মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
আবু তাহের
কাব্য কবিতায় গ্রাম হয়তো অনেককেই হাতছানি দেয়। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকে শহর। আর সেটা লাখো প্রাণের শহর ঢাকা। রাজধানী ঢাকা। রাজার শহর রাজধানী। রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বপ্নের মানুষ, রঙিন জগতের মানুষ সবাই ঢাকা থাকে। আমি কেন গ্রামে থাকব! আমি ঢাকা যাব। কি নেই রাজধানীতে? কিন্তু রাজধানী কি আমাদের এই ভার সইতে পারছে? হাজারো প্রশ্নের জালে জর্জরিত ঢাকা আজ মুখিয়ে আছে উত্তরের জন্য। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ঢাকামুখী গ্রামের মানুষের আগমন বন্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তাহলে রাজধানীর অধিকাংশ মানুষই কি গ্রামের? একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এক অর্থে বলতে গেলে সবাই গ্রাম থেকেই আসা। আরেক অর্থে বলতে গেলে নতুন করে গ্রাম থেকে আসা হতদরিদ্র জনগণ। মন্ত্রী মহোদয় কোন অর্থ বুঝিয়েছেন জানা নেই। তবে প্রশ্ন হলো, সমাধানের পথ কি এটাই?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার, ১৯৫১ সালে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৮ এবং ১৯৬১ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ১৪৩। ১৯৭৪ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৭ হাজার এবং ১০ বছর পর ১৯৮১ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ লাখ ৪০ হাজার। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮ লাখ ৪৪ হাজার এবং ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১ কোটি ৭ লাখ। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম তার ‘উন্নয়নে নগরায়ণ’ বইতে লিখেছেন ১৯৭৪ সালে যখন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়, তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৬ লাখের মতো। ’৮১-তে এসে ঢাকার জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখে, ’৯১-তে ৭০ লাখে। তখন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ঢাকা মহানগরকে মেগাসিটি নামে আখ্যায়িত করে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনেও ঢাকাকে ’৮৬ সালেই মেগাসিটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এবার মেগাসিটি কি জেনে নেয়া যাক। মেগাসিটি বলতে সেসকল মেট্রোপলিটন এলাকাকে বোঝানো হয়, যেখানকার জনসংখ্যা ১ কোটি বা ১০ মিলিয়নের অধিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ঘনত্ব (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ন্যূনতম ২০০০ জন) বিবেচনা করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের হিসাব বাদ দিয়ে যদি আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব ধরি তবে ৯১-তে আমরা মেগাসিটি হয়েছি। জনসংখ্যা এই বিপুল ভার আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি পঁচিশ বছর ধরে। পঁচিশ বছর ধরে হয়তো কোনো কিছুরই লাগাম টেনে রাখা যায় না।
মেগাসিটির দিক দিয়ে ঢাকা চীনের সাংহাই বা বেইজিংয়ের কাছাকাছি। এর চেয়েও কাছে কলকাতা কিংবা পাকিস্তানের করাচির। চীনের উদাহরণ এ কারণে টানা হলো, ঢাকার সাথে চীনের পার্থক্যগুলো হয়তো খুব সহজেই ধরা পড়বে। সেদিকে দিয়ে বিবেচনা করলে কলকাতা বা করাচির সাথে পার্থক্য করা মুশকিল। মুম্বাইও ঢাকার কাছাকাছি। এই শহরগুলোর সাথে ঢাকার সুযোগ-সুবিধা থেকে সবকিছু বিবেচনা করলে বিস্তর ফারাক চোখে পড়বে। বেইজিংয়ের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ১৭ লাখ। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্ট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে থেকেও বেইজিং ঢাকা থেকে অনেক উন্নত। তাহলে সমস্যা কোথায়?
ঢাকামুখী জনসংখ্যা এই ¯্রােতের গতিরোধ করতে পারলেই কি মিলবে সমাধান? কিন্তু মেগাসিটি হওয়ার পর থেকেই তো এর লাগাম টেনে ধরা দরকার ছিল। মূলত বেশকিছু বিষয় এখানে জড়িত। মন্ত্রী মহোদয় এ বিষয়ে বেশকিছু কথা বলেছেন। ঢাকা রাজধানী হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শপিংমল থেকে শুরু করে সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার খুলছে প্রতিনিয়ত। সারাদেশ থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে তাই ঢাকার দিকে। চাকরির জন্য, ব্যবসার জন্য, স্কুল-কলেজে ভর্তির জন্য। গড়ে উঠে নতুন নতুন ভবন। নতুন অ্যাপার্টমেন্টের মাথাও ছুঁতে চায় যেন আকাশ। এক্ষেত্রে রাজউকের অব্যবস্থাপনা ও অসততার জন্য রাজধানীতে গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন ভবন। এটা কোনো নতুন খবর নয়। রাজউকের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। রাজধানীর হাজারো সমস্যা কারণ খতিয়ে দেখলে রাজউককে একটা কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় সহজেই। এটা কোনো গ্রাম থেকে আসা ব্যক্তির দ্বারা ঘটিত কোনো কাজ নয়। শহুরে শিক্ষিত, উচ্চ মেধাসম্পন্ন কিছু মানুষের কাজ এগুলো। দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা।
এক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)-এর পরিকল্পনাহীনতার অভাব রয়েছে। তাদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনায় ঘাটতি। কোথায় কী হবে সেটা থাকতে হবে। কোথায় প্রশাসনিক ভবন, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকার পরিকল্পনা থাকতে হবে। পাশাপাশি আবাসিক এলাকায় ও স্কুল-কলেজও পরিকল্পনা অনুযায়ী হওয়া উচিত। এদের আরো কাজ আছে। সাধারণ নগর পরিকল্পনার মধ্যে পরিবহন পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোথায় রাস্তা হবে, কী ধরনের রাস্তা হবে। কী ধরনের পরিবহন চলবে সবই পরিকল্পনার অংশ। এসব কাজে রাজউক আগাগোড়াই পিছিয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দীর্ঘদিন ধরে বারবার উঠে এসেছে বসবাসের অনুপযুক্ত হিসেবে ঢাকা মহানগরীর নাম। তাদের মতে, এরপরও যদি কারো টনক না নড়ে তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই একদিন পরিত্যক্ত হতে পারে ঢাকা। রাজধানী ঢাকার যানজট একটা পুরোনো ব্যাধি। এক্ষেত্রে সঠিকভাবে কে দায়ী বলা মুশকিল। যদি বলা হয় পুরোনো, অকার্যকর, মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ি এর কারণ। তাহলে তো প্রায়ই শোনা যায়, এই গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানের কথা। একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের পর অভিযানেরও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। নতুন রূপে ফিরে আসে পুরোনো গাড়ি। ড্রাইভারদের কথা কি বলব জানা নেই। আমাদের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় হানা দেন। অনেক কিছুই তিনি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সর্ষের ভূত তাড়াবে কে? ড্রাইভার, গাড়ি দুটোর যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। ইদানীং দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের স্বজনদের কান্নায় ভারী আমাদের চারপাশ।
রাজধানী ঢাকাকে এখন গাড়ির শহর বললেও ভুল হবে না। দেখা যায় বাসায় গাড়ি আছে পাঁচটা। বাবা একটা, ছেলে একটা, ছেলের বউ একটা, বাসার ম্যানেজার অন্যটা...। আর কিছুদিনে গেলেতো মানুষ সরিয়ে ঢাকাতে শুধু গাড়িই রাখতে হবে। টাকা আছে বলেই যে কারো প্রয়োজনের বাইরেও পাঁচ-ছয়টা গাড়ি থাকতে হবে এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। আর এই গাড়িগুলো কেনার সামর্থ্য গ্রামের গরিব মানুষের নেই। তারা দু পয়সার লোকাল বাসে চলাফেলা করে।
ঢাকার দুই মেয়র ঢাকাকে সহনশীল, দারিদ্র্যমুক্ত, নিরাপদ, সবুজ, সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সবুজ ঢাকার জন্য ৬/৭ লাখ গাছ লাগানোর কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাট ও লেক উন্নয়নের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু কতটুকু সুফল আসছে এতে?
সব পরিকল্পনাতেই পথচারীকে সবার আগে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পথচারীর চলাচলের জন্য উপযোগী সড়কের কথা বলা হয়েছে। ঢাকার রাস্তা পথচারীর জন্য কতটা উপযোগী? এখনো ৩০-৪০ ভাগ মানুষ হেঁটে কর্মস্থলে যায়। তাদের জন্য চলাচলের উপযোগী সড়ক এখনো তৈরি করা যায়নি। ফুটপাতগুলো বেশিরভাগই দখলে থাকে। এজন্য ফুটপাতগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের ব্যবস্থা রাখা আজো সম্ভব হয়নি। রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জেব্রা ক্রসিংগুলোতে পা দেয়ার পর পথচারী যেন মনে করেন তিনি শতভাগ নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবে কি তাই! যথাযথ আন্ডারপাস নেই। বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধী এরা তো ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারবে না। যারা শক্ত সামর্থ্য, যুবক তারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে।
হাজারো সমস্যার মধ্য থেকে কয়েকটি সমস্যা এখানে তুলে ধরা হলো। আর এগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কথা হচ্ছে। তাহলে কি এগুলোর সমাধানের মধ্যেই মুক্তির পথ? মূলত এখানে দুটো বিষয় রয়েছে। প্রথমত সুষ্ঠু সমাধান। দ্বিতীয়ত সমাধানের মাধ্যমে যেন নতুন সমস্যার সৃষ্টি না হয়। কারণ আমাদের সব উন্নয়ন কার্যক্রম এবং পরিকল্পনা ঢাকাকেন্দ্রিক। আর এ কারণেই মানুষকে ঢাকা আসতে বাধ্য করা হচ্ছে।
কারণ দেশে ঢাকার মতো বিকল্প শহর গড়ে উঠেনি, তাই মানুষ ঢাকায় ছুটছেন। নানা কারণে মানুষ এই শহরে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে, চাকরির সন্ধানে, বেঁচে থাকার জন্য জীবন-জীবিকার তাগিদে, ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিতে ও ভালো স্কুলে পড়তে। দক্ষতা বাড়ানোর জায়গা এ শহর। ৫০’র দশকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শহর ভালো ভূমিকা পালন করলেও এখন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেভাবে এগুতে পারছে না, তাই সুযোগ-সুবিধার খোঁজে রাজধানীমুখী মানুষ। বর্তমানে চট্টগ্রাম ঢাকার মতো অন্যতম শহর হলেও তা ঢাকার মতো গুরুত্ববহন করে না। বিকল্প শহর গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষের আকর্ষণ বাড়বে। যে কারণে মানুষ ঢাকায় আসে সেসব কারণ গ্রামে নিয়ে যেতে হবে।
অর্থনৈতিক ও জলবায়ুগত কারণে মানুষ ঢাকায় আসছে। অর্থনৈতিক কারণের মধ্যে রয়েছে দরিদ্রতা, বেকার ও ভূমিহীন। অন্যদিকে গ্রাম মানুষকে ধরে রাখতে পারছে না; কারণ কাজ নেই। কৃষিকাজ এখন অনেক হিসাব করে করা হয়। গ্রামেও অকৃষিভিত্তিক কাজ হচ্ছে। প্রতিদিন ঢাকা শহরে কমিউটার হিসেবে ৪ থেকে ৫ লাখ লোক আসেন লঞ্চ, ট্রেন ও বাসে। তারা এই শহরের বিভিন্ন সেবা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার চলেও যান। তারা এখানে অবস্থান করেন না। ঢাকার বাইরে সুন্দর কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থাও নেই। তাহলে কেন মানুষ ঢাকা আসবে না?
যদিও এ বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় আশ্বস্ত করেছেন বর্তমান সরকার রাজধানীর বাইরেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি বর্তমানে জেলা শহরগুলোকে সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে আধুনিকায়ন করার প্রচেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। নগরীতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। যারা নগরী দেখভালের দায়িত্বে থাকবেন তাদের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা থাকতে হবে। ব্যবস্থাপনাতে দক্ষ হতে হবে। ব্যবস্থাপক কঠোর হলে দুর্নীতিও প্রশ্রয় পাবে না।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।