Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীর বেহাল চিত্র

লকডাউন শিথিলের প্রথম দিন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যেই সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ ৮ দিন শিথিল করা হয়েছে। হঠাৎ করে মানুষজন রাস্তায় নেমেছে, মার্কেট, বিপণিবিতান খুলেছে, গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। একসঙ্গে হাজার হাজার গণপরিবহন রাস্তায় নামায় রাজধানীর ভেতরে এবং আশপাশের জেলাগুলোর যাতায়াতে রাস্তায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ একদিনে চালু হওয়ায় মানুষ সেগুলোতে হুমরি খেয়ে পড়ছে। মার্কেটগুলোতে ক্রেতা এবং পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি সিঁকেয় তুলে রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেঢালা ভাবের কারণে ‘শিথিল লকডাউন’ এর প্রথম দিন রাজধানীর বেহাল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

ঈদ উপলক্ষ্যে লকডাউন শিথিল করায় দীর্ঘদিন ঘরে আটকে থাকা মানুষ এখন প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে কমই দেখা গেছে। বেশির ভাগের মুখে মাস্ক থাকলেও, তা যথাযথভাবে পরিধান করছেন না অনেকে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে দেখা যায় পিঁপড়ার মতো মানুষ কিলবিল করছে। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ পর রাজধানীর সড়কে মানুষ ও যানবাহন বেড়েছে। আশপাশের জেলাগুলো থেকে গণপরিবহন যাতায়াত করছে। ফলে দেখা দিয়েছে যানজট। রাস্তায় মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষা করতে হচ্ছে মানুষকে। বাসে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী অর্ধেক আসনে যাত্রী নেওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত যাত্রী ওঠাতে দেখা গেছে। ভাড়াও নেয়া হচ্ছে দ্বিগুন।

লকডাউন শিথিল হওয়ায় রাজধানীর অলিগলি ও প্রধান সড়কগুলোতে চলাফেরা করতে এখন আর কাউকে মামলার জালে জড়াতে হবে না। গুনতে হবে না জরিমানা। অথচ, গত বুধবার পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ রোধে রাজধানীসহ সারা দেশে দুই সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছিল সরকার। ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত জারি থাকা এ বিধিনিষেধের মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগর পুলিশ অকারণে বাইরে বের হওয়ায় ৯ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে।

এই ১৪ দিনে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই হাজার ৯৯৯ জনের কাছ থেকে ৩৯ লাখ ১২ হাজার ৩৩০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশ অপ্রয়োজনে বের হওয়া ৮ হাজার ১৩৯টি গাড়িকে মোট এক কোটি ৮৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৫ টাকা জরিমানা করেছে।

লকডাউন শিথিল করে সরকার ৪৩টি শর্ত দিয়েছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেককে রাস্তায় বের হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে; মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যদিও এর আগেও যতবার লকডাউন বা বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছিল, ততবারই সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরতে বলেছিল। কিন্তু রাজধানী পরিবেশ দেখা গেছে ভিন্ন। মানুষজনকে অকারণে বাইরে বের হতে দেখা গেছে। জোর করার পরও মাস্ক পরতে অনীহা দেখা গেছে মানুষের মধ্যে। কোরবানির পশুর হাটে অধিকাংশ বিক্রেতার মুখে মাস্ক নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই হাটের আয়োজকদের মধ্যে। মাইকে শুধু স্বাস্থ্যবিধি মানার ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে।

লকডাউন শিথিলের প্রথম দিনে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশের প্রতিটি রোডে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে সারাদিন যানজট ছিল। যাত্রবাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ব্রিজের ওপর যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ফার্মগেইট, আবদুল্লাহপুর, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, বাবুবাজার, প্রতিটি সড়কে যানবাহন থমকে দাঁড়িয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মহানগরীর প্রায় প্রতিটি সড়কে গাড়ির দীর্ঘলাইন। এবড়ো-খেবড়ো হয়ে চলছে সবরকম গণপরিবহন। সব ধরনের গণপরিবহনের যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়। যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত কাজলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল মা ও শিশু হাসপাতাল, সাইনবোর্ড, সানারপাড়সহ প্রতিটি বাস স্টপেজ দেখা যায় হাজার হাজার যাত্রী বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। একটি বাস দেখলেই সবাই একসঙ্গে দৌড়ে সে বাসে উঠার চেষ্টা করছেন। বাসগুলোতে সিট ছাড়াও দাঁড়িয়ে যাত্রীদের নেয়া হচ্ছে। যাত্রীর ভিড় দেখে বাসের ড্রাইভার, কন্টাক্টরদের দ্বিগুন তিনগুন বেশি ভাড়া আদায় করতে দেখা যায়। রাজধানীর সব বাস স্টপেজ এবং রাজপথে শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। সকল গাড়িই যেন দু’সপ্তাহের ঘুম ভেঙে রাস্তায় নেমেছে একসঙ্গে।

এই প্রতিবেদককে শনির আখড়া থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান পৌঁছাতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। অথচ অন্যান্য দিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগত। পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, কাকরাইল, মালিবাগ, মগবাজার, সাতরাস্তা, কমলাপুর, মালিবাগ, শাহবাগ প্রতিটি পয়েন্টেই মাত্রাতিরিক্ত যানজট দেখা গেছে।

ইনকিলাবের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ঢাকার প্রবেশ মুখে গাবতলী, আমিনবাজার, গাজীপুর, উত্তরা, নবাবগঞ্জের প্রতিটি পয়েন্টেই যানজট ছিল। সদরঘাটের নৌরুটেও শহরে প্রবেশ করছে হাজার হাজার মানুষ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে লঞ্চঘাটে জড় হয়েছেন হাজারো মানুষ। এদের কেউ চাঁদপুর, কেউ বরিশাল, কেউ পটুয়াখলী, কেউ হাতিয়া, কেউ ভোলার উদ্দেশে রওনা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। ভোর ৬টায় এমভি হাসান লঞ্চে কয়েকশ’ যাত্রী চাঁদপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। বিধি-মোতাবেক অর্ধেক যাত্রী বহন করার কথা থাকলেও যাত্রী দেখা গেছে প্রচুর। তবে সদরঘাটে এসে নোঙ্গর করা লঞ্চে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বুধবার গভীর রাত থেকেই লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এটি স্বাভাবিক সময়ের মতো চলছে। তবে এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ লঞ্চ ছেড়ে গেছে এবং কী পরিমাণ লঞ্চ ঘাটে এসে ভিড়েছে, সেই তথ্য আমাদের কাছে আপডেট নেই।

স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তৎপর রয়েছে নৌপুলিশ। নৌ-পুলিশের সদস্য মো. ইকরাম হোসেন বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সবার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে। তবে মানুষের চাপ বাড়লে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়।’

লকডাউন শিথিলের প্রথম দিনের ভয়াবহ চিত্র দেখে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানি না, সরকার কেন বিধিনিষেধ শিথিলের পথে হাঁটল। আমাদের দেশের মানুষ মোটেই সচেতন নয়। ফলে ছাড় দিলেই বিপদ। মানুষজন কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাচ্ছে। সেখান থেকে করোনা নিয়ে ঘরে ঢুকবে। ঘরে আক্রান্ত করার পরও আবার গ্রামের বাড়ি ঈদ করতে যাবে। সেখানে গিয়ে মানুষজনকে আক্রান্ত করবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের এখন আরো কঠোর হওয়ার দরকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ