Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গ্রামগঞ্জে করোনার চেম্বার

সতর্ক প্রচারণা স্বাস্থ্যবিধি মাস্কের ব্যবহার নেই

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৭ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

জনগণকে সম্পৃক্ত করে শাটডাউন কর্মসূচি দিতে হবে। সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সকল রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করতে হবে। হাটবাজার এবং গ্রামে ঘরে ঘরে গিয়ে তারা করোনার ভয়াবহতা তুলে ধরে মানুষকে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন। আমলা দিয়ে এগুলো সম্ভব নয়।

অধ্যাপক মো. আমিনউল্লাহ রংপুরের পীরগাছা মহিলা কলেজের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক। মাস্ক পরে উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের পাওটানা হাট যান। মোটর বাইক থেকে নামতেই বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের টিপ্পুনি, ‘অধ্যাপক সাহেব মাস্ক পরেছে’। হাটের অনেকেই যেন ‘বানর খেলা দেখছেন’ সেই ভঙ্গিমায় তাকিয়ে থাকেন কলেজের এই অধ্যাপকের দিকে। লজ্জা আর অপমানে এক সময় মাস্ক খুলে কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে আসেন। নিলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলা সদরে থাকেন মো: মশিউর রহমান। এক সময় ঢাকায় বাম ধারার রাজনীতি করতেন। নিজ এলাকার কলেজ শিক্ষিকাকে বিয়ে করে গ্রামের বাড়ি জলঢাকায় ব্যবসা করছেন। ব্যবসায়ী হওয়ায় উপজেলা সদরের বাজারে দিনের বেশি সময় কাটাতে হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে মুখে মাস্ক পরে থাকতে অভ্যস্ত হন। এ জন্য প্রতিদিনই তাকে কারো না কারো মুখে কট‚ কথা শুনতে হয়। বন্ধুরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেন, ‘মিয়া ফুটানি দেখায়, গ্রামের হাটে মাস্ক পরে থাকে’। শুধু আমিনউল্লাহ আর মশিউর রহমান নয়; গ্রামগঞ্জের হাটবাজার ও উপজেলা সদরে যারা করোনা থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক পরেন তাদের নানান টিপ্পুনি হজম করতে হয়। অথচ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম ও চরাঞ্চলে বসবাস করেন এমন ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন গ্রামে ঘরে ঘরে এখন জ্বর, সর্দিকাশির পাদুর্ভাব ঘটেছে। পরিবারের সদস্যদের কারো জ্বর সেরে গেলে আবার কেউ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। গ্রামের হাটবাজারগুলোর ডিসপিনসারীগুলোতে সর্দি জ্বরের ওষুধের বিক্রি বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা সীমান্ত জেলাগুলোতে সামাজিক সংক্রমণের পর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি ‘ডেল্টা প্লাস’ ছড়িয়ে পড়ার তথ্য মিলছে। আবার লকডাউন বা অন্য সময়ে রাজধানী ঢাকা থেকে যারা গ্রামে আসা যাওয়া করছেন তাদের মাধ্যমেও গ্রামে করোনাভাইরাস সামাজিক সংক্রমণ ঘটছে। জনবহুল দেশে নমুনা পরীক্ষা ঠিকমতো হলে প্রতিদিন লাখ লাখ করোনা সংক্রমণ রোগী শনাক্ত হতো। গ্রামে কোয়ারেন্টিনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকা থেকে বা সীমান্ত পেরিয়ে দেশে এসে যারা গ্রামে যাচ্ছেন তারা অবাধে হাট-বাজারে ঘুরছেন; মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছেন। ফলে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর মতোই দেশের গ্রামগুলোতে হুহু করে বাড়ছে করোনার সামাজিক সংক্রমণ। প্রশাসনিক চাপে বা ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ প্রচারনায় শহরের মানুষ ঘর থেকে বের হলে মুখে মাস্ক পড়ছেন। কিন্তু গ্রামে কেউ মুখে মাস্ক পরছেন না। যারা মুখে মাস্ক পরেন তাদের সাধারণ মানুষের কেউ ‘ফুটানি’ কেউ ‘হঠাৎ ভদ্রলোক’ হিসেবে টিপ্পুরি কাটেন। এ ছাড়া গ্রামে করোনাভাইরাসে ভয়াবহতা ও মানুষকে সচেতনমূলক কোনো প্রচার প্রচারণা নেই। ফলে গ্রামগুলো যেন হয়ে উঠছে করোনার চেম্বার।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্যের বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগের মধ্যে মারা গেছেন ২৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ২৩ জন, রাজশাহী বিভাগের ১৬ জন, খুলনা বিভাগের ২৭ জন, সিলেট বিভাগের ৩ জন, রংপুর বিভাগে ১০ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জন। এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন ৮৩ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ১৪ জন আর বাড়িতে ১১ জন। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ আগের দিন ২৪ জুন ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ শতাংশ। কয়েকটি জেলায় করোনা সংক্রমণ কম। দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। স্বাথ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে সামান্যই। তবে এই পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খুলনা বিভাগে। এই বিভাগে ২৬২৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩২২ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শনাক্তের হার ৫০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যা আগের দিন ৩৮ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল। ঢাকা বিভাগে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আগের দিনের ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ দশমিক ৮৩ দশমিক শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ দশমিক ০৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ দশমিক ৫৮ শতাংশ হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে শনাক্ত বেড়েছে।

গত দুই দিনে বৃহত্তর রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর, বৃহত্তর রাজশাহী, বৃহত্তর বগুড়া, বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর যশোর জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় অর্ধশত মানুষের সঙ্গে কথা হয়। বিভাগীয় শহর, উপজেলা শহর, গ্রামের হাটবাজার এমনকি তিস্তা, পদ্মা ও যমুনার চরে বসবাস করেন এমন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা সবাই জানান, গ্রামে প্রতিটি বাড়িতেই বেশিরভাগ মানুষ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিধি মানা, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা নিয়ে কোনো প্রচারণা নেই। মানুষও সেগুলো মানছেন না। তবে সীমান্ত এলাকার মানুষ বলেছেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার পাদুর্ভাবে মানুষকে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। চরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ বলেছেন, করোনা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো সচেতনতামূলক প্রচারণা নেই। স্থানীয় প্রশাসনের কেউ করোনা বা মাস্ক পরতে বলছে না। যার সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে আসছেন বা রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রামে আসছেন তারা অবাধে হাটবাজারে যাচ্ছেন; কেউ বাধা দিচ্ছে না। পীরগাছা মহিলা কলেজের অধ্যাপক মো: আমিনউল্লাহ বলেন, গ্রামের হাটবাজারে গেলে মনে হচ্ছে করোনার খবরাখবর এখন পত্রিকা ও টেলিভিশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গ্রামের মানুষের এ নিয়ে কোনো ভীতি আতঙ্ক নেই। অথচ আমার ৬ সদস্যের পরিবারের ৫ জনই জ্বরে আক্রান্ত। গত কয়েকদিনে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রত্যেকেই জানিয়েছেন তাদের বাড়িতে ও গ্রামের ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বর। নিলফামারীর মো. মশিউর রহমান বলেন, নিলফামারীতে ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বর। রংপুরের সাত মাথার মাহতাব নামের এক চিকিৎসক বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী প্রচÐ ভিড়। এ ছাড়া ও শহরের অর্ধশত হাসপাতালে রোগী গিজ গিজ করছে।

চলমান করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। একইসঙ্গে কমেছে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও। যে সব দেশে দৈনিক লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতো সে সব দেশ এখন পুরোদস্তুর করোনা নিয়ন্ত্রণ করে অফিস খুলেছে কাজে নেমেছে। এমনকি কয়েকদিন আগেও প্রতিবেশি ভারতের দিল্লি, মুম্বাইয়ে করোনা ভয়ঙ্কর রুপ দেখা গেছে। প্রতিদিন ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার মানুষ মারা গেছে। করোনায় মৃত্যুদের শ্মশানে পোড়ানো এবং কবরস্থ করতে না পেরে অনেক লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই ভারত সামাজিক দূরত্ব রক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করায় করোনার লাগাম টেনে ধরেছে। অথচ বাংলাদেশে প্রতিদিন করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত বাড়ছে। রাজধানীতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করলেও খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এমনকি গত ২৪ জুন চুয়াডাঙ্গায় নমুনা পরীক্ষায় করোনা আক্রান্ত দেখা গেছে শতভাগ। গতকাল একদিনে ফের মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জন। নতুন শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৬৯ জন। ১৮ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২৭ হাজার ৬৫৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে শনাক্তের হার ২১ দশমিক ২২ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৪ লাখ ৬৩ হাজার ১১৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় সীমান্ত জেলাগুলো ও রাজধানীতে আতঙ্ক তৈরি হলেও গ্রামের মানুষ করোনাকে ভ্রæক্ষেপ করছে না, কোনো সামাজিক ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতা নেই।
জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, লকডাউন বলেন, আর শাটডাউন বলেন, জনগণকে সম্পৃক্ত করে কর্মসূচি দিতে হবে। না হলে সফলতা পাওয়া যাবে না। এ জন্য সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সকল রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তারা হাটে বাজার এবং গ্রামে ঘরে ঘরে গিয়ে করোনার ভয়াবহতা তুলে ধরে মানুষকে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উৎসাহিত করবে। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন। তিনি বলেন, শুধু আমলা নিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও লকডাউন কার্যকর করা যাবে না। এটা করতে হলে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণ নিজেরাই স্বাস্থ্যবিধি মানবে এবং অন্যকে মানতে প্ররোচিত করবে। কেবল আমলা দিয়ে করোনা মোকাবিলা সম্ভব নয়।

করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গত ২৪ জুন ১৪ দিনের জন্য সারা দেশে ‘শাটডাউন’ ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে ‘শাটডাউন’ ঘোষণার কথা ভাবা হচ্ছে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার সংক্রমণ রোধে ঈদের সময় কঠোর হবে সরকার। যেকোনো মূল্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দ্রæতই কঠোর বিধিনিষেধ আসছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদন হয়ে এলেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে’। প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রচারের পরই ‘শাটডাউন আসছে’ আতঙ্কে মানুষ রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে। গতকালও দেখা গেছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার ফেরিঘাটে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে যেতে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছেন। ঢাকা টু চট্টগ্রাম রুটের গেইট চিটাগাং রোড, গাবতলী, আবদুল্লাহপুরে দেখা গেছে প্রচুর মানুষ গ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ছেন। এই সব মানুষ গ্রামে গিয়ে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ছড়াবেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক গবেষণায় বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১১৪.৪ শতাংশ করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে রংপুর বিভাগ, সেখানে সংক্রমণ বেড়েছে ৮৬.৭ শতাংশ। সংস্থাটি আরো বলছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪০টিই সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে ‘কোভিড-১৯-এর কারণে জনমিতিক ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনগুলো : নতুন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক আয় কমেছে। আর ৩১ শতাংশ পরিবারে ঋণ বেড়ে গেছে।

করোনার সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের প্রচারণা, গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য বিধি না মানা, মাস্ক না পরা ইত্যাদি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারির রানীগঞ্জ ইউনিয়নের আবদুল গফুরের ছেলে মো: দেলদার হোসেন বলেন, গ্রামের প্রতি ঘরে ঘরে সর্দিজ্বর। অথচ কেউ মাস্ক পরে না, করোনা নিয়ে প্রচারণাও নেই। শুধু টিভিতে দেখি করোনা রোগ এসেছে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররা এ নিয়ে কোনো কিছুই বলেনি। এ জন্য মানুষের ধারণা করোনাভাইরাস শুধু ঢাকায়। রংপুরের হারাগাছ পৌরসভার মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন ঢাকা থেকে মানুষ গ্রামে আসছে। তারা হাটবাজারে যাতায়াত করছে। কিন্তু কারো মুখে মাস্ক নেই। জ্বরসর্দি বেড়ে গেছে, মানুষ বলছে মৌসুমি জ্বর। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় কেউ করোনার নমুনা পরীক্ষা করেছেন বলে শুনিনি। টিভির মধ্যে করোনা প্রচারণা সীমাবদ্ধ থাকায় গ্রামের মানুষ করোনাকে পাত্তা দিচ্ছে না।

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা বেড়ে যাওয়ায় সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। অতপর দফায় দফায় সেই মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় মানুষ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। এতে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার মানুষ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সিলগালা করে দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নামে। বাধ্য হয়েই বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সীমান্ত কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়। সেই তেঁতুলিয়ার সাংবাদিক আবু তাহের আনছারী জানান, সীমান্ত এলাকায় মাঝেমধ্যে করোনা নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকে প্রচারণা হয়। কিন্তু মানুষকে সহায়তা কখনো করা হয়নি; মানুষ সতর্ক হয়নি। ফলে হাটবাজারে মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করার দৃশ্য চোখে পড়ে না। মানুষ হাটবাজারে গাদাগাদি করে কেনাকাটা চলাফেরা করছেন।

নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার মাদরাসা শিক্ষক হজরত আলীর ছেলে স্থানীয় সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম বলেন, নওগাঁয় সীমান্ত থাকায় করোনার হটস্পট হয়ে গেছে। অথচ মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। বাজারে মাস্ক ছাড়াই মানুষ নির্বিঘেœ ঘোরাঘুরি করছেন; করোনা নিয়ে কারো ভ্রæক্ষেপ নেই। সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে যারা আসছেন তারা সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। কোয়ারেন্টিন এখানে কেউ শোনেনি। রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার পদ্মার নদীর তীরে সীমান্ত গ্রাম হিসেবে পরিচিত মাঝেরদিয়া গ্রামের মো. আবদুল হাদি বলেন, ঘরে ঘরে জ্বরসর্দি। চরে কোনো ডাক্তার নেই। বাইরে থেকে মানুষ আসছে চরে, কেউ বাধা দিচ্ছে না। কারো মুখে মাস্ক নেই। কেউ কেউ মনে করেন, করোনা বড়লোকদের অসুখ, গরিবকে ধরবে না। এই এলাকার মাহাদী স্কুলপাড়া গ্রামের মো. আবদুস সালাম বলেন, আমার বাড়ির ৮ জনের মধ্যে ৬ জনের সর্দিজ্বর হয়েছে। তারা নাপা ওষুধ খাচ্ছেন। আগে দুজনের সর্দিজ্বর হয়েছিল। তিনি বলেন, টেলিভিশনে দেখি ঢাকার মানুষ মাস্ক পড়ে না; আমাদের দরকার কি?

সীমান্ত জেলাগুলোর মধ্যে সবার আগে লকডাউন দেয়া হয় রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। সীমান্ত জেলায় করোনার পাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় লকডাউন দেয়া হয়। মহানন্দা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন নুরুদ্দিনের ছেলে মো. নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, করোনালকডাউনের মধ্যেও মহানন্দার খালঘাটে মাছ ধরেছি। মানুষের যাতায়াত বন্ধ (লকডাউন) করে দিয়েছে সরকার; তারপরও মানুষ চলাফেরা করেছে, সীমান্ত দিয়ে লোক এসেছে। সীমান্ত দিয়ে মানুষের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হলে সমস্যার সমাধান হতো। সাধারণ মানুষ খেতে পারেন না তারা করোনার জন্য ঘরে বসে থাকবেন- এটা ভাবা যায় না।

 



 

Show all comments
  • Shamir Hossain ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩২ এএম says : 0
    আমাদের বাঁচান। আমরা খুলনার মানুষ। এখানে প্রতিনিয়ত সংক্রমন বেড়েই চলেছে। এমনকি গ্রাম অঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
    Total Reply(1) Reply
    • ২৬ জুন, ২০২১, ১০:৪১ এএম says : 0
  • মু, সায়েম আহমাদ ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩২ এএম says : 0
    আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। কারণ সচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। কাজেই সচেতন হোন সময় থাকতেই। নয়তো পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Morshed Ahmed ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩২ এএম says : 0
    তার মানে এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পরাটা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার, আল্লাহ সবার হেফাজত করুন
    Total Reply(0) Reply
  • Amir Hamza ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৩ এএম says : 0
    আল্লাহ সবার উপর রহম করুন, কাকে কি বলবো বুঝতে পারছি না, """"""""আমি চিৎকার করে কাদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার, বুকের ব্যাথা বুকেতে চাপায়ে নিজকে দিচ্ছি ধিক্কার,"""""" ভারতে করানার খবর দেখার পরেও আমরা আমাদের দেশের জন্যে কি ব্যবস্থা নিয়েছিলাম, এর দায় কে নেবে, """""যার চলে যায় সেই বোঝে ভাই """ কেন প্রশাসন দেশে ২৭ রমজান থেকে অন্তত ১ মাস কঠোর lock down দিলনা, যে বা যারা ঈদ করতে গ্রামে গিয়েছিলেন এই মহামারীর দায় একটু হইলেও আপনাদের, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন সাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথা যথ ব্যাবস্থা নিলোনা, সাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করেছি, দেশের মানুষকে জিম্মি করে যে সম্পদ বানাচ্ছেন, তার হিসাব কি কেয়ামতের দিন দিতে পারবেন। আপনাদের দুর্নীতি ও অযোগ্যতার জন্যে এতো গুলো পরিবার আজ প্রায় ধ্বংশ, এর ফল ইন-শা-আল্লাহ্ আপনারা পাবেন,
    Total Reply(0) Reply
  • Solaiman Ali ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৪ এএম says : 0
    সনাক্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, এটাকে খারাপ চোখে দেখলে খারাপ, ভালো চোখে দেখলে ভালো। ভালো এ অর্থে, মানুষ দ্রুত ন্যাচারেলি ইনফেকটেড হয়ে শরীরে এন্টিবডি তৈরী করছে। করোনাও দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে। বস্তি এলাকাগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে ইনফেকটেড হয়ে ৭১% লোক শরীরে এন্টিবডি তৈরী করে ফেলেছে। ফলে তারা হার্ড ইম্যুনিটিতে পৌছে গেছে। ঢাকার বস্তিতে করোনা শেষ। তাদের টিকারও দরকার নাই। বস্তির মত অনেক এলাকায় এন্টিবডি টেস্ট করলে একই প্রমাণ পাওয়া যাবে নিশ্চিত। দেখা যাবে, অধিকাংশ এলাকায় ৫০% শতাংশ লোক ইতিমধ্যে এন্টিবডি তৈরী করে ফেলেছে। ৬০-৭০% হতে, মানে হার্ড ইম্যুনিটি হতে বেশি দেরি নাই। তাই সনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই খারাপ কিছু না। বরং করোনা শেষ হওয়ার লক্ষণ।
    Total Reply(0) Reply
  • Afrina Akter ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৪ এএম says : 0
    সংক্রমণ খুলনায় এত বেশী হওয়ার কারন পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে অনেক দেরিতে আর ঢিলেঢালা সীমান্ত বন্ধ। প্রত্যেক সীমান্তবর্তী জেলার এক অবস্থা। আর সেখান থেকে পুরো দেশে ছড়ায় পড়েছে স্বাভাবিক ভাবেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Sakib Sarkar ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৫ এএম says : 0
    কি বলবো আমাদের দেশের লোকদের আটকানো বড় কঠিন কাজ,একচেটিয়ে মানুষকে দোষ দিলে হবে না,শিক্ষার হার বাড়লেও সচেতনতা,স্মার্ট এসব বাড়ে নাই,সেইসাথে যারা দেশ চালায় তারা হয়ে গেছে অধিক সচেতন আর অন্যরা অধিক অসচেতন।আবার অন্য দিকে দিন আনে দিন খায় লোকদের পেটের কথাতো চিন্তা করা লাগে
    Total Reply(0) Reply
  • Md Dadon ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৫ এএম says : 0
    আমাদের দেশে আল্লাহর রহমত আছে। করোনায় বাংলাদেশে ভারতের মতো অবস্থা হবে না। ইনশাআল্লাহ
    Total Reply(0) Reply
  • Md Yamin Ahmed ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৬ এএম says : 0
    খুলনা অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে খোঁজ নিলেই পাবেন এক দুই জন জ্বরে আক্রান্ত
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shahab ২৬ জুন, ২০২১, ১২:৩৭ এএম says : 0
    আল্লাহ্ আপ‌নি আমাদের সবাই‌কে রক্ষা করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • Meer Md. Shamsuddoha ২৬ জুন, ২০২১, ৭:৪১ এএম says : 0
    প্রবাসে স্বাভাবিক সময়েই মাস্ক ব্যবহারে অভস্ত্যতা থাকায় দেশে এসেও মাস্ক পরলে নানান জনে নানান কথা বলত । কিন্তু পরবর্তীতে করোনার উপদ্রবে অনেকেই বাধ্য হয়েই পরছে আবার একেবারেই পরে না ।
    Total Reply(0) Reply
  • Dadhack ২৬ জুন, ২০২১, ১২:২৪ পিএম says : 0
    বাংলাদেশের মুসলমানরা গোপন পাপ সূত্রপাত ছেড়ে দিন তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন আল্লাহ যেন আমাদেরকে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা করেন আমিন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাস্ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ