Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

গাজীপুরের শ্রীপুরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনে নারী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২১, ৬:১৩ পিএম | আপডেট : ৯:১০ পিএম, ১১ জুলাই, ২০২১

ভাওয়ালের গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ দৃষ্টি সীমানা পেরিয়ে গেছে। সড়কের দুইপাশে ও মাঝখানে সাদাবর্ণের লম্বা শৃঙ্খলিত সারি যেন দৃষ্টিকে সড়কের অস্তিত্ব গভীর অরণ্যেও জানান দেয়। সবুজে ঘেরা এ সড়কেই দা, কোদাল ও লাঠি হাতে একদল নারী সড়ক পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন। নারীরা বাড়িতে যেমনি ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করেন, সৌন্দর্যবর্ধন করেন সড়কের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গাজীপুরের শ্রীপুরে গ্রামীণ সড়ক মেরামত, সৌন্দর্যবর্ধন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন নারীরা।

বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ খানের নেতৃত্বে এলজিইডির সারাদেশে চলমান বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে এটাও একটা মাইলফলক।

প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্রামীন সড়কের সৌন্দর্যবর্ধন সহ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন। প্রতি ইউনিয়নে ১০ জন নারীর একটি দল সপ্তাহের ৬দিন এসব কাজ করেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে এলজিইডির আওতাভুক্ত বিভিন্ন গ্রামীণ সড়কে।

নারীরা যে কেবল ঘরের ভেতর নয় বাইরেও পুরুষের মতো সকল কাজে সমান পারদর্শী সে প্রমাণটাই রেখে চলেছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ৮০জন সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নারীকর্মী।

শ্রীপুরের মাওনা ইউনিয়নের আরএমএ সভাপতি হোসনে আরা বলেন, সাধারণত আমরা ছোটখাট মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করি। কার্পেটিং এর উপর ঘাস জমে থাকলে সেগুলো তুলে ফেলি, সড়কের পাশে গর্তে পানি জমে থাকলে নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন করে দেওয়া, সেই গর্তগুলো ভরাট করা, সড়কের শোল্ডারে মাটি সরে গেলে সেখানে মাটি দিয়ে মেরামত করা,সড়কের পাশের ঝোপঝাড় কেটে দেয়া ইত্যাদি আমাদের কাজ।

প্রহলাদপুর ইউনিয়নের স্বামী পরিত্যক্তা বজনা রানী দাস বলেন, মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকা বেতনে এই চাকুরি করি। এর মাঝে ২৪০০ টাকা ব্যাংক একাউন্টে সঞ্চয় হিসাবে বাধ্যতামূলক জমা করতে হয়। এই কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে ১ সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালোভাবেই জীবনযাপন করছি। আমার একমাত্র সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারছি।

তিনি জানান, এই প্রকল্প থেকে এলজিইডির মাধ্যমে অল্প টাকায় ঘরের পাশেই কিছু করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মাসিক মজুরি থেকে যে ২৪০০ টাকা জমা হচ্ছে তা প্রকল্পের মেয়াদ শেষে একবারে উত্তোলন করা যাবে। উক্ত টাকা একত্রে পেলে এসব প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য স্থায়ীভাবে আয়ের একটা ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

স্থানীয় লোকজন জানান, যেসব মহিলারা সড়কে কাজ করছে তারা সকলেই দুঃস্থ অথবা স্বামী পরিত্যাক্তা। মহিলা কর্মীদের এসব রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োগ প্রদানের ফলে একদিকে যেমন বেকারত্বের অবসান হচ্ছে তেমনি সড়কের স্থায়িত্ব যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে স্থানীয় জনগণ উপকৃত হচ্ছে।

সড়কে চলাচলকারী অটোরিক্সা চালক ও ফাউগান গ্রামের সাহাব উদ্দিন বলেন, এসব নারীরা বিগত দুই বছর এর বেশি সময় ধরে সড়কে কাজ করছে। সড়কে অথবা সড়কের পাশে এখন আর ঘাস হয়না, ঝোপ-ঝাড় থাকে না, পানি জমি থাকে না, গর্ত থাকে না। ফলে সড়কের চলাচলে নিরাপত্তা বেড়েছে। যানবাহন ও পথচারী চলাচলে ঝুঁকি কমে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে গেছে।

এলজিইডি সূত্র জানায়, দুই বছর ধরে এই প্রকল্প চলমান থাকলেও ঢাকা বিভাগীয় প্রধান হিসাবে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী যোগদান করার পর প্রকল্পের কাজে গতি ফিরেছে। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী লকডাউনের মধ্যেও সকল কাজ-কর্ম মনিটরিং করছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর শ্রীপুর এর উপজেলা প্রকৌশলী এ জেড এম রকিবুল আহসান এ প্রসঙ্গে বলেন, এলজিইডির “পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচী-৩ (আরইআরএমপি-৩)” এর আওতায় গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ যেমন পাকা সড়কের শোল্ডার, সড়কের স্লোপ, রেইনকাট মেরামত, বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলের ফলে সৃষ্ট খাদ ভরাট, প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত, জঙ্গল পরিষ্কার, ছোট ছোট ব্রীজ/কালভার্টের এপ্রোচ মেরামত ও সড়ক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়।

সাধারণত বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা এবং নারী পরিবার প্রধান হতদরিদ্র ও দুঃস্থ মহিলারা যারা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনে সক্ষম তারা এ কর্মসূচীর মাধ্যমে কাজ করেন। শ্রীপুর উপজেলায় প্রতিটি ইউনিয়নে ১০ জন করে সর্বমোট ৮০ জন কর্মী এসব কাজে নিয়োজিত আছেন যারা দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ২৫০ টাকা মজুরির বিনিময়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এসব কাজ করেন। মজুরী ছাড়াও এদেরকে স্বাবলম্বী করতে হাস-মুরগী পালন, গরু-ছাগল পালন, মাছ চাষ, ঘরের আঙিনায় সবজী চাষ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল বারেক বলেন, “পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচী-৩ (আরইআরএমপি-৩)” এর আওতায় সারাদেশের ৬৪ টি জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে ১০ জন করে নারী কর্মী ৪ বছরের জন্য নিযুক্ত হয়ে সারা দেশে এলজিইডির আওতাধীন সড়কসমূহ বছরব্যাপী রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। গাজীপুর জেলার সদর উপজেলা ছাড়া অন্যান্য সকল উপজেলার প্রতি ইউনিয়নে ১০ জন করে নারী কর্মী এই কর্মসূচীতে কাজ করছেন। কোথাও নারী কর্মী পাওয়া না গেলে এ কাজে এখন ৩০ ভাগ পুরুষ কর্মীদের ও সংযুক্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় গাজীপুর জেলায় পাকা সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আরো ১৩৮ জন মহিলা কর্মী নিয়োজিত আছেন এবং তারা নিয়মিত সড়কের অফ-পেভমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করে যাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে এলজিইডি ঢাকা বিভাগীয় প্রধান ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মন্মথ রঞ্জন হালদার বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মাননীয় এলজিআরডিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী এবং এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দিক-নির্দেশনায় সারাদেশেই এলজিইডি দুঃস্থ মানুষের ভাগ্যে উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মহামারীর সঙ্কটকালে দুঃস্থ নারীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক আরইআরএমপি-৩ প্রকল্পটি সারাদেশের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ