Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিম্নআয়ের মানুষ এখনো কিছুই পায়নি

লকডাউনে ১ লাখ ৩০ হাজার ৮০৬ টন চাল ও ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

কঠোর লকডাউনে ফাঁকা সারা দেশ। রাস্তাঘাটে মানুষই নেই। অন্যদিকে বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে বন্যা, নদী ভাঙন এবং তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদ-নদীর পানির সমতল বাড়ছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে বড় ধরনের আকস্মিক বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জরুরি বাঁধ মেরামত কাজ জেলা প্রশাসককে (ডিসি) অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক।

এদিকে লকডাউনে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। এদিকে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জেলা পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম সুসমন্বয়ের লক্ষ্যে সরকারের সিনিয়র সচিব ও সচিবদের ৬৪ জেলায় দায়িত্ব প্রদান করলেও তা গত তিন দিন ধরে কোনো জেলায় সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।

এদিকে গতকাল রোববার দেশের ৬৪ জেলায় ১ লাখ ৩০ হাজার ৮০৬ টন ও ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে ইনকিলাবকে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন। তিনি বলেন, অনেক জেলায় গত ২৭ ও ২৮ জুন অনেক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেগুলো থেকে ডিসিরা বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদ-নদীর পানির সমতল বাড়ছে, যা আগামী তিন দিন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, যা আরো দুই দিন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানির সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় কমতে পারে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের গাণিতিক মডেলের তথ্যানুযায়ী আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের স্থানগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। এর ফলে এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীগুলোর পানির সমতল সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে কিছু স্থানে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

গতকাল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিয়ম রোধে জরুরি বাঁধ মেরামত কাজ জেলা প্রশাসককে (ডিসি) অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি গঠনের মাধ্যমে করতে হবে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বন্যাসহ যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। স্কুল-কলেজ, হাট-বাজারসহ নদীভাঙন রোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। কোথাও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেই ব্যবস্থা নিচ্ছে আমাদের প্রকৌশলীরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সারা দেশে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি এবং অনলাইনে নির্দেশনা দিচ্ছি। তিনি বলেন, করোনার মধ্যেও আমাদের সকল প্রকৌশলী দুর্যোগ মোকাবিলায় দিনরাত কাজ করছেন। এ সময় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) রোকন উদ দৌলা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ফজলুর রশিদ উপস্থিত ছিলেন।

গত ৩০ জনু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অফিস, শপিংমল, দোকানপাট এবং গণপরিবহন ছাড়াও এবার সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র, জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। অতি জরুরি প্রয়োজন (ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি) ছাড়া কেউ কোনোভাবে ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না। নির্দেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরিপত্রে আরো বলা হয়, শিল্পকারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি পরিষেবা যেমন কৃষিপণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, করোনার টিকাদান, রাজস্ব আদায় কার্যাবলি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন, ইন্টারনেট, গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা, ডাকসেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি বা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান, কার্গো ভেসেল এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে না। বন্দরগুলো (বিমান, সমুদ্র, নৌ, স্থল) ও সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে। কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। টিকা কার্ড দেখিয়ে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে। খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রি (অনলাইনে কেনা বা খাবার নিয়ে যাওয়া) করতে পারবে। হোটেলে বসে খাওয়া যাবে না। এর পর থেকে দেশের নিম্নআয়ের মানুষের কাজ না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।

গতকাল বিকালের দিকে ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে বসা নাসের আলীর সঙ্গে কথা হয়। সে জানায় একটি দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে সে কাজ করে। লকডাউনের আগে সারাদিন ফুটপাথে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বিক্রি হতো। আজ ১৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। সেই টাকা দিয়েই কোনোমতে সংসার চলাতে হচ্ছে।

নাসেরের বাড়ি কুমিল্লা। তার বাবা অসুস্থ। বসতবাড়ি ছাড়া তাদের তেমন কোনো জমি-জমা নেই। সংসারে অভাবের কারণে পড়াশোনাও হয়নি। নাসেরকে ধরতে হয়েছে পরিবারের হাল। অসুস্থ বাবা হাঁটা-চলা ও কোনো কাজ করতে পারেন না বলে জানায় নাসের। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে থাকা গৃহবধূ নাসিমা বেগম নুজাহান রোর্ডের একটি অভিজাত পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। কিন্তু নতুন করে লকডাউনের কারণে আর কাজে নিচ্ছে না গৃহকর্তা।

আসাদ গেট মোড়ে এক বৃদ্ধ রিকশাচালক রফিকুল বলেন, কাকডাকা ভোরে বাসা থেকে বের হলেও মাত্র একজন যাত্রী নিয়ে ধনিয়া থেকে এসেছেন। বৃষ্টিতে ভিজে আধাঘণ্টা যাবত যাত্রীর অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, একে তো মার্কেটসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তারওপর বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় মানুষ নেই। সরকার রিকশা চলাচলের অনুমতি দিলেও মানুষ রাস্তায় বের হতে না পারলে তাদের রোজগার তো নাই।

কুড়িগ্রামের উলিপুরে থেতরাই ইউনিয়নে অবিরাম বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্ট দফতর বিভিন্ন এলাকায় জিও টিউব ও বালির বস্তা ফেলতে শুরু করেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নতুন করে ভাঙনের মুখে রয়েছে সহস্রাধিক বসতবাড়ি ও প্রচুর ফসলি জমি। ভাঙন আতঙ্কে নদী পাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলো নতুন ঠিকানার সন্ধান করছেন। এদিকে তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে নানা ধরনের ফসলসহ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। টানা ভাঙনে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে চরাঞ্চলের পরিবারগুলো।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভুক্তভোগি ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে কয়েক হাজার একর আবাদি জমিসহ অন্তত ৩ হাজার বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তিস্তায় পানি বৃদ্ধির ফলে নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে হাজারও একর ফসলি জমি, গাছপালা ও বসতবাড়ি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী জানান, ভাঙন রোধে জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। তিস্তার ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে রক্ষায় বিশেষ বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বরাদ্দ পেলে প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক ইনকিলাবকে বলেন, বগুড়ায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে যারা ৩৩৩-এ কল দিচ্ছেন তাদের বাসায় ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে। তালিকা করে দেয়া হচ্ছে উপজেলায় পর্যায়ে। নতুন বরাদ্দ থেকে দেয়া শুরু করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আল মারুফ জানান, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার চন্ডিপুর, তারাপুর, হরিপুর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর ইউনিয়নের কিছু চরে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খোঁজ খবর রাখছে।

কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু বলেন, তিস্তার ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে রক্ষায় বিশেষ বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে কিছু দেয়া হয়নি। তবে তালিকা করা হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ