বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের আট তারিখে জাতিসংঘের আহ্বানে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও বিগত ৮ সেপ্টেম্বর ওসমানী মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহব্যাঞ্জক ঘোষণা ছিল, দেশে যাতে এক শতাংশ মানুষও নিরক্ষর না থাকে সরকার সে ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে ও বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে জানা যায়, দেশে সাক্ষরতার বর্তমান হার হচ্ছে ৭১% অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার ২৯% এখনো নিরক্ষর। দেশের চার ভাগেরও এক ভাগের বেশি মানুষ নিরক্ষর থাকাটা আর যাই হোক কোনো স্বস্তিকর অবস্থা নয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও আমরা মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নিচের দিকে স্থান করে নিতে পেরেছি কিন্তু নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে দেশকে এখনো মুক্ত করতে পারিনি।
সাক্ষরতা হচ্ছে শিক্ষালাভের প্রথম তোরণ। সাক্ষরতা অর্জন ছাড়া কোনো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষার তোরণসমূহ অতিক্রম করে নিজ নিজ দক্ষতা ও পছন্দ অনুযায়ী কোনো পেশাগত জীবন শুরু করতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আমরা যে সত্যের মুখোমুখি হই তা হলোÑ প্রথমত শিশুদের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দুটি ত্রুটি এখনো মারাত্মকরূপে প্রকট হয়ে দেখা দেয়। প্রথমত ন্যূনতম সাক্ষরতা বা বিদ্যালাভের সময়ের আগেই বিপুলসংখ্যক শিশু জীবিকার প্রয়োজনে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে অর্থাৎ বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখনো বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ২৪%। তুলনামূলক উদ্ধৃতি টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০০৭ সালে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৫০ শতাংশেরও সামান্য বেশি।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয়ত যে সত্যটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক তা হচ্ছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ বা ৭৭ কোটিরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ রয়েছে যারা বিদ্যালাভের কোনো সুযোগই পায়নি। আরো পরিতাপের বিষয় এই যে, এই বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশই হচ্ছে নারী। বয়স্ক নিরক্ষর নারী ও পুরুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো সকল শিশুকে শিক্ষালাভের সুযোগদানের পাশাপাশি যে প্রস্তাব গ্রহণ করে, সেসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও এখন পৃথিবী নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারত। জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার দীর্ঘদিনের গবেষণা, নিরীক্ষা ও অসংখ্য আঞ্চলিক আলোচনা চক্রের সমাপ্তিস্বরূপ ২০০০ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ১৬৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নামক যে কর্মসূচি গৃহীত হয়, তাতে নিরক্ষর অভিশাপ থেকে বয়স্ক ব্যক্তিদের বিশেষ করে নারীদের মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রস্তাবে বলা হয়েছিল : ২০১৫ সালের মধ্যে সকল নিরক্ষর বয়স্ক ব্যক্তিদের বিশেষ করে নিরক্ষর মহিলাদের সাক্ষরতার হার অন্তত শতকরা ৫০%-এ উন্নীত করতে হবে। মৌলিক এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সকল বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া ঢাকার সম্মেলনে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই কর্মসূচি সম্বন্ধে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, তা হলোÑ (১) শিশুদেরকে বিদ্যালয়-পূর্ববর্তী সময়ে যতœ বিশেষ করে সমাজের পশ্চাৎপদ শ্রেণীর শিশুদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপক সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। (২) ২০১৫ সালের মধ্যে অর্থাৎ সহ¯্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়ের মধ্যে সকল শিশু বিশেষ করে মেয়ে শিশু, রাষ্ট্রীয় সংঘাতের কারণে মানবিক সংকটের শিকার শিশু ও সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য মানসম্মত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে। (৩) নিজ নিজ পছন্দ ও স্বভাবজাত নৈপুণ্যের উৎকর্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষালাভের সুযোগ যুব সমাজের জন্য উন্মুক্ত করে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। (৪) ২০০৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা, ২০১৫ সালের মধ্যে এই ক্ষেত্রে সমতা অর্জন করা বিশেষ করে মানসম্মত মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মহিলাদের সমান অংশগ্রহণ ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
২০০০ সালে ডাকার সম্মেলনে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ শীর্ষক যে কর্মসূচি গৃহীত হয়, বাংলাদেশ তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু এখনও ২৯% জনসংখ্যা নিরক্ষর রয়েছে, এটা ভেবে আত্মসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী সাক্ষরতা দিবসের অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে দেশে সাক্ষরতার হার ৪৫% থেকে বেড়ে ৬৫% এ দাঁড়ায়, যা বর্তমানে ৭১%। এর ফলে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার লাভ করেছিল। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, খুব শিগগিরই আমরা নিরক্ষরতামুক্ত ঘোষণা করতে পারব। এ প্রসঙ্গে সকলকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে অবদান রাখার আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। সাধারণ নাগরিকদের সচ্ছলতা এলেও তারা যখন দেখছে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ দুর্নীতির ¯্রােতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তখন সমাজোন্নয়নের দায়দায়িত্ব পালন করার উৎসাহ তারা হারিয়ে ফেলে। যারা শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে কোনো যথোপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়া হয় না। সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০১১ সালের মধ্যে দেশের সকল শিশুকে প্রাথমিক বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের আওতায় আনয়ন করা। জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করা ও অন্যান্য কারণে বিদ্যালয়ের প্রথম দিকে ঝরে পড়ার হার কমানোর লক্ষ্যে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করার এক বিরাট কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছে। ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সরকার কর্তৃক গৃহীত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের কথা উল্লেখ করে বলেন, গত সাত বছরে সরকার ১৯৩ কোটি বই সরবরাহ করেছে। এ ছাড়াও গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে ৪০ ভাগ ছাত্রকে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
এ সবকিছু সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার জন্য কিছু সংখ্যক স্কুলে “মিড ডে মিল” প্রকল্প চালু করা হয়েছে। মিড ডে মিল কর্মসূচি ৯৬টি দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলায় ৩৩ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য চালু করা হয়েছে।
সাক্ষরতা প্রকল্প সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬৪ জেলায় ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে চালু করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সম্পর্কে বাংলাদেশের বাজেটে সর্বমোট টাকা বরাদ্দ অত্যন্ত কম রাখা হয়। কেন্দ্রীয় বাজেটে এখনো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম রাখা হয়। সবার জন্য শিক্ষা খাতে জাতীয় বরাদ্দ অন্তত ২০% রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল কিন্তু এখনো বরাদ্দ মাত্র ১২% রাখা হয়। এই বরাদ্দ আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তথ্য ও প্রযুক্তি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ভাগ করে দেয়া হয়। তুলনামূলকভাবে উদ্ধৃত করতে গেলে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৩১% এবং সেনেগালে রাখা হয় ৪০%। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের মতো শিক্ষা খাতে এত কম বরাদ্দ খুব কম দেখা যায়।
সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হলোÑ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রতি বছর অপুষ্টির শিকার হয় প্রায় ১৮ কোটি শিশু।
সার্বজনীন শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো সর্বাপেক্ষা অবহেলিত দিকটি হচ্ছে বয়স্ক নিরক্ষরদের সাক্ষরতা প্রদান। আবার এই নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি হচ্ছে নারী। এদিকেও পর্যাপ্ত দৃষ্টি দিতে হবে এবং সাক্ষরতা অর্জনে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে।
২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি গৃহীত হয়, তাতে ২০১৪ সালের মধ্যে সকল প্রাপ্তবয়স্ককে সাক্ষর করে তোলার কথা বলা হয়েছিল। অথচ গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, সকল বয়সের মধ্যে নিরক্ষরতার হার এখনো ২৯ শতাংশ। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ শীর্ষক বইটিতে শিক্ষা কমিশনের সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ মন্তব্য করেছেন, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অপ্রতুলতা ও অনমনীয়তা এবং অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের কারণে দেশে বিরাজমান নিরক্ষরতা ব্যাপক। নিরক্ষরতা সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীর বয়স ও শিক্ষা বিষয়কে ভিত্তি করে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে কার্যকর গণশিক্ষার বিস্তার তাই জরুরি। বয়স্ক শিক্ষার আওতায় তাই অন্তর্ভুক্ত থাকবে সাক্ষরতা শিক্ষা, মানবিক গুণাবলীর বিকাশ, সচেতনতা অর্জন ও পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন। বয়স্ক শিক্ষা সম্বন্ধে জাতীয় শিক্ষানীতিতে যেসব ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো : (১) দেশের সকল নারী-পুরুষের জন্য এই শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। তবে নিরক্ষরদের মধ্যে যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছর তারা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। (২) বয়স্ক শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বয়স্ক সাক্ষরতা কোর্স ব্যতীত অন্যান্য কোর্সের সময়সীমা বিষয়বস্তু, পঠন-পাঠনের পদ্ধতি, শিক্ষকের যোগ্যতা ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া স্থানীয় ও প্রবাসী জনমানুষের চাহিদা, সম্পদের প্রাপ্যতা ও পেশাগোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুসারে নির্ধারিত হবে। (৩) অর্জিত শিক্ষা ও দক্ষতাকে অটুট রাখার জন্য অব্যাহত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। (৪) সমন্বিত সাক্ষরতা অভিযানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজ বিভিন্ন পদ্ধতি, উপকরণ প্রক্রিয়া ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর সমন্বয় ঘটিয়ে যথাসম্ভব কম সময়ে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার চেষ্টা করা হবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হবে। (৫) স্থানীয় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে ছুটির সময়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। (৬) সাক্ষরতা কর্মসূচি পরিচালনায় বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিও ব্যবহার করতে হবে।
শিক্ষানীতিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা হলো : (১) উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার বয়স আট বছর থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। (২) প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ প্রণীত হবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যায় এমন উপকরণ দ্বারাই উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হবে। (৩) বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য উৎসাহিত করা হবে। দেশের অনগ্রসর এলাকা এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই শিক্ষাক্রমের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা গড়ে তোলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে যাদের বয়স আট বছর থেকে চৌদ্দ বছর রাখার ব্যবস্থা কিছুটা অবাস্তব বলে মনে হয়। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়া শিশুরা ছয় বা সাত বছর বয়সেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে এবং সাথে সাথেই জীবিকার অন্বেষণে বা পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে সহায়তাদানের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়। তাদের কাজের সময় অনেক ক্ষেত্রে সন্ধ্যা বা সন্ধ্যার পরেও চলতে থাকে।
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছেÑ (১) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক ও বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এই নীতি এখনো বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত নি¤œবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই ভর্তি হয়। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার দৌরাত্ম্য এতটুকু প্রচলিত ও বিস্তৃত হয়েছে যে, এখন উপজেলা সদরেও একাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু হয়েছে। তাদের পরিচালন ব্যয় যা হয়, তার কয়েকগুণ টাকা তারা অভিভাবকদের নিকট থেকে আদায় করে। এর ওপর প্রতিটি কিন্ডারগার্টেনে রয়েছে বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সন। বলাবাহুল্য, ইংরেজি ভার্সনে বাংলা ভাষার প্রতি জোর কম দেয়া হয়। সংবিধানে রয়েছে সমাজের প্রয়োজনের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টি করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো এক বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছে। শিশুদের বহু কিছু পড়তে হয় কিন্তু কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে এখনো বহুল প্রচলিত করা সম্ভব হয়নি। অথচ কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের প্রয়োজন এখন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
সংবিধানে বলা হয়েছে, আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী সংবিধান গ্রহণ করার চার দশক পরেও দেশে নিরক্ষরতার হার ২৯%।
২০১০ সালে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি একটি ব্যাপকভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা। এতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, ক্রীড়া শিক্ষা, নারী শিক্ষা ইত্যাদি সকল বিষয়ে বিশদভাবে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু ছয় বছর অতিক্রম হলেও বহু ক্ষেত্রে শিক্ষা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।