Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মফস্বল সংবাদপত্রের সুখ-দুঃখ

প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল
বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস প্রায় দু’শ বছরের। বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসের যাত্রা মফস্বল শহর থেকেই শুরু। সে ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসের কথা। দিগদর্শন, সমাচার দর্পণ ও বাংলা গেজেট নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশ হতো ইংরেজ শাসনামলে বাংলা হতে। এই দুইশ বছরে সংবাদপত্রের ধরন, আকার ও ব্যবস্থাপনায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন চাররঙা ছবিসহ সংবাদপত্র কতই না আকর্ষণীয়। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা হতে অসংখ্য জাতীয় দৈনিক প্রতিদিন প্রকাশিত হয়ে পাঠকদের হাতে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রাচীন পত্রিকাগুলোর মধ্যে দৈনিক সংবাদ ১৭ মে ১৯৫১, দৈনিক ইত্তেফাক ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ ও বাংলাদেশের অবজারভার ১১ মার্চ ১৯৪৯ সালে প্রকাশনা শুরু করে। এ ছাড়াও ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলো হলোÑ দৈনিক ইনকিলাব, দিনকাল, যুগান্তর, প্রথম আলো, মানবজমিন, বাংলাদেশ প্রতিদিন, জনকণ্ঠ, সমকাল, ভোরের কাগজ, সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত ইত্যাদি পত্রিকা দেশ ও জাতির বন্ধু হিসেবে সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। এ পত্রিকাগুলো প্রতিদিন জাতীয়, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা, বিনোদন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ফিচার নিয়ে প্রকাশিত হয়।
অনেক সময় মফস্বলের অনেক ভালো সংবাদ জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। ওই সংবাদটি স্থানীয় দৈনিক বা সাপ্তাহিকে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। আবার অনেক সময় খবরটি ফলোআপ হয়। যা জাতীয় পত্রিকায় সম্ভব নয়। জাতীয় পত্রিকা যেখানে পৌঁছতে পারে না, মফস্বল পত্রিকা অনায়াসে সেখানে রাজত্ব করে। তাই গ্রামীণ জনপদের লোকদের কাছে মফস্বল পত্রিকার গুরুত্ব একটু বেশি। উল্লিখিত পত্রিকাগুলো ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়, তাই এগুলোকে জাতীয় দৈনিক বলে। আসলে বাংলাদেশের সব পত্রিকাই জাতীয় পত্রিকা। ঢাকা থেকেই পত্রিকাগুলো সরকারিভাবে লিস্ট হয়। ঢাকার পত্রিকাগুলো চাররঙা থাকে এবং বিভিন্ন দিক থেকে সহযোগিতা পায়। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে পত্রিকা প্রকাশ ও ছাপানো বড়ই কষ্টসাধ্য। খুব কষ্ট করে মফস্বল শহর হতে স্থানীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক বা প্রকাশকের বহু কষ্টের ফসল একটি স্থানীয় পত্রিকা। আমরা বিভাগীয় শহরের বাইরের গুলোকে অর্থাৎ জেলা শহরের পত্রিকাকে মফস্বল পত্রিকা বলতে পারি।
আর বিভাগীয় শহর থেকে যে পত্রিকা প্রকাশিত হয় তাকে আঞ্চলিক পত্রিকা বা সংবাদপত্র বলতে পারি। তারপরও ঢাকার বাইরের সংবাদপত্রকে সবাই আঞ্চলিক পত্রিকা বলে সম্বোধন করে। আমাকে একটি জনকল্যাণমূলক কাজে পুরো দেশটাই ঘুরতে হলো। প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিতে গিয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের সাথে কথা হয়। কথা হয় তাদের পত্রিকা ছাপানোর বিভিন্ন সুখ-দুঃখ নিয়ে। আমাদের কাজ শুরু ফরিদপুর হতে। জানতে পারলাম এখানে ঢাকার পত্রিকাগুলো ভোর বেলা চলে আসে, বিধায় স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো নিয়মিত বের হয় না। বরিশাল হতে বেশ কয়েকটি স্থানীয় দৈনিক প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে নিয়মিত প্রকাশিত হয় বরিশাল বার্তা ও দক্ষিণাঞ্চল। পত্রিকাটি সদর রোড বরিশাল হতে প্রকাশ করা হয়। নির্ভুল প্রিন্ট, স্ক্যান ভালো। নিউজের অবস্থাও ভালোই। খুব ভালো পত্রিকার একটি হলো পশ্চিমাঞ্চল। এ দৈনিকটি শহীদ আবুল কাসেম সড়ক, চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত। যার সম্পাদক হলো আজাদ মালিতা। বার্তা সম্পাদক রফিক রহমান, মফস্বল পত্রিকা হলেও এটির গেটআপ-মেকাপ খুবই চমৎকার। ঝকঝকা ও পরিচ্ছন্ন ছাপা। নিউজ তৈরিতেও রয়েছে মুন্সিয়ানার ছাপ। চুয়াডাঙ্গায় এ পত্রিকাটির ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হলো।
কুষ্টিয়ার আন্দোলনের বাজার একটি ভালো সংবাদপত্র। পত্রিকাটির অফিস মজমপুর গেট। দিনাজপুর হতে আরও একটি ভালো দৈনিক প্রকাশ করেন মতিউর রহমান। সংবাদপত্রটির নাম দৈনিক উত্তর বাংলা। একটি চমৎকার ও সাহসী পদক্ষেপ মতিউর রহমানের। তার সংবাদপত্রটি দিনাজপুরে বেশ জনপ্রিয়। নাটোরে দেখলাম জনদেশ পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। মোস্তাফিজুর রহমান সুমন পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। অনেক সময় পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না অর্থের অভাবে। পান না কোন সরকারি সহযোগিতা, তাই তার মন খারাপ। পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া পত্রিকাটির যতœ নেয়া উচিত পাঠকের মন্তব্য। সিলেট থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় সংবাদপত্র হলো দৈনিক সিলেটের ডাক ও জালালাবাদ। পত্রিকা দুটিই বন্দরবাজার সিলেট থেকে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সিলেটের ডাক চাররঙা ছাপিয়ে বাজারজাত করা হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদক হলেন রাগীব আলী। বেশ ভালোই চলে সিলেটের ডাক। হকাররা জানাল এ তথ্যটি। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলও একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পত্রিকা। হবিগঞ্জ থেকে ও বেশ কয়েকটি দৈনিক প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে খোয়াই ও হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস অন্যতম। খোয়াইর সম্পাদক শামীম আহসান। বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে পত্রিকাটির বেশ চাহিদা দেখে ভালোই লাগল। আমিও একটি কিনে নিলাম। ফেনী বার্তার এক রিপোর্টারের সাথে কথা হয় পরশুরাম উপজেলায়। তিনি দীর্ঘদিন এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। টাকা নেন না। নিউজ ছাপা হলেই তিনি খুশি।
মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয় দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজ। এটির সম্পাদক আরফিন মোল্লা। এ ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ হতে মুন্সীগঞ্জ সংবাদ, কাগজের খবর ও বিক্রমপুর সংবাদ প্রকাশিত হয়। নারায়ণগঞ্জের জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো হলো দৈনিক শীতলক্ষ্যা ও ডান্ডি বার্তা। ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে এ সংবাদপত্রগুলো প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের বিখ্যাত পত্রিকা আজাদী। এ ছাড়াও এখান থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয় পূর্বকোণ, কর্ণফুলী। বেশ জনপ্রিয় এ সংবাদপত্রগুলো চট্টগ্রামে। যমুনার তীর থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয় যমুনা প্রবাহ। অর্থাৎ সিরাজগঞ্জের অত্যন্ত জনপ্রিয় সংবাদপত্র হলো যমুনা প্রবাহ। লক্ষ্মীপুর জেলার একটি পাঠকপ্রিয় সংবাদপত্রের নাম হলো নতুন চাঁদ। এ সংবাদটির সম্পাদক ও প্রকাশক হলেন হোসাইন আহমেদ। চাঁদপুর হতে প্রকাশিত হয় বেশ কয়েকটি স্থানীয় দৈনিক। এর মধ্যে ইলশে পাড়, চাঁদপুর কণ্ঠ, চাঁদপুর দর্পণ অন্যতম। ইলশেপাড় দৈনিকটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলেন আবদুল হান্নান। তিনি ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের চাঁদপুর প্রতিনিধি হওয়ার পরও বহু কষ্টে, সৃষ্টির উন্মাদনায় প্রকাশ করে যাচ্ছেন ইলশেপাড়।
আসলে যেখানে ৫০ টাকা কেজি চাল, ১৩৫ টাকা সয়াবিন বোতল, ১২০ টাকা কেজি মসুর ডাল সেখানে মফস্বল সাংবাদিকরা পত্রিকা প্রকাশ করেন এটাই ধন্যবাদ। অনেক জেলায় স্থানীয় সম্পাদকের সাথে কথায় কথায় জানতে পাড়লাম শুক্রবার, শনিবার বন্ধ রাখেন অর্থের অভাবে। টাকার জোগান হলে প্রতিদিনই বের হতো তাদের মেধা, শ্রম ও সৃষ্টিশীলতার বাস্তব রূপ। অনেক সময় প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশিত হলে শারীরিক নির্যাতনসহ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সত্যি বলতে কী, এই মফস্বল পত্রিকার মাধ্যমেই বড় বড় ও বিখ্যাত সাংবাদিকরা আত্মপ্রকাশ করেন। অনেকে উঁচু স্তরে এসে, সেইসব পত্রিকার কথা মনে রাখেন না। স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকের দাবি হলো তাদের সহজ শর্তে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আর মিডিয়ালিস্টের জন্য সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে তিন-চারগুণ টাকা বেশি লাগে। বাংলাদেশের বেশ কিছু আঞ্চলিক ও মফস্বল পত্রিকা জাতীয় সংবাদপত্রের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের আজাদী, সিলেটের-সিলেটের ডাক, চুয়াডাঙ্গার-পশ্চিমাঞ্চল, বরিশালের-বরিশাল বার্তা ও দক্ষিণাঞ্চল। এ ছাড়াও শীতলক্ষ্যা, মুন্সীগঞ্জের কাগজ, করতোয়া, যমুনা প্রবাহ নিজস্ব ইমেজে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। পাঠকপ্রিয়তা পাক প্রতিটি মফস্বল সংবাদপত্র এটাই প্রত্যাশা।
য় লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মফস্বল সংবাদপত্রের সুখ-দুঃখ

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ