Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আশ্রয় হারিয়ে মানবেতর জীবন

অব্যাহত ভাঙন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২১, ১২:০৫ এএম

ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অবিরাম ভারী বর্ষণে দেশের নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিচ্ছে ভাঙন। দেশের উত্তর ও উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পদ্মা-মেঘনার ভাটি ও মোহনা পর্যন্ত নদীভাঙন চলছে তীব্র আকারে। কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান : পানি বৃদ্ধির সাথে ঘূর্ণিস্রোতে নদী ভাঙন আরও বাড়তে পারে। নদীতীর দখলবাজি, ভরাট, অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত ড্রেজিংয়ের অভাবে নদ-নদীসমূহ নাব্য ও পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এরফলে নদী ভাঙনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাপক ভূমি বিলীন হচ্ছে নদীগর্ভে।
সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, কোথাও কোথাও অতিবৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। প্রধান নদ-নদীগুলোর উজানের অববাহিকায় বাড়ছে পানি। উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল, সিকিম, গাঙ্গেয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ এবং মধ্য-ভারত, নেপাল থেকে ঢল নেমে আসছে ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে। এতে করে ফুলে-ফুঁসে উঠছে অধিকাংশ নদ-নদী।

উত্তর জনপদে তিস্তা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করে। উজানে ভারতে গজলডোবা বাঁধ খুলে দেয়ায় তিস্তায় বাড়ছে পানি। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম এবং তিস্তা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল বন্যার মুখে রয়েছে। ইতোমধ্যে তিস্তাপাড়ে ভাঙন এবং চর ও নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৬৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৭টিতে হ্রাস পায়। ৫টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত থাকে। গত বুধবার নদ-নদীর ৬৪টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৯টিতে হ্রাস পায়। মঙ্গলবার ৫৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৫১টিতে হ্রাস পায়। সোমবার ৬০টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৯টিতে হ্রাস পায়। রোববার ৫৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি ও ৩৮টিতে হ্রাস পায়।

নদ-নদীসমূহের সার্বিক প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো জানায়, তিস্তা নদীর পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এরফলে তিস্তা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদে পানি স্থিতিশীল বা অপরিবর্তিত রয়েছে। এ অবস্থা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকায় নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে পারে।

গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রধান নদ-নদীর পানি প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবোর তথ্য-উপাত্তে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি ১৮ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে। তিস্তা নদী কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৬ সে.মি. নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদী কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৭৪ সে.মি. নিচে রয়েছে।

ব্রহ্মপুত্র নদ চিলমারী পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬০ সে.মি. নিচে অবস্থান করছে। যমুনা নদ সাঘাটা, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি ও ফুলছড়িতে বিপদসীমার ৪০ থেকে ৭১ নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা গোয়ালন্দে ৫৫ ও সুরেশ^রে ৬৭ সে.মি. নিচে রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুরমা নদীর পানি হ্রাস পেয়ে সুনামগঞ্জে বিপদসীমার ৪৫ সে.মি. নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। কলমাকান্দায় সোমেশ^রী নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ১২ সে.মি. নিচে এসেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, কোথাও কোথাও অতিবৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় দার্জিলিংয়ে ১৪৪, গ্যাংটকে ৬৪, শিলংয়ে ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে গত ২৪ ঘণ্টায় উল্লেখযোগ্য ভারী বৃষ্টি হয়েছে, খুলনায় ১১০, চাঁদপুরে ৫২, সুনামগঞ্জে ৫০ মি.মি.। তবে গত কয়েকদিনে সারা দেশে সার্বিক বৃষ্টিপাত হালকা থেকে মাঝারি ধরনের।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম)উপজেলা সংবাদদাতা জানান : ব্রহ্মপুত্রের থাবায় বাড়িঘর সাজানো সংসার হারিয়ে দিশেহারা মানুষ। পানি বৃদ্ধিও সাথে সাথে কুড়িগ্রামের চিলমারীর বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে উপজেলা নয়ারহাট ইউনিয়নে।

ভাঙনে ইতোমধ্যে দক্ষিণ খাউরিয়া স্কুল এন্ড কলেজ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার সাথে সাথে শত শত বাড়িঘর ভেঙে নিয়েছে ব্রহ্মপুত্র। নদী ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ খাউরিয়া স্কুল এন্ড কলেজের সদ্য নির্মিত কোটি টাকার ভবন, কমিউনিটি হাসপাতাল, দক্ষিণ খাউরিয়া বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে হুমকির মুখে।
সদ্য নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো পার করছে মানবেতর জীবন যাপন। তারা জানায় একদিকে করোনা ভয় এর উপর কঠোর লকডাউন তার উপর ব্রহ্মপুত্রের থাবায় আমরা মুশকিলে আছি, নেই খাওয়ার ব্যবস্থা চলে গেছে থাকার জায়গা। নদী ভাঙন এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে মানুষের আহাজারি।

সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী জোতি প্রসাদ ঘোষসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি টিম। প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ভাঙন ঠেকাতে কিছু জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ শুরু হলেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ।

স্থানীয়রা বলেন, জিও ব্যাগ পরিমাণ মতো দেয়া হয়নি এছাড়াও যেনতেন ভাবে ফালানো হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রধান প্রকৌশলী উত্তরাঞ্চল জোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, ভাঙন এলাকা আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করেছি ইতোমধ্যে কিছু জিও ব্যাগ দেয়া হয়েছে এছাড়াও প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ইসলামপুর (জামালপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান : জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার ৯নং গোয়ালের চর ইউনিয়নের সভারচর, গায়েন পাড়া, মোহাম্মদপুর ও চর মোহাম্মদপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি স্থানে তীব্র ভাঙেেনর সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙনের ফলে ওই সব এলাকার জনবসতি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে শুষ্ক মৌসুমে ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশে ঘূর্ণবর্তার সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে নদীর তীরবর্তী এলাকায় এ বছর নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে সভার চর গায়েন পাড়া, মোহাম্মদপুর, চর মোহাম্মদপুর এলাকার মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।

নদীর তীরবর্তী জনপদ রাস্তা-ঘাট, মসজিদ, মাদরাসা ও চর মোহাম্মদপুরে একমাত্র নবনির্মিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদী থেকে কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরত্বের কম হওয়ায় বিদ্যালয়টি হুমকির মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার তাদের বাড়ি ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। নদী ভাঙনের ফলে কৃষকরা তাদের রোপনকৃত পাট কাটার উপযুক্ত সময় হওয়ার আগেই কাটতে হচ্ছে। এতে কৃষকদের আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান : পানির তোড়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার আহাম্মদ নগর-দিঘিরপাড় সড়কের ৮২-৮৩ ফুট ইউডেনসহ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ এখন চরমে। গত সপ্তাহে টানা ৩-৪ দিনের ভারী বর্ষন ও মহারসি, কালগুসা ও সোমেস্বরী নদীতে পাহাড়ি ঢলে ভারত থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে রাস্তাটি ভেঙে পানি নিন্মাঞ্চলের বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ে এবং নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। এ পথে যাতায়াতকারী লোকজনের বিকল্প রাস্তা মহারশী নদীর বেড়িবাঁধ ৫০-৬০ফুট ভেঙে গেছে। ফলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ৩-৪ হাজার মানুষকে উপজেলা শহরে বা অন্য গ্রামে যাতায়াত করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারুক আল মাসুদ বন্যাকবলিত এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া করোনা সহায়তার টাকা বিতরণ করছেন। বন্যাকবলিতদের জন্য ৮২.৩৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে জানান তিনি। অপর দিকে পানির তোড়ে আহাম্মদ নগর- মোহনগঞ্জ নির্মাণাধীন সড়কের গজার মারি ব্রীজ সংলগ্ন সড়কটি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকা। ঠিকাদারের আনা কয়েক লাখ টাকার বালিও ঢলের পানির তোড়ে ভেসে গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানি

২৫ অক্টোবর, ২০২২
২১ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ