Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পঙ্খিরাজ’ আতঙ্কে নগরবাসী

ফাঁকা সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের দৌরাত্ম্য অস্বাভাবিক গতির জন্য হতাহত হয়েছেন রাজধানীর অসংখ্য মানুষ

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারা দেশের মতো রাজধানীতেও চলছে কঠোর বিধিনিষেধ। বিধিনিষেধের কারণে রাজধানীর সড়কগুলো রয়েছে অনেকটা ফাঁকা। আর ফাঁকা সড়কে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। আর চালকরা তিন চাকার এই যানবাহনের নাম দিয়েছেন ‘পঙ্খিরাজ’। তবে লকডাউন চলাকালে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই জন। এছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ দেয়ার সময় বিস্ফোরণে আরো দুইজন মারা গেছেন। ওই চারজনের মৃত্যুর পর জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। লকডাউনের মধ্যে রাজধানীবাসীর কাছে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে তিন চাকার এই ‘পঙ্খিরাজ’।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা (পঙ্খিরাজ) বন্ধে হাইকোর্ট নির্দেশনা দেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভিন্ন অলিতে-গলিতে চলে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা। এখন রাজধানীর মূল সড়কেও এই রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। যার ফলে যানজট ও লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি ছোট-বড় দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এই বাহনে চড়ে দুর্ঘটনায় হাত-পা হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। পরবর্তীতে গত ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন সেক্টর শৃঙ্খলা জোরদার এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভায় সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যান গাড়ি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্তটি সংশ্লিষ্ট সবখানে পাঠানো হয়। তারপরও বন্ধ হয়নি ওই যানটি। তবে গত ১ জুলাই থেকে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হয়। আর লকডাউন চলাকালে সকল ধরনের গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে শুধু মাত্র রিকশা চলাচল করার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়। আর ওই সুবাধে রাজধানীতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। এতে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।
গত ৩ জুলাই রাতে রাজধানীর পরিবাগ ও কাঠাঁলবাগান এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনায় দুই ব্যক্তি নিহত হন। তাদের মধ্যে রাত দেড়টার দিকে কাঁঠালবাগান এলাকার পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান উল্টে আব্দুল আজিজ নামে এক ব্যক্তি নিহত এবং সাইফুল ইসলাম নামে একজন আহত হন। নিহত ব্যক্তি তরকারি ব্যবসায়ী ছিলেন। একই রাতে ২টার দিকে শাহবাগের পরীবাগ এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় মোটরসাইকেলচালক মহিউদ্দিন নামের আরেক ব্যক্তি নিহত হন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন তানভির নামের আরেক আরোহী। পরীবাগ পেট্রোল পাম্পের সামনের রাস্তায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
এছাড়াও একই দিন রাজধানীর শনির আখড়ার হাজী মসজিদ এলাকায় একটি গ্যারেজে রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ দেয়ার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জালাল উদ্দিন নামে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়। নিহতের স্ত্রীর বড় বোন নাজমা জানান, যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ার বারেকের গ্যারেজে রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ দেয়ার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন জালাল উদ্দিন। পরে অচেতন অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে পরে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ৯টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শুধু তাই নয়, গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের আহসানবাগ এলাকায় অটোরিকশা চার্জ দেয়ার সময় বিস্ফোরণে একই পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ হন। পরবর্তীতে তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আব্দুল মতিন ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার মারা যান। এছাড়াও তাদের মেয়ে মায়েশা, আয়েশা ও ভাগ্নে আবুল খায়ের রায়হান এখনো চিকিৎসাধীন।
সূত্র জানায়, রাজধানীতে রিকশা ভ্যানচালক ও মালিকদের ২৮টি সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের স্টিকার নিয়েই চলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এছাড়া অটোরিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ দিতেও অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি রিকশায় ১২ ভোল্টের দুই থেকে তিনটি ব্যাটারি রয়েছে। গড়ে লক্ষাধিক ব্যাটারি চার্জ হচ্ছে প্রতিদিন। এগুলো হচ্ছে চোরাই লাইন দিয়ে। রিকশার গ্যারেজগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে এসব ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া হয়।
এদিকে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোর গতি সাধারণ রিকশার চেয়ে বেশি হওয়ায় এসব রিকশা ভিআইপি রোডেও চলছে। অথচ ওই সব রোডে রিকশা চলাচল নিষেধ। এ কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া ভিআইপি রোডে এসব রিকশার কারণে লকডাউনের মধ্যে জটের সৃষ্টি হচ্ছে। এর চালকরা অনেকটা বেপরোয়া। আবার ব্যাটারিগুলো থাকে পেছনে আটকানো, যা চরম বিপজ্জনক। যেকোনো সময় এ ব্যাটারি ছিটকে পড়ে ঘটতে পারে বড় রকমের দুর্ঘটনা।
রাজধানীর শনিরআখড়া, দনিয়া, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, মাতুয়াইল, মৃধাবাড়ী, রায়েরবাগ, মোহাম্মদবাগ, ধোলাইপাড়, মিরপুর, পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা, বনশ্রী, মাদারটেক, মান্ডা, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরলে অনেক মানুষ চোখে পড়বে; যাদের কারো হাত ভাঙা, কারো পা ভাঙা। এই মানুষগুলো কার্যত ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে দুর্ঘটনায় এসব অঙ্গ হারিয়েছেন। কারণ প্যাডেলচালিত রিকশায় ব্যাটারি লাগানোয় রিকশার গতি বেড়ে যায়। কিন্তু প্যাডেলচালিত রিকশার গতির চেয়ে দ্বিগুণ গতি হওয়ায় ছোট যানবাহনগুলো অহরহ দুর্ঘটনায় পড়ে। ফলে যাত্রীদের এভাবে ছোট দুর্ঘটনায় অঙ্গ হারাতে হয়। শুধু তাই নয়, প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি বেশি হওয়ায় পথে অন্যান্য যাবনহানের জন্যও দুর্ঘটনার কারণ হয়। রাজধানী ঢাকা শহরের আশপাশের গ্রাম ও শহরের মহল্লাগুলোতে প্রায় অভিন্ন চিত্র। প্রতিটি মহল্লায় ব্যাটারিচালিত রিকশা দৌরাত্ম বেড়ে গেছে।
এদিকে, গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কে লকডাউনে গণপরিবহণ না থাকায় রিকশার প্রাধান্য বেড়েছে। প্রধান সড়কে কম থাকলে রাজধানীর শাখা সড়ক, অলিগলিতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা। গণপরিবহন সংকটের এই শহরে ঝুঁকি নিয়েই এসব যানে চড়ছেন নগরবাসী। ট্রাফিক পুলিশকে প্রভাবিত করে রিকশা চলাচলে ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আজিমপুর, খিলগাঁও, মিরপুর, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকাসহ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন শাখা সড়কে দুরন্ত গতিতে ছুটছে তিনচাকার ওই অবৈধ রিকশা। গতির কাছে হার মানছে রিকশা ভ্যান কখনো প্রাইভেটকার।
তবে পুলিশ বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় গতকাল যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ব্যাটারিচালিত রিকশার পাশাপাশি রিকশা চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিধি-নিষেধের মধ্যে এই মহাসড়কে রিকশা অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের ডিসি শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত প্রচুর রিকশা চলাচল করছে। সেজন্য লকডাউনেও লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছে। অনুমোদিত লোক ছাড়া আমরা রিকশা অ্যালাউ (অনুমোদন) করছি না। সেখানে আমরা রিকশা নিরুৎসাহিত করছি। তিনি বলেন, হাইওয়েতে গত দু-তিন দিনে দু-তিনটা দুর্ঘটনা আছে। সেজন্য আমরা হাইওয়েতে রিকশা সেভাবে অ্যালাউ করছি না, হাইওয়েতে রিকশা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এছাড়াও রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলাম।



 

Show all comments
  • A R Shohel Shohel ১২ জুলাই, ২০২১, ১:২০ এএম says : 0
    যতসব দোষ গরীবের যানবাহনের।।। ধনীর দুলালের কোন বিচার নাই
    Total Reply(0) Reply
  • Tareq Aziz ১২ জুলাই, ২০২১, ১:২০ এএম says : 0
    এটাতো ভালো সংবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • Noorjahan Akter ১২ জুলাই, ২০২১, ১:২১ এএম says : 0
    · ভালো সিদ্ধান্ত, কারণ অটোরিকশার কারণে এক্সিডেন্ট বেশী হয়
    Total Reply(0) Reply
  • Md Alamin Khan ১২ জুলাই, ২০২১, ১:২২ এএম says : 0
    এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত তাহলে উন্নত দেশে গরিব মানুষের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন
    Total Reply(0) Reply
  • Mofajjul Hossain Mofajjul Hossain ১২ জুলাই, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
    অটো রিকশা বন্ধ করার দরকার কারন এই রিকশায় বায়ুদূষণ করেনা পরিবেশের কোন খতি করেনা।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Hanif ১২ জুলাই, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
    বন্ধ না করে রোট পরমিট দিলে উভয়ের লাভ
    Total Reply(0) Reply
  • nasiruddin ১২ জুলাই, ২০২১, ১০:৪৩ এএম says : 0
    এই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না,ঐলোকদের কর্ম ব্যবস্তা করতে হেব,নীতিমালায় চলাচল গতিবেগ নিয়ত্রন করে দিতে হবে
    Total Reply(0) Reply
  • মুহাম্মাদ আরিফ বিল্লাহ ১২ জুলাই, ২০২১, ১১:২৯ এএম says : 0
    অটোরিকশার জন্য আলাদা লেন তৈরি করে দেওয়া হোক। গরিব মানুষের এই যানগুলো গরিব মানুষের অনেক উপকারে আসে। যদিও ধনীদের রাস্তায় যানজট তৈরি করে। অথবা তাদের জন্য আলাদা কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। তা না করে অটোরিকশা বন্ধ করে দেয়া হবে সম্পূর্ণ অমানবিক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ