দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
হিজরি বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ মাস জিলহজ মাস। এ মাস চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম। এটি হজের মাস, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার মাস, প্রভুর সান্নিধ্য লাভের মাস। পবিত্র রমজান মাসের পর গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সময় হলো জিলহজ মাসের প্রথম ১০দিন। এই দিনগুলোর ইবাদত আল্লাহতায়ালার নিকট অতি প্রিয়।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা পবিত্র কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই দশকের রাতের শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‹শপথ ফজরের, শপথ দশ রাতের।› (সূরা আল-ফজর, আয়াত নং-১-২)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও মুজাহিদ (রহ.)সহ অনেক সাহাবি, তাবেয়ি ও মুফাসসির বলেন, এখানে ‘দশ রাত’ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
সুতরাং এই দশ দিনের আমল আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। এই দশ দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহর নিকট জিলহজ মাসের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও এর চেয়ে উত্তম নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদের চেয়ে উত্তম যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি।গ্ধ (সুনানে আবু দাউদ, সহিহ বুখারি, জামি তিরমিজি, সুনানে ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)।
অন্যত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হল, জিলহজ মাসের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হলো, আল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ঐ ব্যক্তি যার চেহারা ধুলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত লাভ করেছে।গ্ধ (মুসনাদে বাযযার, মুসনাদে আবু ইয়ালা, মাজমাউল যাওয়াইদ)।
এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, জিলহজ মাসের প্রথম দশক অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তাই একজন মুসলিমকে ইবাদতের এই সুবর্ণ সময়ের সদ্ব্যবহার করে অন্য সময়ের আমলের ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রস্তুত হওয়া জরুরী।
আক্ষেপের বিষয় হলো, পবিত্র কুরআন-হাদিসে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া এই ইবাদতের সময় সম্পর্কে সমাজের খুব স্বল্পসংখ্যক মুসলিমই ধারণা রাখেন। জিলহজ মাসের প্রথম দশকের উল্লেখযোগ্য কিছু আমল হলো-
ঈদুল আজহার সালাত আদায়: জিলহজ মাসের দশম দিন ঈদুল আজহার সালাত প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষের উপর ওয়াজিব। যা ঈদগাহে গিয়ে আদায় করতে হয়। হজরত আবু সাঈদ (রা.) বলেন, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর এবং আজহাতে ঈদগাহে যেতেন।গ্ধ (সহিহ বুখারি)।
কুরবানি করা: এ দিনগুলোর দশম দিন ঈদের সালাতের পর সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবিকে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কুরবানি করো।গ্ধ (সূরা আল-কাউসার, আয়াত নং-২)।
কুরবানি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির এই দশদিন- নখ, চুলসহ শরীর থেকে কোনো কিছু কর্তন না করা মুস্তাহাব। এ সম্পর্কে হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, ্রযে ব্যক্তি জিলহজ মাসের চাঁদ দেখে এবং কুরবানির ইচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কুরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে।› (সহিহ মুসলিম)। এ আমল মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। ফিকাহবিদগণ বলেছেন, কুরবানি করার আগে নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি না কাটার পেছনে হিকমত হচ্ছে হজযাত্রীদের সঙ্গে সাদৃশ্য করা। কারণ, তাদের ইহরাম অবস্থায় এ সব কাটা নিষিদ্ধ।
তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা: জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখের আসর নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। এটি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সকল বালেগ পুরুষ, মহিলা, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী বা একাকী আদায়কারী প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। (ফাতাওয়ায়ে শামি, বাহরুর রায়েক)। পুরুষের জন্য তাকবিরে তাশরিক জোরে পড়া ওয়াজিব। আস্তে পড়লে তাকবির পড়ার হক আদায় হবে না। আর মহিলাগণ নিচু আওয়াজে অর্থাৎ নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে। (রদ্দুল মুহতার,এলাউস সুনান)।
তাকবিরে তাশরিক হলো- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহ আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
অধিক পরিমাণে আল্লাহতায়ালার নামের জিকির করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলার নিকট জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করো।গ্ধ (মুসনাদে আহমদ, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)।
আরাফার দিনে রোজা রাখা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি মনে করি, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা এক বছর পূর্বের ও এক বছর পরের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন।” (সহিহ মুসলিম)। আরাফার দিন ছাড়াও ঈদের দিন ছাড়া প্রথম দশকের বাকি নয় দিন রোজা রাখাকে মুস্তাহাব বলেছেন ইমাম নববি (রহ.)।
ঈদের দিনের যাবতীয় সুন্নতসমূহ পালনে সচেষ্ট হওয়া।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন!
লেখকঃ আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।