মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
এহসান বিন মুজাহির
সড়ক-মহাসড়কে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রতিদিন সড়ক কেড়ে নিচ্ছে তাজাপ্রাণ। কেউবা বরণ করছেন আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব। প্রতিদিন যে হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তাতে প্রশ্ন ওঠে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়? কখনো বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, মুখোমুখি সংঘর্ষ, পথচারীকে সজোরে ধাক্কা, বাস ছিঁটকে পড়েছে হয়তো গভীর খাদে এভাবে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন গণমাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার বীভৎস ছবি, স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে শোকে কাতর করে ফেলেছে!
সড়ক দুর্ঘটনা যেন এ দেশের নিত্যদিনের দুঃসংবাদ। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের শুধু কান্না নয়, কোনো কোনো সময় সারা জীবনের জন্য ওই পরিবারের ওপর চেপে বসে পাহাড়সম কষ্টের পাথর। পরিবারে একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিটি যখন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান, তখন ওই পরিবারটির বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাদের সকল আশা-স্বপ্ন ও সুন্দর ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। নিহত পরিবারে চলছে কান্না আর কান্না! কেউ জানেন না এ কান্নার আর কষ্টের শেষ কোথায়। এভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবারে ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই কাঁদতে হচ্ছে কাউকে না কাউকে। যাত্রাপথে প্রায় সবাইকে তাড়িয়ে বেড়ায় এই দুঃসহ স্মৃতি। সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিল মিছিল যেন থামার নয়! দিন যতই যাচ্ছে ততই উদ্বেগ ও যাতনা বাড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যদিনের সঙ্গি। ঈদযাত্রায় শুধু ১২ দিনে (৭-১৮ সেপ্টেম্বর) সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ২১১ দুর্ঘটনায় ২৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ১৫৩ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে শুধু ১৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৪৮ জন ও আহত হয়েছেন ১ হাজার ৫৬ জন। বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৬’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। মৃত্যু মানুষের স্বাভাবিক নিয়তি। কিন্তু সে মৃত্যু যখন হয় সড়ক দুর্ঘটনায় তখন কষ্টের শেষ থাকে না, কোনো দুর্ঘটনার ফলে নিমিষেই ঝরে যাচ্ছে একেকটি প্রাণ, তবে তা সত্যিই বেদনাদায়ক এবং একইসঙ্গে উদ্বেগের। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী এই মানুষগুলো কারো না কারো স্বজন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবরটি আপনজনের কাছে কতই না বেদনার! স্বজন হারানোর বেদনা শুধু স্বজনরাই অনুভব করছেন বারবার। সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু যে মানুষের জীবনই ঘাতক বাস, ট্রাক কেড়ে নেয় তা কিন্তু নয়। দুর্ঘটনায় পরিবারের ওপর নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। এমন পরিবার আছে শুধু উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার ফলে পরিবার-পরিজন, সন্তান নিয়ে চরম অর্থনৈতিক অশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে। দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বেঁচে থাকলেও সারাজীবন পঙ্গুত্ব বহন করতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত বছরের তথ্য মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২১ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশি। দুর্ঘটনার মৃত্যুর ৩২ শতাংশই নিরীহ পথচারী। অথচ পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে পথচারীর মৃত্যুহার ৯ শতাংশ এবং ভুটানে মাত্র ৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রীর মৃত্যুহার ৪১ শতাংশ এবং চালকের মৃত্যুহার ২৭ শতাংশ। উন্নত দেশের তুলনায় অনুন্নত দেশে এ হার প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৯০ শতাংশই অনুন্নত দেশে। সড়ক দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয় তাদের ৬৫ শতাংশই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তারা পেশাগত কারণে তথা উপার্জনের জন্য রাস্তায় বের হয়। ফলে তাদের মত্যুতে সম্পূর্ণ পরিবারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক জিডিপির ১.৬ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭০ শতাংশ সড়ক ব্যবহার করে মাত্র ৫ শতাংশ লোকের ব্যক্তিগত গাড়ি (দ্য ডেইলি স্টার, ২১ অক্টোবর ২০১৫)
সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, একের পর এক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। গত ১৬ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) দৈনিকে যুগান্তরের শিরোনাম ছিল ‘ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ৪২ জনের।’ ১৭ সেপ্টেম্বর শনিবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম ছিল ‘সড়কে ঝরল ২৩ প্রাণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বরসহ নিহত ৮। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তের শিরোনাম ছিল ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ১০৩ জনের; আহত ৪২৪, দৈনিক ইনকিলাবে মহাসড়ক এখন মৃত্যুফাঁদ, ১৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিনে সড়ক র্দুঘটনায় ২ বোন নিহত, ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবের সড়কের বাস ঘরে : ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে কত পরিবার নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়ে তার খবর কে রাখে! বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গত সাত মাসে ১৪৭৩ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়।
তাছাড়া বিগত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬০৭ জনের অকাল মৃত্যু হয়েছে। ২০১২ সালে ২০০৯ জন, ২০১৩ সালে ১৫৪৬ জন, ২০১৪ সালে ২১৩৫ জন, ২০১৫ সালে ২৫৮০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য মতে, গত ঈদুল ফিতরের যাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথে ১২১টি দুর্ঘটনায় ১৮৬ জন নিহত এবং ৭৩৬ জন আহত হন। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০১৫ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২১ হাজার ৮৫৫ জন। দেশের সড়কগুলো মৃত্যুফাঁদ। এ ফাঁদে পড়ে প্রতিদিনই মৃত্যুবরণ করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আলেম, কৃষক, শ্রমজীবি, শিক্ষাবিদ, জ্ঞানী-গুণী বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। মহাসড়কে লাশের মিছিল থামছে না। সড়ক দুর্ঘটনারোধে নেই কোনো পদক্ষেপ। শুধু এ বছরের ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহায়ই নয় প্রতি বছরই ঈদের আগে ও পরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। সড়কে লাশের মিছিল দীর্ঘ হলেও এ নিয়ে যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট মহলের!
সড়ক দুর্ঘটনার বহুবিধ কারণের মাঝে চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালনা, বিপজ্জনকভাবে পাশ কাটানো (ওভারটেকিং), সড়কে বিভাজক না থাকা, ট্রাফিক আইন না মানা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, প্রশিক্ষণবিহীন অদক্ষ চালক, যাত্রীদের অসচেতনতা, অপ্রশস্ত, রাস্তায় ডিভাইডার না থাকা, পুরনো ও ত্রুটিযুক্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলের সুযোগ, অদক্ষ চালককে লাইসেন্স প্রদান, ড্রাইভিং পেশার উৎকর্ষহীনতা, অপরাধীদের কঠোর শাস্তি না হওয়া, গাড়ি মালিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের জরিমানা অনাদায় এবং কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অভাবে সড়কে লাশের মিছিল বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
ষ লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।