Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পেশা বদলাচ্ছে মানুষ

বিপন্ন মানুষের জন্য বাজেটে কিছুই রাখা হয়নি : ড. ইফতেখারুজ্জামান বাঁচার তাগিদে পেশাগত পরিচয় পরিবর্তন করেন : অধ্যাপক জিনাত হুদা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ এএম

১১ আগস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে সবকিছু খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ মানুষ নিজের পুরনো পেশায় ফিরতে পারবেন না। তারা নতুন নতুন পেশায় পরিচিত হয়ে উঠবেন। করোনাকালে পরিবারের সদস্যদের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে ছোট ছোট পেশায় জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হলেও তাদের বড় অংশ চাকরি ফিরে পাবেন না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিপন্ন পেশাজীবীদের জন্য চলতি অর্থ বছরের বাজেটে কিছুই রাখা হয়নি।

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনের গতি। প্রায় দেড় বছর ধরে লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধসহ নানান বিধিনিষেধে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে হাজার হাজার মানুষ পেশা বদল করেছেন। শুধু সংসারের দু’মুঠো ভাতের জোগান দিতে স্কুল শিক্ষক হয়ে গেছেনÑ সবজি বিক্রেতা, আদালতের আইনজীবী হয়ে গেছে ইউটিউবার, কর্পোরেট হাউসের কর্মকর্তা হয়ে গেছেন ফুটপাতের দোকানদার আবার গণপরিবহনের শ্রমিক হয়ে গেছেন রিকশাচালক। রাজধানী ঢাকায় এমন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ পেশা বদল করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এক জরিপে বলেছে, করোনা শুরু হওয়ার বিভিন্ন সময়ে ৬২ শতাংশ মানুষ চাকরি ও কাজ হারিয়েছেন। লাখ লাখ পরিবার করোনাকালে আয় রোজগার না থাকায় খাবার কমিয়ে দিয়েছেন। আবার লাখ লাখ পরিবার সঞ্চিত পুঁজি ভেঙে খেয়েছেন।

আগামী ১১ আগস্ট বিধিনিষেধ শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে সবকিছু খুলে দেয়া হবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো সবকিছুই খুলে দেয়া হবে। কিন্তু বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক কর্মজীবী পুরনো পেশায় ফিরে যেতে পারবেন না। তারা নতুন পেশায় রয়ে যাবেন। কারণ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। তারা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে টিকে থাকার জন্য পুরনো পেশা বদলে নতুন পেশা বা ব্যবসা করছেন। ওই সব ব্যক্তির জন্য সরকারি পর্যায়ে তেমন কিছু করার পরিকল্পনা না থাকায় তাদের বেশিরভাগই আগের পেশায় ফিরতে পারবেন না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, করোনায় পেশাজীবীদের ওপর বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে। গৃহকর্মী, দিনমজুর, ব্যাংককর্মী, উচ্চ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সবাই কোনো না কোনোভাবে করোনাকালে অর্থনৈতিক ধাক্কা খাচ্ছেন। এতে অনেকেই বাঁচার তাগিদে নিজেদের পেশাগত পরিচয় পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি যে কতভাবে রূপ নেবে তা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না।

রাজধানীর মগবাজার মডার্ন চাইল্ড স্কুলের শিক্ষক থমাস হাওলদার পেশাবদল করে এখন হয়েছেন সবজি বিক্রেতা। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আর্থিক কষ্টে পড়ে বাধ্য হয়ে ভ্যানে আলু-পেঁয়াজ-রসুন বিক্রি করছেন, স্ত্রী-তিন সন্তানের সংসার নিয়ে ঢাকায় টিকে রয়েছেন। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম দেখলাম আমার সংসার চালানো কষ্ট হচ্ছে, তখন চিন্তা করি বাজার থেকে কিছু কিনে এনে যদি বিক্রি করতে পারি, তাহলে অন্তত সংসারের খরচটা হয়ে যাবে। ভ্যানের সম্পূর্ণ টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। পরিচিতরা ভাবে যে, অন্য জায়গা থেকে না নিয়ে স্যারের কাছ থেকে নেই। মো. ছলিম উদ্দিন মাদরাসার শিক্ষক। তিনি নিউ মার্কেটের ফুটপাতে গামছা-রুমাল বিক্রি করেন।

তিনি জানান, সংসারের পোষ্যদের মুখের ভাত জোটাতে বাধ্য হয়েই এই পেশায় এসেছি। বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন হোসেন আলী। তিনি এখন যাত্রাবাড়ীতে মুদির দোকান করেন। গণপরিবহন শ্রমিক আনোয়ারুল হক এখন রিকশাচালক হয়েছেন। আবদুর রব রাজধানী ঢাকায় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। চাকরি হারিয়ে ঢাকায় টিকতে না পেরে রংপুরের গ্রামে গিয়ে পুকুরের মাছ চাষ ও জমিতে সবজি চাষ করে জীবন নির্বাহ করছেন। খালিদ হোসেন নামের ঢাকা বারের একজন আইনজীবী পেশা বদল করে একটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালের শেষের দিকে আইনজীবীর সনদ পেয়ে এক বছর কাজগুলো গুছিয়ে নেই। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ। পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করে পেশা বদল করেছি। ইসলামপুরের বড় কাপড়ের দোকানে মোটা বেতনে চাকরি করতেন সুজন বড়–য়া। মার্কেট বন্ধ থাকায় সংসারের অনটন দূর করতে রাজধানীর মিরপুরে ছোট একটি টেবিল নিয়ে পথে পথে মাস্ক, স্প্রে মেশিন ও বোতল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করেন।

সুজন বড়–য়া বলেন, লকডাউনে দীর্ঘদিন ধরে দোকান বন্ধ রাখায় চাকরি হারিয়েছি। এ অবস্থায় সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে এই দু-তিন মাস ঘরভাড়া, সন্তানদের পড়ালেখা এবং খাবারের খরচ চালালেও শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী বিক্রি করছেন। কাজ হারিয়েছেন হোটেল-রেস্টুরেন্টের অনেক কর্মচারী। মতিঝিলের এক খাবারের হোটেলের কর্মচারী সলিম উদ্দিন কাজ হারিয়ে এখন গুলিস্তানে মাস্ক বিক্রি করেন। তিনি জানান, চাকরি হারিয়ে দু’মাস গ্রামে ছিলাম। এখন ঢাকায় এসে মাস্ক বিক্রি করছি। প্রতিদিন দুই থেকে তিনশ’ টাকা আয় হয়।
মো. ছলিম উদ্দিন, হোসেন আলী, থমাস হাওলদার, আনোয়ারুল হক, সলিম উদ্দিন, সুজন বড়–য়া, খালিদ হোসেন, আবদুর রবের মতো লাখ লাখ পেশাজীবী করোনা মুক্তির পর নতুন পেশায় থেকে যাবেন। কারণ তাদের অনেকেই পুরনো প্রতিষ্ঠান চাকরিতে নেবে না।

জানতে চাইলে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থবছরের বাজেটে পিছিয়ে পড়া গরিব, অসহায় এবং চাকরি হারানো মানুষদের জন্য কিছুই রাখা হয়নি। বাজেটে বরাদ্দের কথা বলা হলেও কীভাবে তা ব্যয় হবে, সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কতটুকু থাকবে সে বিষয়টি দেখা যায়নি। এছাড়া দুর্নীতির প্রতিরোধে বাজেটে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। পিছিয়ে পড়া মানুষকে কীভাবে সহায়তা করবে বাজেটে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেখতে পাই না। ফলে অনেক মানুষ করোনা-পরবর্তী সময়ে পূর্বের পেশায় ফিরতে পারবেন না।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় জানানো হয়, করোনাকালে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, আনুষ্ঠানিক খাতে বিভিন্ন অফিসে চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ করোনায় কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই, এমন মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। একইভাবে ২৫ ভাগ চাকরিজীবীরই বেতন কমে গেছে। তারা মাসিক বেতন আগের চেয়ে কম পাচ্ছেন। করোনা মহামারির কারণে গত ১ বছরে ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন। অনেকে পুনরায় কাজ শুরু করতে সক্ষম হলেও কমেছে অধিকাংশের আয়। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নিম্নআয়ের মানুষের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ‘করোনাকালে আয় ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি : কীভাবে মানুষগুলো টিকে আছে’ শীর্ষক খানা জরিপে বলেছে, দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ করোনাকালে কাজ হারিয়েছে। জরিপে জানানো হয়, সিপিডি ও অক্সফাম বাংলাদেশ যৌথভাবে জরিপ কাজটি পরিচালনা করে। দেশের ১৬টি জেলা এবং শহর ও গ্রাম মিলিয়ে বাছাই করা ২৬০০ পরিবারের তথ্য নিয়ে জরিপের কাজ পরিচালিত হয়। সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম খান জরিপের ফলাফলের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, জরিপে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ মানুষ করোনা শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। যার বড় অংশ ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে কর্মহীন হয়েছেন। পরে অনেকেই কাজে ফিরলেও আগের মতো আর চাকরি ফিরে পাননি। করোনার প্রভাবে ৭৮ শতাংশ মানুষ তাদের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন। ৫২ শতাংশ খরচ কমাতে গিয়ে খাদ্য অভ্যাস কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের ঋণের বোঝা বেড়েছে। ঋণ আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।

দেশের সমাজবিজ্ঞানীর বলছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে সমাজে অনেক পরিবর্তন আসবে। লাখ লাখ কর্মজীবী মানুষ নতুন ভাবে জীবন শুরু করবেন। বর্তমানে নিম্ন আয়ের বেতনভুক্ত কর্মচারী তারা বর্তমানে চরম অর্থনৈতিক ও মানসিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিচ্ছে না। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এরা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নতুন নতুন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এদের বেশিরভাগই পুরনো পেশায় ফিরতে পারবেন না।



 

Show all comments
  • Md Hridoy Khan ৯ আগস্ট, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
    পতিবেদন টি চোখে পানি এনে দেয়
    Total Reply(0) Reply
  • আকতার হোসেন ৯ আগস্ট, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
    আহারে আল্লাহ সবাইকে হেফাজতে রাখুন এবং রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করে দিন।
    Total Reply(0) Reply
  • Sajjad Hossen ৯ আগস্ট, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
    Thanks for ur responsibility to publish this news!!
    Total Reply(0) Reply
  • Salahuddin Mohammed ৯ আগস্ট, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
    সরকারের অবশ্যই এই অবহেলিত শিক্ষকদের দেখা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ এমরান সিকদার ৯ আগস্ট, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
    এগুলো কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ে না
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ