Inqilab Logo

বুধবার, ০৫ জুন ২০২৪, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

করোনায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ পরিবার পরিকল্পনায় নারীর পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ ১১ জুলাই। ২০২১ সালের করোনা মহামারি বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘অধিকার ও পছন্দই মূলকথা ঃ প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্খিত জন্মহারে সমাধান মেলে।’ গত ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত ইউএনএফপিএ’র ‘আমার শরীর, কিন্তু আমার পছন্দ নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ৫৭ টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি নারী যৌনমিলন, জন্মনিয়ন্ত্রণ এমনকি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেনা। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা বাস্তবতায় সারা বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা, স্বাস্থ্য সেবায় বিঘ্ন, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ইউএনএফপিএ : ২০৩০ সাল নাগাদ জন্মনিয়ন্ত্রনে কাঙ্খিত সাফল্য, মাতৃমৃত্যুহার কমানো, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ব কিন্তু কোভিড বিশ্বে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত, বলেছে ইউএনএফপিএ।

সূত্র মতে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু করোনা মহামারীর মধ্যে এদেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারনে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারী দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধ এবং বিদেশ থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হওয়াও বাল্যবিবাহের কারন।

২০২০ সালে অক্টোবরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রথম তিন মাসে (মার্চ-জুন ২০২০) সারাদেশে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, গত জুন মাসে ৪৬২টি কন্যা শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয় এর মধ্যে প্রশাসন ও সচেতন মানুষের আন্তরিক সক্রিয় উদ্যেগে ২০৭টি বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যপী আনুমানিক ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, আর বাল্যবিবাহের শিকার ১০ লাখ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২ লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অশুভ। করোনা মহামারীর কারনে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।
মেরী স্টোপস বাংলাদেশের আ্যডভোকেসি ও কমিউনেশন হেড মনজুন নাহার বলেন, বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারন, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।

সূত্র মতে, এই ধরণের মহামারি অবস্থার পরপরই গর্ভধারন, বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা এবং অনাকাঙ্খিত গর্ভধারন ও অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি সাধারন প্রবণতা। তাই মহামারির প্রথম থেকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সহযোগীতায়, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, মেরী স্টোপসসহ কয়েকটি সংস্থা নিরাপদ মাতৃত্ব, সন্তান ধারন, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার এবং এই সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মসূচী এবং তথ্যসেবাসমূহ নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮ এর ব্যবস্থাপক চৌধুরী মোহামেইন বলেন, শিশু বিবাহ রোধে মহামারী কালে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ৪৫০টি কল পেয়েছে যার সংখ্যা আগের মাসে ছিলো ৩২২টি। এই হার বর্তমান সময়েও ঊর্ধমুখী প্রবনতায় অব্যহত রয়েছে। আয় কমে যাওয়া বাল্যবিবাহের প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে কিনা তার প্রতিক্রিয়ায় ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলে বলেন, দারিদ্র্য অবশ্যই শিশু বিবাহের অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। তবে, করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমরা এখনো বিশদ তথ্য জানতে পারিনি।

করোনার বিবেচনায় করোনা বাস্তবতায় বদলে যাওয়া পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকটাই দূর্বল হয়েছে আর পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাত আরো অবহেলিত। করোনা দুর্বল করেছে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত এবং দেখিয়েছে জীবন জীবিকার বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা। জাতিসংঘ বলেছে, করোনার নানামুখী প্রভাবে ২০২০ সালে প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার শিশুমৃত্যু এবং ১১ হাজার মাতৃমৃত্যু হয়েছে।

করোনার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চরম ব্যহত হয়েছে। ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একযোগে বলছে সাউথ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা করোনার কারনে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় এবং স্কুল বন্ধ থাকায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশুর অনিশ্চত ভবিষ্যৎ এর আশঙ্কায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ। যার ফলে ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদন বলছে, অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে। ১ দশমিক ৯ লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার বন্চিত হয়েছে।
লকডাউন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে (বিশেষত যেখানে সামাজিক সুরক্ষা বলয় সীমিত)। তাই লকডাউনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠার ক্ষমতা ধনী রাষ্ট্রগুলোর থাকলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রগুলি এ বাস্তবতায় কতদূর টিকে থাকতে পারবে, সেটি একটি কঠিন প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিনই করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে। বর্তমান সময়ে সবথেকে কঠিনতম সময় পাড় করছে বাংলাদেশ। বাড়তি সংক্রমণ আর অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা নিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। এর মধ্যে জনসংখ্যা দিবস উদযাপনে বাংলাদেশের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সকলের সম্পৃক্ততায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। অনলাইন স্বাস্থ্য সেবার আওতা বাড়াতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে এখনই।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলামের মতে, করোনাকালে সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্তমান সময় বিবেচনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে আ্যপস ভিত্তিক সেবার গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে হবে। মোবাইলের ব্যবহার বৃদ্ধি করে ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করতে হবে সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয় পক্ষকেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সুখী পরিবার নামক কল সেন্টার ১৬৭৬৭ কল করে সরাসরি ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা গ্রহনে গ্রামীণ নারীদের আগ্রহী করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, আ্যপস ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও দক্ষ করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ