বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এসএম সাখাওয়াত হুসাইন
আজ ১ অক্টোবর উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য, ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালাহর হযরত মওলানা মুহাম্মদ অবদুর রহীম (রহ)-এর ২৯তম ওফাৎবার্ষিকী।
বাংলা ১৩২৫ সালের ৬ মাঘ, ইংরেজি ১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার কাউখালি থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পৈতৃক বাড়িতে স্থাপিত মক্তব ও ইবতেদায়ী মাদরাসায়। পরে শর্ষীণা আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৪০ সালে ফাযিল এবং ১৯৪২ সালে কামিল (প্রথম শ্রেণী) ডিগ্রি লাভ করে মুমতাজুল মুহদ্দিসীন উপাধিতে ভূষিত হন।
কৈশোরেই মওলানা আবদুর রহীমের মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তাঁর সাহিত্যিক বড় ভাইয়ের উৎসাহ ও প্রেরণায় তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত হন। এপর্যায়ে ছোটখাট কিছু পত্র-পত্রিকায় তিনি লেখালেখির কাজও শুরু করেন। সাড়ে ১২ বছর বয়সে তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়, পটুয়াখালীর একটি স্কুল ম্যাগাজিনে। এরপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ফাযিল শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে আবুল মনসুর আহমদ সস্পাদিত দৈনিক কৃষক, মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ, সুন্নাতুল জামাত ইত্যাকার পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম বই ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ প্রকাশিত হয়। এদেশের ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে এ বইটির প্রকাশনা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা কালেমা তাইয়্যেবা ইসলামের মূলমন্ত্র হলেও এ দেশের সাধারণ জনগণ এ কালেমার সঠিক তাৎপর্য জানতেন না। তারা শুধু একটা মন্ত্রের মতোই এর উচ্চারণ করতেন। এ কারণে কালেমা-বিশ্বাসীদের জীবন ও চরিত্রে তাওহীদী চেতনার কোনো প্রতিফলন ঘটত না।
বাংলা ভাষায় তিনি শুধু ইসলামী সাহিত্যের কলেবরই বৃদ্ধি করেননি, এ ভাষাকে ইসলামী বৈশিষ্ট্যে ম-িত করতেও তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। চল্লিশের দশক অবধি বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারা প্রকাশের উপযোগী কোনো পরিভাষা ছিল না। এর প্রায় সমগ্র পরিভাষাই ছিল শিরক ও পৌত্তলিকতাদুষ্ট। মওলানা আবদুর রহীম নতুন নতুন ইসলামী পরিভাষা উদ্ভাবন করে বাংলা ভাষাকে শিরক ও পৌত্তলিকতার জঞ্জাল থেকে বহুলাংশে মুক্ত করেন এবং ইসলামী সাহিত্যচর্চার পথ সুগম করে তোলেন। তিনিই প্রথম বাংলায় ‘ইসলামী জীবনব্যবস্থা’, ‘ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা’, ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’, ‘ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ ইত্যাকার পরিভাষা চালু করেন।
মওলানা আবদুর রহীমের মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ এবং অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও প্রায় ৭০। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁর মেধা ও প্রতিভার মূল্যায়ন করে ১৯৭৭ ও ১৯৮৩ সালে তাঁকে মৌলিক গবেষণা ও অনুবাদ কর্মের জন্যে দুটি পুরস্কার দিয়েছে।
মওলানা আবদুর রহীমের রাবিতা আল-আলম আল-ইসলামীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের সফল প্রতিনিধিত্ব থেকেই তাঁর এই খ্যাতির পরিধি আমরা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি। আশির দশকের প্রথমার্ধে তাঁর এই খ্যাতির পরিধি আরো বৃহত্তর অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অঙ্গ সংগঠন ‘ফিকাহ একাডেমি’র একমাত্র সদস্য নির্বাচিত হন। এ পদটি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক ও দায়িত্বপূর্ণ। ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে আধুনিক মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জটিল সমস্যার যথার্থ বিশ্লেষণ ও তার নির্ভুল সমাধান উদ্ভাবনই ছিল একাডেমির মুখ্য দায়িত্ব। মওলানা আবদুর রহীম এ দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সাথেই পালন করেন এবং এব্যাপারে অনেক সাহসিকতার পরিচয় দেন। পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সাথে কোনোরূপ আপস না করে একাডেমির বৈঠকে বিভিন্ন স্পর্শকাতর প্রশ্নে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং ১৯৬৬ সনে এ ভূখ-ে ৬ দফা আন্দোলন শুরুর ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ক্রমশই অনিশ্চিত হয়ে উঠছিল। এ পর্যায়ে সংগঠিত ‘পাকিস্তাান গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি কোনো কিছুই দেশের রাজনৈতিক দিগন্তকে মেঘমুক্ত করতে পারছিল না। মওলানা আবদুর রহীম চলমান এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খুবই হতাশা বোধ করছিলেন। ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ আন্দোলন যে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারবে না, এটা তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন। এ সময়ে জামায়াতের মধ্যে ‘ইংরেজি শিক্ষিত নেতৃত্বে’র অনুকূলে একটা সূক্ষ্ম প্রচার চলছিল (অধ্যাপক গোলাম আজমের পক্ষে)। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী আমিরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ‘নায়েবে আমির’ নিযুক্ত হন।
ডিক্টেটর আইয়ুব খান তাঁর অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে এক প্রহসনমূলক নির্বাচনের আয়োজন করলেন। এই সুযোগে দেশে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’র বাসনায় জামায়াতে ইসলামীসহ ৯টি দলের সমন¦য়ে গঠিত ‘সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহ’ কায়েদে আজমের বোন মুহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রার্থী রূপে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এ সিদ্ধান্ত দেশের সমগ্র ইসলামী মহলে প্রচ- বিতর্কের সৃষ্টি করল এবং জনমত স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। জামায়াতপ্রধান মওলানা মওদুদী ইতোপূর্বে নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে প্রচুর লেখালেখি করলেও জোটের পক্ষ থেকে ফাতেমা জিন্নাহ ও মনোনয়নকে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা’ হিসেবে সমর্থন জানালেন। মওলানা মওদুদীর ন্যায় ইসলামী ব্যক্তিত্বের এই অপ্রত্যাশিত ব্যাখ্যায় মওলানা আবদুর রহীম একটা প্রচন্ড হোঁচট খেলেন। তিনি একে একটি গুরুতর রকমের বিচ্যুতি বলে মনে করলেন। কিন্তু জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল এমনই যে, তাঁর এই ভিন্নমত দলে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারল না।
এসময় দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খুব দ্রুত অবনতি ঘটছিল। পাকিস্তানের বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সম্ভাবনাও ক্রমশ পরিস্ফুট হয়ে উঠছিল। এই প্রেক্ষাপটে মওলানা আবদুর রহীম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীকে সম্পূর্ণ স্বাধীন সংগঠনে পরিণত করার একটা উদ্যোগ নেন। কিন্তু বোধগম্য কারণেই তাঁর সে উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে সকল দায়িত্ব ন্যস্ত করে ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান ইসলামী ধারা-সম্বলিত ৮ দফা আইনগত কাঠামোর অধীনে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করলেন। এর ফলাফল যা আঁচ করা গিয়েছিল, ঠিক তা-ই দাঁড়াল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রচ- তোড়ে ইসলাম ও পাকিস্তানের সকল আবেদন খড়কুটার মতো ভেসে গেল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। মওলানা আবদুর রহীমও শেখ মুজিবের হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করার দাবি জানালেন। কিন্তু ক্ষমতালোলুপ জুলফিকার আলী ভুট্টোর হীনচক্রান্তে জেনারেল ইয়াহিয়া এতে বেঁকে বসলেন। ভুট্টো হুঙ্কার ছাড়লেন, মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তিনি কোনোক্রমেই মেনে নেবেন না।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী ‘বিদ্রোহ দমন’ ও ‘পাকিস্তান রক্ষার’ নামে ঢাকায় সামরিক কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করল। সমস্ত রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো, আপস-রফার সমস্ত সম্ভাবনা নিমেষে উবে গেল। শুরু হলো দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। জামায়াতে ইসলামী প্রথম এই পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নিল। মওলানা আবদুর রহীমও সেনা-অভিযানকে সমর্থন না দেয়ার জন্যে জামায়াত-প্রধান মওদুদীকে চিঠি দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দলটি নিরপেক্ষ থাকতে পারল না। সেনাবাহিনী ইসলাম ও পাকিস্তানপন্থী দলগুলোকে নিয়ে গঠন করল ‘শান্তি কমিটি’। এই ‘পন্থী’ প্রায় সব শীর্ষ নেতাই অন্তর্ভুক্ত হলেন এ কমিটিতে। কিন্তু ব্যতিক্রম রইলেন শুধু মওলানা আবদুর রহীম। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তিনি শান্তি কমিটিতে যোগ দান করার কোনো যৌক্তিকতাই খুঁজে পেলেন না। বস্তুত, সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ এই জনপদে এটি ছিল এক অসম-সাহসিক সিদ্ধান্ত।
মওলানা আবদুর রহীমের এই সাহসী ভূমিকাকে অনেকেই সুনজরে দেখলেন না। কেউ কেউ তাঁর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। তাঁর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানারূপ চাপ আসতে লাগল। ‘মুক্তি’ খোঁজার নামে সেনাবাহিনী কয়েক দফা গভীর রাতে তাঁর বাসভবনে তল্লাশি অভিযান চালাল। পাশাপাশি নানা প্রক্রিয়ায় তাঁকে ব্লাকমেইল করা হলো। এমনকি সেনাবাহিনী তাঁর অজ্ঞাতে তথাকথিত উপনির্বাচনে তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করল। কিন্তু মওলানা আবদুর রহীম স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন যে, এসব কিছুই হচ্ছে একটি সাজানো নাটক। এ ভূখ-ে পাকিস্তান নামটির কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। সেনাবাহিনীও অঞ্চলকে পাকিস্তানভুক্ত রাখতে চাইছে না। বরং ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর কার্যব্যবস্থা গ্রহণের পর বাংলাদেশের অভ্যুদয় শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই শান্তি কমিটির কোনো কোনো কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে তিনি বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু অত্যুৎসাহী নেতারা তাঁর কথার মর্ম বুঝতে চাইলেন না; বরং কেউ কেউ উল্টো তাঁকে ভুল বুঝলেন। এমনকি, কেউ কেউ তাঁর মধ্যে ‘দূরদৃষ্টির’ অভাব খুঁজে বের করলেন। কিন্তু সময় তার আপন নিয়মেই এগিয়ে চলছিল। তাঁকে যারা ভুল বুঝেছিলেন, তাঁদেরই পায়ের নিচ থেকে দ্রুত মাটি সরে যাচ্ছিল।
১৯৭৫ সালের মধ্য-আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অভাবনীয় পটপরিবর্তন সাধিত হয়। এদিন এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর কয়েক মাস পর এক পাল্টা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ মোশারফ লাইমলাইটে আসেন। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি, বরং সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা পরিহার করে ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আস্থা’কে জাতীয় নীতিরূপে ঘোষণা করলেন। এর ফলে প্রকাশ্যে ইসলামী আন্দোলনের পথ সুগম হয়ে যায়। তবে বাস্তববাদী মওলানা আবদুর রহীম সাবেক আমলের পুরনো দলগুলোর নামে কাজ করার মোটেই পক্ষপাতী ছিলেন না। কারণ বাংলাদেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এসব দল বিশেষ কোনো আবেদন রাখতে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করতেন না। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টার ফলে সাবেক আমলের ইসলাম ও মুসলিম নামযুক্ত দলগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ না করে নতুন নামে একটি ঐক্যবদ্ধ ইসলামী দল গঠনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করল।
এ নিয়ে সাবেক নেতৃবর্গের মধ্যে অনেক মতবিনিময় হলো। সাবেক জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মওলানা আবদুর রহীম এবং তাঁর অন্য একজন সহযোগী এই নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া করার দায়িত্ব পেলেন। সে অনুসারে সাবেক জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ইত্যাদিসহ মোট সাতটি দল নিয়ে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ (সংক্ষেপে আইডিএল) নামে একটি নতুন দল গঠন করা হলো। ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এই নতুন দলটি আত্মপ্রকাশ করল। মওলানা আবদুর রহীম প্রথমত দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে বরিত হলেন। এক বছর পর অনুষ্ঠিত দলের নিয়মিত কাউন্সিল অধিবেশন তাঁকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করে।
প্রথমদিকে আইডিএলের তৎপরতা মোটামুটি সন্তোষজনকভাবেই চলছিল। নবতর প্রেক্ষাপটে ইসলামী দল-উপদগুলোর এই সম্মিলিত উদ্যোগ দেশের ইসলামী জনতার মনে একটি বলিষ্ঠ আশাবাদ জাগ্রত করে তুলেছিল। ১৯৭৯ সালে আইডিএল-মুসলিম লীগের যৌথভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মওলানা আবদুর রহীমসহ এ দুই দলের ২০ জন প্রার্থী জয়লাভ করে। কিন্তু আইডিএলের কিছু মানুষের সঙ্কীর্ণ মানসিকতা ও বিভেদকামী আচরণের ফলে অচিরেই এই আশায় গুড়ে বালি পড়ল। রাজনৈতিক দলবিধির অবলুপ্তির সুযোগে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের পুরনো দল পুনরুজ্জীবিত করে নবতর ঐক্যবদ্ধ দল আইডিএল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
বিপ্লবী চেতনার সাথে এই নবতর উপলব্ধিকে তিনি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলেন। তাঁর নিজস্ব সংগঠন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল)-ও এই চেতনার অনুকূলে সুস্পষ্ট জনমত গড়ে ওঠে। এরই পরিণতিতে আইডিএলের ১৯৮৩ সালের ২৮ অক্টোবরের কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৮৪ সালের ৩০ নভেম্বর দলটি ‘ইসলামী ঐক্য আন্দোলন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
পরবর্তীকালে তাঁকে কেন্দ্র করে দেশের ছোট-বড় এগারটি সংগঠন ও কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে নিয়ে ‘খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি বৃহত্তর মোর্চা গড়ে উঠে। এ মোর্চার জন্যে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার অপসারণ, একটি অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ এবং গণভোটের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত ইসলামী সংবিধান অনুমোদনÑ এই তিন দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হলো। প্রকৃতপক্ষে মওলানা আবদুর রহীম ছিলেন এই মোর্চাটির প্রাণ-পুরুষ। তিনিই আপ্রাণ চেষ্টা করে বিভিন্ন মত ও পথের লোকদের এই মোর্চার ছায়াতলে সমবেত করেন। প্রায় দুই বছরকাল এই মোর্চা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বৈরশাহীর উপজেলা নির্বাচনের বিরুদ্ধে এ মোর্চা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে দেশের ইসলামী জনতা মোর্চাটির ব্যাপারে প্রচ-ভাবে আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই আশাবাদকে বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি। ১৯৮৫ সালে ঢাকার মানিক মিঞা অ্যাভিনিউতে ঐতিহাসিক জনসমুদ্রের সফল আয়োজনের পরই ইসলাম-বৈরী শাসক শক্তি অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে এবং খুব কৌশলে হাফেজ্জী হুজুরের নিজস্ব দলটিকে ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে সম্পৃক্ত করে মোর্চার পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করে। ফলে অচিরেই বিপুল সম্ভাবনাময় এই মোর্চাটির অপমৃত্যু ঘটে।
নতুনভাবে একটি ইসলামী মোর্চা গঠনের জন্যে তিনি আবার সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিলেন। প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও ব্যক্তিত্বের সাথে অব্যাহত যোগাযোগের পর ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’ নামে একটি মোর্চা গঠন করা হলো। দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট পীর-মাশায়েখ এ মোর্চায় সানন্দে যোগ দিলেন। সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের অনুরূপ জিহাদী কর্মনীতি ও কর্মধারাই স্থির করা হলো নবগঠিত এ মোর্চার জন্যে। মওলানা আবদুর রহীম এ মোর্চার উদ্যোক্তা প্রাণপুরুষ হলেও এর প্রধান মুখপাত্র নিযুক্ত করা হলো চরমোনাইর পীর মওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম সাহেবকে। এবারও তিনি ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তিগত ত্যাগ-তিতিক্ষার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন। প্রথমদিকে এ মোর্চাও যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে কাজ করল। বিশেষত, ঐ বছরই ১৩ মার্চ এই মোর্চা ঢাকায় এক ঐতিহাসিক গণ-সমাবেশের আয়োজন করে সবাইকে একেবারে হতবাক করে দিল। এ সমাবেশ উপলক্ষে মওলানা আবদুর রহীম (রহ.) নিজেও পুলিশের হাতে নিগৃহীত হলেন। কিন্তু মোর্চার এই বিপ্লবী চরিত্রকে বেশিদিন আর টিকিয়ে রাখা যায়নি।
১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজিমপুর গোরস্তানে তাঁকে চিরতরে সমাহিত করা হয়।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।