Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশজুড়ে তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন ৯ জেলায় বন্যার অবনতি

পদ্মা-যমুনা-ধরলাসহ পাঁচ নদীর ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ষ প্লাবিত নিচু ও চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা ষ ভারতের ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত

ইনকিলাব রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ এএম

ভারত ফারাক্কা বাঁধ, গজলডোবাসহ সবক’টি বাঁধ-ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, গড়াইসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর এই ৮ জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পদ্মা-যমুনা-ধরলাসহ পাঁচ নদীর ৭টি পয়েন্টে পানি গতকালও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উজানের ঢলে নদ নদীর পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি ভাঙনও তীব্র হচ্ছে। চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি জীবন যাপন করছে। নদীভঙনে বসতভিটা, ফল-ফসলি জমিজমা হারিয়ে রাতারাতি নিঃস্ব হচ্ছে অনেকেই। নদী পাড়ের বাসিন্দাদের দিন কাটছে ভাঙন আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়। বন্যা ও নদীভাঙন নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিচে তুলে ধরা হলো।

চট্টগ্রাম থেকে শফিউল আলম জানান, ভারতের ঢলে দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদীপাড়ের অনেক এলাকায় ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল থেকে ভাটি ও মোহনা পর্যন্ত নদীভাঙন এবং নিম্নাঞ্চলে বন্যার বিস্তার ঘটছে। বানের তোড়ে তলিয়ে গেছে অনেক নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল। গতকাল রোববার বিকাল পর্যন্ত পদ্মা, যমুনা, ধরলা, আত্রাই ও গড়াই এই পাঁচটি নদ-নদী ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আরও বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে।

অতি বর্ষণে উজানে নদ-নদীগুলোর অববাহিকায় পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ভারত তিস্তায় গজলডোবা, গঙ্গায় ফারাক্কাসহ সব বাঁধ-ব্যারেজ একযোগে খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে। এতে করে দেশের উত্তর জনপদ, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হয়ে ভাটিতে শরীয়তপুর পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বন্যা ও নদীভাঙন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল পূর্বাভাস দিয়েছে, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। ইতিমধ্যে এসব জেলা-উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল বানের পানিতে তলিয়ে গেছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, প্রধান নদ-নদীগুলোর ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪৫টিতে হ্রাস ও ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত রয়েছে। এরমধ্যে ৫টি নদ-নদীর ৭টি স্থানে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার নদ-নদীর ৬৪টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪২টিতে হ্রাস, দু’টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত ও ৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুক্রবার ৬৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪২টিতে হ্রাস, ৩টিতে অপরিবর্তিত ও ৩টি স্থানে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। বৃহস্পতিবার ৬৭ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৮টিতে হ্রাস, তিনটি স্থানে অপরিবর্তিত ও চারটি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।

প্রধান নদ-নদীগুলোর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে গতকাল পাউবো জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনার সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে এবং ধলেশ^রী নদী এলাসিন পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

প্রধান নদ-নদীর প্রবাহের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে গতকাল বিকাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৮টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর বাংলাদেশে প্রবেশমুখে পাংখা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩৪ সে.মি. নিচে, রাজশাহীতে ৭৭, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে মাত্র ৬, ভাগ্যকুলে ১৬, মাওয়ায় ২৩, সুরেশ্বরে বিপদসীমার ২১ সে.মি. নিচে নেমেছে।

উত্তর জনপদে বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত যমুনার কাজীপুর, মথুরা ও আরিচা পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপদসীমার যথাক্রমে ৩, ১৩ এবং ৪ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া যমুনা সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জে বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। উত্তর জনপদের ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৮ সে.মি. উপর দিয়ে বইছে। দুধকুমার নদী পাটেশ্বরীতে বিপদসীমার ১২ সে.মি. নিচে নেমেছে। তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে মাত্র ১০ সে.মি. নিচে।

উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ১১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে এলাসিনে মাত্র ১ সে.মি. নিচে রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গড়াই নদী মাগুরা জেলার কামারখালী পয়েন্টে বিপদসীমার ১৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়ায় বেতনা নদী বিপদসীমার ২৫ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।

রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে দফায় দফায় তিস্তার পানি বৃদ্ধি এবং অব্যাহত ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গঙ্গাচড়ার ৫টি ইউনিয়নের মানুষ। সর্বগ্রাসী তিস্তার ভয়াবহ ভাঙন দিনে দিনে তীব্র আকার ধারণ করছে। প্রতিদিনই গিলে খাচ্ছে নতুন নতুন ফসলি জমি, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বানের পানিতে ডুবে আছে শত শত একর জমির আমন ধান, বেগুন, মরিচ, ঝিঙ্গাসহ বিভিন্ন ফসলি জমি ও মাছের খামার। বসতভিটে হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন অসহায়-নীরিহ লোকজন।

গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলার লক্ষীটারি ইউনিয়নের ইচলি ও পূর্ব ইচলি এলাকার শতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই দুইটি গ্রামে প্রায় ৭ শতাধিক পরিবারের বসবাস। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় এই এলাকায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। এলাকাবাসী জানান, আগে এই এলাকায় নদী ভাঙন ছিল না। বেড়িবাঁধ না দেয়ায় নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন রোধে এখনি জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে এই গ্রাম দু’টিকে রক্ষা করা যাবে না। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ১৫টি চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অসংখ্য ফসলি জমি, ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা চরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নির্মিত বাঁধটি গত মাসে ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে তিস্তার পানি সামান্য বাড়লেই বিভিন্ন এলাকায় বানের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়ে পড়ছে।

কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু জানান : উজানে বৃষ্টিপাতের কারণে কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। রোববার সকালে ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়াও বেড়েছে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। তিস্তা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৩১ সে.মিটার, ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারীতে ৩০ সে.মিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ৯০ সে.মিটার বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান। এদিকে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করায় ফসলি-জমিসহ বসতবাড়িতে পানি ওঠা শুরু করেছে। ফলে দুশ্চিন্তায় পরেছে বোরো চাষিরা।

আমানত উল্যাহ-রামগতি ও কাজী মো. ইউনুছ কমলনগর (লক্ষীপুর) থেকে জানান, লক্ষীপুরের রামগতি উপজেলায় মেঘনানদীর ভয়াবহ ভাঙন তান্ডব চলছে। প্রতিদিনের অব্যাহত ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে এই দুই উপজেলা। জানা গেছে, লক্ষীপুর সদর উপজেলা থেকে রামগতি পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ৩২ কিলোমিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় অব্যাহত ভাঙনের মুখে রয়েছে কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি, সাহেবেরহাট, চরফলকন, চরলরেন্স ও পাটারিরহাট ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা। ভাঙছে রামগতি উপজেলার বালুরচর, বাংলাবাজার, চরগাজী, চরআলগী, সেবাগ্রাম, বড়খেরী, চররমিজ, চর আবদুল্লাহ ও চর আলেকজান্ডার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা। লক্ষীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমেদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রাথমিক সাড়ে তিন কিলোমিটারের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।



 

Show all comments
  • মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল ২৩ আগস্ট, ২০২১, ৭:২৩ এএম says : 0
    ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার রাস্তাঘাট , ফসলীজমিসহ বসতবাড়ি পদ্মানদীতে ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।প্রশাসনকে অতি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যার অবনতি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ