরং, এ ব্যাপারে আরেকজন শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতি প্রয়াত মোস্তফা কামালের আশংকাটাই বেশি যৌক্তিক মনে হয়েছে আমার কাছে। উপরে সংবিধানের যে তিনটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা হলো সেগুলো এদেশের রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় সরকারের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দিয়েছে। সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সুস্পষ্ট এখতিয়ার এবং ক্ষমতার ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ গণতন্ত্রের অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কিন্তু সরকারের নির্বাহী প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) কে রাষ্ট্রক্ষমতায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে সুযোগ এদেশের সংবিধান করে দিয়েছে তার যৌক্তিক প্রতিবিধান ব্যতিরেকে গণতন্ত্রের শনির দশা কাটবে না, এটাই আমার দ্ব্যর্থহীন অবস্থান।
বাংলাদেশের অনুন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে আমি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে চলেছি। এ-সম্পর্কে দেশে-বিদেশে আমার বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ‘রোল অব দি স্টেট ইন বাংলাদেশ’স আন্ডারডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক একটি বইয়ের পা-ুলিপি রচনার কাজ সম্পন্ন করেছি আমি। এই গ্রন্থের মূল থিসিস হলো, বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র নব্য-ঔপনিবেশিক, প্রান্তীয় পুঁজিবাদী, আমলাতান্ত্রিক এবং পুঁজি লুণ্ঠনমূলক (বীঃৎধপঃরাব)। এই বিষয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণার মাধ্যমে আমার দৃঢ় প্রতীতী জন্মেছে যে, বাংলাদেশের রাষ্টক্ষমতার কেন্দ্রিভবন গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটের জন্যে মূলত দায়ী। উন্নয়নের ধারক-বাহক হতে হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও জালিয়াতি-মুক্ত নির্বাচনে জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধিরা যাতে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত সকল নির্বাচনে নির্বাচিত হতে পারেন সে ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই হবে। জনগণের কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক জবাবদিহি যাতে নিশ্চিত করা যায় তার ব্যবস্থাকেও প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি, সংবিধানের উল্লিখিত কয়েকটি ত্রুটির কারণে গণতন্ত্রের নামে দেশে যে ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ কায়েম হয়ে গেছে তা সংশোধনের জন্যে সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের আওতা সংকুচিত করে শুধু সরকারের বিরুদ্ধে ‘নো কনফিডেন্স মোশনের’ ক্ষেত্রে সরকারি দল বা জোটের সংসদ-সদস্যদের সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অধিকার খর্ব করে অন্য যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের স্বাধীন ভোট প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। সরকারের তিনটি অঙ্গ সংসদ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে সরকারের অন্য দুটো অঙ্গের ওপর নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য বিস্তারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই, এক্ষেত্রেও সংবিধান সংশোধনী ছাড়া গত্যন্তর নেই। সংসদের কাছে মন্ত্রিসভার যৌথ জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে, এক্ষেত্রেও শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রীদের জবাবদিহি গণতন্ত্রের জন্য ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। রুলস অব বিজনেসেও প্রধানমন্ত্রীকে যে ঢালাও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে সেগুলোকে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের তুলনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে একক ক্ষমতাশালী করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে ক্ষমতাহীন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করে ফেলা হয়েছে সেটাও খুব লজ্জাজনক। সরকারের এহেন ভারসাম্যহীনতা সংশোধন না করা হলে ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ থেকে জাতির পরিত্রাণ মিলবে না। অতএব, সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার প্রক্রিয়া শুরুর লক্ষ্যে একটি জাতীয় কনভেনশান আহ্বান করা এখন সময়ের দাবি। দেশের সংবিধানকে যতই আমরা গণতান্ত্রিক বলে প্রশংসা করি না কেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে এই সংবিধানটি রচিত হওয়ায় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর করে ফেলা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতাগুলো প্রেসিডেন্টের কাছে অর্পিত হয়েছিল। (ঐ চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ থেকে সরিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পিত হয়েছিল। আরো অনেক ক্ষমতা যোগ করা হয়েছিল ঐ একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রধান নির্বাহী প্রেসিডেন্টের হাতে।) ১৯৭৫-৯০ পর্বের অবৈধ সমর-প্রভুরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ক্ষমতা ফলানোর জন্যে সরকারের ‘রুলস অব বিজনেস’ বারবার পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার আওতা আরো বাড়িয়েছেন যত্রতত্র। ১৯৯১ সালে যখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে আবার সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারে ফিরে আসা হয়েছিল তখন ‘রুলস্ অব বিজনেসে’ আরো পরিবর্তন করে বেগম জিয়ার ক্ষমতা আরো নিরংকুশ করার জন্যে অনেক নতুন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয়েছিল। ফলে, সাংবিধানিকভাবেই দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এখন একনায়কের মতোই ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন এদেশে। এর সাথে যখন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিধানের অসীম শক্তি যোগ হয়ে গেছে তখন এদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে কেউ এই দু’দলের দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন বা তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার মতো ধৃষ্টতা দেখাবেন! সে জন্যেই বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে আমি ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ বলে অভিহিত করে চলেছি। এক নদী রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের লজ্জাজনক রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল বা জোটের সংসদ-সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সামন্ত-জমিদারের মতো ক্ষমতা ফলানোর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হলেও প্রধানমন্ত্রীর সামনে অসহায় স্তাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে তাঁদেরকেÑ এ যেন পালাক্রমে দু’স¤্রাজ্ঞীর শাসন চলেছে বাংলাদেশে। এ জন্যেই এদেশের একজন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আনিসুর রহমান বর্তমান ভোটের রাজনীতিকে ‘নির্বাচিত জমিদারতন্ত্র’ বলে চিহ্নিত করেছেন, আমি আমার কয়েকটি লেখায় তাঁকে উদ্ধৃত করেছি। [চলবে]
য় লেখক : ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
[প্রবন্ধটি গত ২ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।