Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাগরে ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে মধ্যরাতে

নিষেধাজ্ঞার সময়ে উপকুলের ৩লাখ জেলে পরিবার খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২১, ১:৫৯ পিএম

সমুদ্র এলাকায় মৎস্য আহরনে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা মধ্যরাতে উঠে যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষিরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপক’লীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’র ১ লাখ ৪০ হজার ৮৬০ বর্গ কিলোমিটারে ছোট-বড় নানা প্রকারের ৪৭৫ প্রজতির মৎস্য সম্পদ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখছে। এ ছাড়াও সমুদ্র এলাকায় ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সম্পদ আমাদের সমুদ্র সম্পদকে সমৃদ্ধ করেছে।
দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ৮Ñ১০%। সমুদ্র এলাকায় প্রায় ৫.১৬ লাখ জেলে ২৫৫টি বানিজ্যিক ট্রলার, ছাড়াও প্রায় ৭০ হাজার ইঞ্জিন চালিত ও ইঞ্জিন বিহীন নৌকায় ১ লাখ ৮৯ হাজার জাল সহ মাছধরার নানা সরঞ্জামের সাহায্যে মৎস্য আহরন করে থাকেন। সরকার চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করা সহ অন্যান্য মাছের বিচরন, প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আহরন প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে, বঙ্গাপসাগরে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ করে। সামুদ্রিক জলাশয়ে ৬৫ দিনের এ আহরন নিষেধাজ্ঞার কারণে গত কয়েক বছরে আমাদের মৎস্য সম্পদে লক্ষাধীক টন মাছ যোগ হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ৬৫ দিনের বন্ধ মৌসুম কার্যকরের আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ থেকে ’১৪-১৫ সময়ের তুলনায় ২০১৫-১৬ থেকে ’১৭-১৮ পর্যন্ত বানিজ্যিক ট্রলার থেকে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় মৎস্য আহরনের পরিমান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সামুদ্রিক জলাশয়ে উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। যা পরবর্তি বছরগুলোতে ক্রমন্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জনিয়েছে অধিদপ্তর।
উপক’লের জেলে ও মৎস্যজীবীরা ৬৫ দিনের এ আহরন নিষিদ্ধের বিষয়টিকে ভালভাবে না নিলেও মৎস্য সম্পদের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই তা করা হচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এমনকি আহরন নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে উপক’লের প্রায় ৩ লাখ জেলে পরিবারকে দু দফায় মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বিতরন করা হয়েছে। যারমধ্যে বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩টি জেলে পরিবার ১২ হাজার ৬১৮ টন খাদ্য সহায়তা পয়েছেন।
পাশাপাশি নিষদ্ধকালীন এসময়ে ৪৯টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ছাড়াও মৎস্য অধিদপ্তর নিজস্ব ব্যবস্থায় আরো বিপুল সংখ্যক অভিযান পরিচালনা করে ৬০টি বিভিন্ন ধরনের মছধরা ট্রলার এবং ২০ লাখ মিটার জাল আটক করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এছাড়াও ৩.৩২ টন মাছ আটক করে নিলামে বিক্রী করা হয়েছ। এসময়ে প্রায় ৪৫টি মামলা দয়ের ছাড়াও ১৫ লাখ টাকার মত জরিমানা আদায় করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। ১৮ জন জেলে ও মৎসজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডও দেয়া হয়েছে। এসময় বাজেয়াপ্তকৃত জাল, ট্রলার ও মাছের নিলাম থেকে সরকারী কেষাগাড়ে জমা হয়েছে প্রায় সাড়ে সাড়ে ৪ কেটি টাকা।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেস করে। কিন্তু সম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী ‘সামুদ্রিক ও উপক’লীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরন, ভ’মি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখি সংকট-এর সম্মুখিন’। ফলে বাংলাদেশ সহ বিশে^র মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বিশে^র সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ অসীম হলেও অফুরন্ত নয়। তাই সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য সকল ঝুকি ও অনিশ্চয়তাকে বিবেচনায় রেখে বিগত বছরগুলোতে আহরন বৃদ্ধি পেলেও প্রজাতির গুনগতমান অবনমন লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীগন। এরফলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্নস্তরের অংশীজনের মাছের সিমিত সম্পদ নিয়ে অসম প্রতিযোগীতা এবং আয় বৈষম্যও বাড়ছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীগন ‘বিশাল এলাকার জলরাশির মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন, ব্যবস্থাপনা এবং সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল আহরন নিশ্চিত করে বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অব্যাহত এবং বংশ বৃদ্ধি সহ মজুদ অক্ষুন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব’ দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীগন ‘আমাদের একান্ত বাস্তবতা ও পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়ন অত্যাবশ্যক’ বলেও মনে করছেন।
২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত ৬৫ দিনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ কার্যক্রমটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও ২০১৯ থেকে তা সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পড়ের ২২ দিন উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশ আহরন নিষিদ্ধের ফলে গত দুই দশকে এ মাছের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বেড়েছে।
কিন্তু সাগর ও উপক’লে ঝড়Ñঝঞ্ঝার মৌসুমে ৬৫ দিন মাছাধরা নিষিদ্ধ ঘোষনার বিষয়টি নিয়ে উপক’লের বিশাল জেলে ও মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, ‘বাংলদেশের সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এসময়ে ভারতে নিষিদ্ধ না থাকায় সে দেশের জেলেরা অবাধে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেস করে মাছ লুটে নিচ্ছে’। তবে মৎস্য বিজ্ঞানীগন এক্ষেত্রে ‘প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ ঘোষনার সময় পুণঃ বিবেচনার’ কথা বলেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মৎস্য আাহরনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
এসব ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক(সামুদ্রিক) ড. মোঃ আবুল হাসনাত, নির্দিষ্ট সময়ে মাছধরা বন্ধ রাখা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ ও অত্যন্ত ফলদায়ক পদ্ধতি বলেও মনে করছেন। যা বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতীসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এ বর্তমানে কর্মরত ড. হাসনাত সমুদ্রে আহরন নিষেধাজ্ঞার সময়কাল প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় করে নির্ধারনের কথাও বলেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ