বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
কালাম ফয়েজী :রাজনীতি এবং ব্যবসা দুটোই অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং দুটোতেই পুঁজি এবং লোকলস্কর অপরিহার্য। দুটো কাজেই প্রবল আগ্রহ এবং সতর্কতা প্রয়োজন। দুটো পেশার চরিত্র এবং প্রকৃতি প্রায় এক হলেও এক স্থানে গিয়ে দুটো আলাদা হয়ে যায়। দুটো পথ দুই রূপ চরিত্র পরিগ্রহ করে।
রাজনীতি এবং ব্যবসার প্রাথমিক চরিত্র ও প্রকৃতি প্রায় এক বলে অনেকে ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলেন এবং চৌকস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেউ কেউ রাজনৈতিক আচরণ ও শিষ্টাচার লাভের চেষ্টা করেন। অবোধ-অবুঝ কর্মীরা যখন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যবসাসুলভ আচরণের মুখোমুখি হয় তখনই তারা বুঝতে পারেন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের মধ্যকার দুস্তর ব্যবধান। তখন আর আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করে অনুসারীদের বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না, এই লোক ব্যবসায়ী। তার রাজনীতির পেছনে ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ। যেদিন স্বার্থের ওপর আঘাত আসবে সেদিনই তিনি রাজনীতি ত্যাগ করে ঘরে উঠে যাবেন। এতটা ঝুঁকিতে তিনি আর যেতে চাইবেন না। যাতে তার ব্যবসা লাঠে উঠে বা মালামাল বেহাত হয়ে যায়। কারণ তিনি দেশের স্বার্থ এবং জনতার ভালোবাসার চেয়ে তার সম্পদকেই অধিক ভালোবাসেন এবং এটাই ব্যবসায়ীর চরিত্র।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি, জগৎশেঠ ছিলেন নবাব সিরাজুদ্দৌলা তথা বাংলা বিহার উড়িষ্যার অর্থ উপদেষ্টা। তার আগে ছিলেন মুর্শিদাবাদের একজন সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী। তাকে কিন্তু সিরাজুদ্দৌলাই প্রথম অর্থ উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেননি। এ পরিবারের পূর্ব পুরুষ মানিক চাঁদ এ পদ পান বাংলার দিউয়ান মুর্শিদকুলি খানের আমলে। এরপর থেকে পরিবারটির প্রধান পুরুষ অলিখিতভাবে অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সিরাজ উত্তরাধিকার সূত্রে জগৎশেঠের পঞ্চম পুরুষ মাহতাব চাঁদকে ওই পদে উপদেষ্টা হিসেবে পান। সবাই জানেন নবাব সিরাজুদ্দৌলা খুব বেশি সময় নবাবী করতে পারেননি। তার সভাসদদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত আর ইংরেজ বাহিনীর চাতুর্যপূর্ণ কূটচালে তিনি অচিরেই পরাজিত হন। সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের চার চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেও চতুর্থ যুদ্ধে তথা পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হন এবং তাতেই বাংলার স্বাধীনতা সূর্য চিরতরে অস্তমিত হয়ে যায়।
তৃতীয়বারের যুদ্ধ ছিল কলকাতা ও কাশিম বাজার উদ্ধার। এ যুদ্ধের পর যখন সিরাজ পরবর্তী যুদ্ধের রসদ ও গোলাবারুদ কেনার জন্য জগৎশেঠের কাছে অর্থ চাইলেন তখন জগৎশেঠ তা দিতে অস্বীকার করলেন। শুধু অস্বীকারই করলেন না। অর্থের জন্য চাপ দিলে জগৎশেঠ সমূদয় অর্থ ও অলংকারের সিন্দুকগুলো পোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ইংরেজ হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। তিনি যেহেতু একজন ব্যবসায়ী, তিনি অর্থের মূল্য বোঝেন। বোঝেন বলেই তিনি কোনো কারণে একে হাতছাড়া করতে চাইলেন না। একে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে তিনি ইংরেজদের সহযোগিতা নিলেন। তাদের আশ্রয়ে সমূদয় টাকা পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি তার এ ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিচ্ছেন, দেশের মাটি পরদেশের হাতে চলে যাচ্ছে সেটা নিয়ে তিনি একবারও ভাবলেন না। তার ধারণা সিরাজুদ্দৌলা গোল্লায় যাক, তার সম্পদ রক্ষা হলেই চলে। কিন্তু স্বাধীনতা চলে গেলে যে সম্পদও হাতছাড়া হয়ে যায়, এটা জগৎশেঠের অনুধাবন করতে অনেক সময় লেগে গেল।
এবার আসা যাক কে এই জগৎশেঠ সে প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এ প্রসঙ্গে কিছু বলা আবশ্যক মনে করছি। জগৎশেঠ মানে বিশ্ব ব্যাংকার। এটি একটি উপাধি মাত্র, নাম নয়। যাকে প্রথম এ উপাধি দেয়া হয় তার নাম মানিক চাঁদ। মোগল আমলে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনকুবের মানিক চাঁদ ফররুখশিয়ার কর্তৃক এ উপাধি পান। মোগল সম্রাট মাহমুদ শাহ মানিক চাঁদের পুত্র ফতেহ চাঁদকে এ উপাধি দেন। বাংলার সুবেদার মুর্শিদ কুলি খাঁর আনুকূল্যে এ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়। মোগল আমলে এ পরিবারটি এত ধনবান ছিল যে, মুর্শিদাবাদ সরকারের ওপর এ পরিবারের আধিপত্য ছিল ভয়াবহ। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে এ পরিবারের সাহায্যের প্রয়োজন হতো। মুর্শিদাবাদে ব্যবসার প্রধান দফতর ছাড়াও শাখা দফতর ছিল দিল্লি, ঢাকা, পাটনা, সুরাট ও কলকাতা।
ফতেহ চাঁদের পর তার পৌত্র মাহতাব চাঁদ ১৭৪৪ সালে ‘জগৎশেঠ’ উúাধি লাভ করেন। তিনি আলীবর্দী খাঁর সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। রাষ্ট্রের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খরচে তাদের অর্থের দরকার হতো। এই সুযোগে সিরাজের দুই ভাইকে বৈরী করে তোলে। সিরাজের চাপে অতঃপর মাহতাব চাঁদ ইংরেজের সঙ্গে হাত মিলায় এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। রাজনীতি ও দেশের স্বার্থ তার কাছে গৌণ হয়ে যায়। তার কাছে নিজ স্বার্থ ও সম্পদ রক্ষাই বড় হয়ে দেখা দেয়। অতঃপর ১৭৬৩ সালে মীর কাসিম তার সভাসদ থেকে জগৎশেঠ তথা মাহতাব চাঁদকে বহিষ্কার করেন এবং তার মৃত্যুদ- কার্যকর করেন। ১৭৬৫ সালে বাংলার বিহার উড়িষ্যার দেউয়ানি ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে গেলে এ পরিবারের চূডান্ত পতন ঘটে।
জগৎশেঠ নিয়ে আলোচনা করার একটা বিশেষ কারণ হলো, আমাদের দেশেও আজ ব্যবসা দ্বারা রাজনীতি প্রভাবিত। সামরিক বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের নির্দেশে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়। তাদের খেয়ালখুশি মতো পদবিন্যাস হয়। তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, আমাদের রাজনীতির কি দৈন্যদশা। কেমন বেহালে এর দিন চলে।
নিঃসন্দেহে অর্থ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশ-সমাজ ও ব্যক্তির চলার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। একজন ব্যক্তি রাজনীতি না বুঝলেও তার চলার জন্য অর্থের দরকার হয়। টাকা না থাকলে তার দিন চলে না, সংসার চলে না, সামাজিক মর্যাদাও ঠিক রাখা যায় না। এ জন্য ব্যক্তি, সমাজ, দেশ প্রত্যেকের হাতে যার যার পরিমাণে অর্থ থাকা বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে রাজনীতি নেই। মানুষের ভোটাধিকার নেই, ভোট কি জিনিস তাও তারা জানেন না। সেখানে রাজার ইচ্ছায় রাজ্য চলে এবং জন্মসূত্রে রাজারা রাজত্বের মালিক হন। সেসব দেশ যত হতদরিদ্র হোক, অর্থ ছাড়া সে দেশও অচল।
বর্তমানে ফাস্ট ওয়ার্ল্ড, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ও থার্ড ওয়ার্ল্ড বলতে কতগুলো শব্দের ব্যবহার আছে। এ শব্দগুলো অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন নয় যে, ফাস্ট ওয়ার্ল্ড বলতে অন্য গ্রহের অন্য পৃথিবীকে বুঝানো হয়। আর থার্ড ওয়ার্ল্ড বলতে পৃথিবী নাম গ্রহকে বুঝানো হয়।
ফাস্ট ওয়ার্ল্ড বলতে অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ দেশকে বুঝানো হয়। আর থার্ড ওয়ার্ল্ড বলতে নিতান্তই দরিদ্র দেশগুলোতে বুঝানো হয়। আফ্রিকা আর এশিয়ার কিছু দরিদ্র দেশ এর অন্তর্গত। যেসব দেশ আজ অর্থবিত্তে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ তাদের অস্ত্র আর গোলাবারুদ থাক না থাক সবাই তাদের কথা দ্বারা প্রভাবিত। যেমন জাপানের হাতে আণবিক শক্তি নেই। তারপরও অর্থের জন্য তারা প্রথম শ্রেণির সাত দেশের অন্তর্গত।
প্রথমে সমৃদ্ধ দেশের সংখ্যা ছিল সাত। যাকে বলা হতো জি-৭। এখন এর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ এ, যাকে বলা হয় জি-২০। গত মাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে জি-২০ এর একটি শীর্ষ বৈঠক হয়ে গেল তুরস্কের ইস্তা¤ু^লে। সেখানে বিশ্বের বড় দেশের বড় বড় নেতারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করলেন। তারা নিজেরা প্রত্যেকেই কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অথচ আলোচনা করেছেন রাজনীতির নিয়ে নয়, অর্থনীতি নিয়ে। এ থেকে বোঝা যায় পৃথিবীকে গতিশীল রাখার জন্য অর্থ কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
একজন মানুষের জীবনে অর্থ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠিকই কিন্তু সে যদি সদা অর্থ চিন্তা দ্বারা চালিত হয় তবে তার পক্ষে অর্থের উন্নতি ছাড়া অন্য কোনো দিকে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। মানুষসহ সব প্রাণির পেট শরীরের মাঝামাঝি একস্থানে লুকায়িত। পেট লুকায়িত বলে সে ইচ্ছেমতো ছুটতে পারে। কেবল চিংড়ি মাছের পেট তার মাথার ওপর। এ জন্য অন্য মাছের তুলনায় চিংড়ি মাছের গতি খুব সীমিত। তেমনি আমাদের সমাজে যার পেটে ক্ষুধা বেশি যে দিন আনে দিন খায় বা সব সময় অর্থচিন্তা, খাবার চিন্তা দ্বারা তাড়িত হয়, চিংড়ি মাছের মতো তার গতিও খুব সীমিত। সে যে কোনো কর্মের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভালাভ ও স্বার্থসিদ্ধির চিন্তা করবে। এ জন্য দেখা গেছে, একজন ব্যবসায়ীর দিন শুরু হয় টাকার হিসাব কষতে কষতে, তার দিন শেষ হয় টাকার অংক মিলাতে মিলাতে। তাহলে তার পক্ষে দেশের কল্যাণ, দেশের চিন্তা, মানুষের সেবা কীভাবে সম্ভব?
একজন ব্যবসায়ী সে যত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হোক বা বড়, সে সবসময় অর্থের মাপকাঠিতে বিচার করেই তারপর কাজে হাত দেবে। কাজে হাত দিলেই বুঝতে হবে সেখানে তার লাভ আছে। লাভ না থাকলে তিনি ঝুঁকিতে যেতেন না।
আজও তেমনি সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসছেন। এখানে এসেই টাকার প্রভাবে সবর ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন, এটা কেবল দুই কারণে সম্ভব হচ্ছে। প্রথমত রাজনীতিকদের ব্যর্থতা, দ্বিতীয় ব্যবসায়িকভাবে দ্রুত লাভবান হওয়ার ধান্ধা। তারা জানেন অর্থের সঙ্গে যদি ক্ষমতার মিশ্রণ ঘটানো যায়, আর সেই মিশ্রণের শক্তিটা যদি ব্যবসায়ীর নিজেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে তার বিত্তশালী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেখা গেছে, একজন ব্যবসায়ী রাজনীতির পদ দখল করে ইংরেজ বেনিয়াদের মতো ব্যবসায়িকভাবেও সে সফল হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবেও সে গেইন নিচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে যারা মাঠে ময়দানে স্লোগান দেয়, দেশ উদ্ধার করবে বলে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, নিজের অঙ্গীকার ঠিক রাখতে গিয়ে সবকিছু বিসর্জন দেয়, সেই আত্মত্যাগী ও কমিটেড লোকদের কোনো উপহার তার ভাগ্যে জোটে না। দীর্ঘদিন ধরে লালিত আশা শ্রম ও ত্যাগ সব মুহূর্তে কর্পূরের মতো উড়ে যায়। ফলে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ লোকরা রাজনীতির অঙ্গন থেকে হারিয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বের ২০টি ধনী দেশ যদিও অর্থবিত্ত, টেকনিক-টেকনোলজির জন্যই প্রথম বিশ্ব, তবু তারা সব সময় অর্থবিত্ত দ্বারা চালিত হয় না। তাদের রাজনীতিকরা রাজনীতি করেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা নিয়ে ভাবেন। তবে ব্যবসায়ীরা আরও কীভাবে বেশি বেশি ব্যবসা করতে পারেন, নিজের দেশের গ-ি ছাড়িয়ে অন্য দেশে ব্যবসা নিয়ে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা করে দেন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা। সেসব দেশেও ব্যবসায়ীরা নিজেদের বৃত্তের বাইরে এসে রাজনীতিতে যুক্ত হন, কেউ কেউ নির্বাচিত হন, কেউ কেউ দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনাও করেন। মজার ব্যাপার হলো, একটু খেয়াল করলে দেখা যায় ফাস্ট ওয়ার্ল্ডের প্রতিটি দেশের নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি কিন্তু রাজনীতিকরা, ব্যবসায়ীরা নন। সেসব দেশে রাজনীতি নিজস্ব ঢঙে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে বলেই ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এলেও রাজনীতির রূপেই নিজেদের চিন্তাচেতনাকে রূপান্তরিত করে নেন।
যে কোনো পেশা থেকেই যে কোনো ব্যক্তি নিজের সুবিধা মতো অন্য পেশা গ্রহণ করতে পারেন। যিনি মসজিদের ইমাম তিনি স্কুল শিক্ষক হতে পারবেন না, তা নয়। বা তার পক্ষে ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়াও অন্যায় নয়। রাজনীতি তো আরও ওপেন। এর জন্য পুঁজিরও দরকার হয় না, কঠিন ঝুঁকিও নিতে হয় না। তবে যে যেই পেশায়ই যাক, তাকে যে রূপ, সে পেশার চরিত্র অবলম্বন করতে হবে। তেমনি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাও রাজনীতি করবেন, রোনাল্ড রিগানের মতো হলিউড অভিনেতা রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন। শর্ত হচ্ছে তাকে পূর্বকার চিত্র জগতের চেনা কালচার পরিবর্তন করতে হবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইংরেজরা আমাদের ব্যবসা শিখিয়েছে, ব্যবসার মধ্যকার ধড়িবাজি, চাপাবাজি, সবই তোতা পাখির মতো আমরা তাদের কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু তারা আমাদের রাজনীতি শেখায়নি। কৌশলে কেবল রাজনীতি থেকে দূরেই রাখেনি, যারা রাজনীতি করতে গেছে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী উপাধি দিয়েছে, হাতে হাতকড়া লাগিয়েছে বন্দী করে জেলে পুরে রেখেছে। ভয় একটাই ছিলÑ রাজনীতি করতে দিলে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এমন মজার জিনিস কি হাতছাড়া করা যায়? এ জন্য ভারতীয়দের রাজনীতি শিখতে হয়েছে নিজের ইচ্ছায়, মাঠেও নামতে হয়েছে প্রবল শক্তি নিয়ে। বাধা অতিক্রম করতে গিয়ে কত লোক বিল্পবী হয়েছে। কত যুবক অকালে প্রাণ হারিয়েছে। সেই কঠিন পথে অর্জিত রাজনীতি-রাজনৈতিক জ্ঞান আজ একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ীর টাকার কাছে জিম্মি। সে যেভাবে বলে রাজনীতি সেভাবেই চলে। সে দয়া করে যাকে পদ দেয় সেই পদাধিকারী হয়। আর পদ পয়সায় বিকিকিনি হয় বলে এখন আর কেউ পদ পাওয়ার জন্য শ্রম দেয় না, সংগঠন করাও দরকার মনে করে না। রাজনীতি দিয়ে রাজনীতি মোকাবেলা করতে হয়। ব্যবসায়িক আইডিয়া দিয়ে রাজনীতি চলে না। প্রতিপক্ষকেও ঘায়েল করা যায় না। রাজনীতি উপরের জিনিস। এখানে পেশাদারিত্ব একান্ত আবশ্যক।
পেশাদার খেলোয়াড় তার খেলায় যতটা দক্ষ অন্য পেশায় নিয়োজিত লোকরা কি ওই রকম দক্ষতা দেখাতে পারে? পারে না। একজন ব্যবসায়ী বা আমলা যদি রাজনীতির কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে ভুল হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
রাজনীতি এবং ব্যবসা দুটোর চরিত্র এক হলেও গতি-প্রকৃতি আলাদা। ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় লাভের আশায়। আর রাজনীতির পেছনে সময় অর্থ ও শক্তি ব্যয় হয় গৌরব বৃদ্ধির জন্য। এখানে লাভটা ব্যবসার চেয়েও বড়, যদি কর্মে সাফল্য আসে। একজন সৈনিক যুদ্ধে যায়, জীবন-মৃত্যু, সাফল্য-ব্যর্থতা দুটোরই সে মুুখোমুখি দাঁড়ায়। যদি সে বিজয়ী হয়, গাজী হয়ে ফিরতে পারে। ইতিহাসে তার নাম লেখা হয়। আর যদি ব্যর্থ হয় বিচারে তার মৃত্যুদ- নির্ধারিত। মৃত্যুর কথা জেনেও সৈনিক যুদ্ধে যায়। তেমনি রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। রাজনীতি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার পথ জেনেও লোকজন রাজনীতি করে এবং সাফল্য পাওয়ার জন্য লড়াই করতে থাকে। এখানে সেবা এবং ত্যাগের প্রভাবই বেশি।
এখন যদি প্রশ্ন ওঠে, কার সেবা করার শক্তি আছে, কে ত্যাগের মানসিকতা রাখে? ত্যাগের পূর্বশর্ত হলো অর্জন যার অর্জন নেই সে ত্যাগ করবে কেমন করে? যে নিঃশ্বাস টানতে পারে না, সে ছাড়বে কেমন করে? যার পকেটে অর্থ নেই, সে খরচ করবে কেমন করে? কথায় বলে রাজনীতির জন্য আগে চাই অর্থ। আমাদের সমাজে এ কারণে বংশপরম্পরায় যারা বিত্তশালী তাদের কেউ কেউ রাজনীতিতে জড়ায়। সমাজে কর্তৃত্ব করে বুনিয়াদি পরিবারের বাছাই করা লোকরা। কিন্তু গণতন্ত্র আসার পর রাজনীতি মাঠলেভেল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। সমাজের যে কেউ এখন নির্বাচন করতে পারে। মনোনয়নপত্র দাখিল করে রীতিমতো ভোটও দাবি করতে পারে। এই যে রাজনীতি মাঠলেভেল চলে গেল। এর জন্য আমাদের মতো অতি সাধারণ ঘরের লোকরাও রাজনীতি চর্চা করতে পারে। রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে। অতি চতুর কেউ কেউ নির্বাচিতও হয়ে যেতে পারেন।
গণতন্ত্রের কারণে রাজনীতি সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর ব্যবসা থেকে, আমলাতন্ত্র থেকে এসে লোকজন রাজনীতিতে জড়াচ্ছে এবং রাজনীতি থেকে ফায়দা নিচ্ছে। আর আমাদের দেশে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না থাকায় সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী-আমলারা সুযোগ বুঝে রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছে। তারা জোয়ার দেখলে পাল তোলে, গুরুর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনে কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু রাজনীতির প্রয়োজনে এক টাকাও খরচ করতে প্রস্তুত নয়। এমন ব্যবসায়ীদের দিয়ে আর যা হোক রাজনীতি চলে না। দুর্দিনে তাদের ওপর ভরসা করেও সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে রাজনীতিকদের হাতেই। যদি আগামী দিনে বিএনপির রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের হাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে তবে খুব সহজে তারা তাদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে পারবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা টিকে থাকার জন্য তাদের লীগের রাজনীতির মতো চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে না।
জগৎশেঠরা ব্যবসা করুন, সেটা যত বড় ব্যবসাই হোক। তাদের রাজনীতিতে থাকতে হলে সিরাজুদ্দৌলার মতো ত্যাগের মানসিকতা নিয়েই নামতে হবে। যদি পারেন, তাদের রাজনীতিতে সুস্বাগতম।
য় লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।