দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য মহান রবের অনন্য কৌশলের একটি মানুষদের মধ্যে অসমতা। এখানে সর্বাগ্রে স্থান পায় অর্থ বিত্তের পার্থক্য। এই পার্থক্য দ্বারা মহান রব মানুষ মানুষের প্রতি দয়া মায়া, মানবতা, মনুষ্যত্ববোধ খুব সহজেই যাচাই করে নেন। এক অপরের প্রতি নির্ভরতা, মুখাপেক্ষিতা দ্বারা মানুষের মধ্যে মায়া মমতা, শ্রদ্ধা, ভালবাসার এক ভীত রচনা করেন। এ দিয়ে মানুষের মধ্যে কে ভাল, আল্লাহর সৃষ্টির জন্য উপকারী, কে ক্ষতিকর তাও জেনে নেন। আবার কে স্বার্থ হাসিলের জন্য মুখোশ পড়ে চলে এরও যাচাই হয়ে যায়। অসহায়দের উপকারে যে নিস্বার্থ ভাবে কাজ করেন, তাকে পৃথিবীর সকলেই ভালবাসে। স্বার্থবাদীরা সামনে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও পিছনে ভাল বলেই তার বিবেক তাঁড়া করে। আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সারা জাহানের জন্য দয়া, অনুগ্রহ হিসেবে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীর কেউ যেমন জ্ঞানে তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি, পারবেনা। দয়া, মায়া, ভালবাসায় তাঁকে ডিঙ্গানোর স্বপ্নেও কেউ ভাবার সাহস করতে পারেনি, পারবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম জীবনে খুব ধনী ছিলেন না। কিন্তু তখনকার আমলে মক্কার সবচেয়ে ধনী, আম্মা খাদিজাতুত তাহিরা রাঃ কে বিয়ে করার পর আম্মা খাদিজাতুত তাহিরা রাঃ নিজের সবকিছু রাসুললুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে সপে দিলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়ে গেলেন তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় ধনী। এতো অর্থ সম্পদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী করলেন ? আমাদের মনের অন্দরে কি এই প্রশ্ন কখনো জাগ্রত হয় না? এরূপ নয় যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাম আয়েশ আর বিলাসিতা করে সব উড়িয়ে দিয়েছেন। এমন নয় যে তিনি সম্পদের অপচয় আর অপব্যবহার করে সম্পদ শেষ করে দিয়েছেন। তাঁর সব চিন্তা, অর্থ ব্যয় শুধু মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। যে ব্যক্তি অসহায়দের সাহায্য সহযোগিতা করেন, কোন বিনিময় চান না, কোন প্রশংসা পাওয়ার আশা লালন করেন না। লোক দেখানোর কোন তারনা মনের মধ্যে স্থান পায় না। প্রচার প্রচারনার জন্য আশাম্বিত থাকেন না। এমন একজন সর্বসেরা মানুষ ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
এবার দেখি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অসহায়দের প্রতি ভালবাসার চিত্র। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি দোয়াই এই বিষয়টি বুঝার জন্য যথেষ্ট। আবু সাইদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা গরীব, মিসকিনদেরকে ভালবাস, কেননা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি তিনি তাঁর দোয়ায় বলতেন, হে আল্লাহ তুমি আমাকে মিসকিন করে জীবিত রাখ, তুমি আমাকে মিসকিন করে মৃত্যু দাও এবং মিসকিনদের সাথে আমাকে হাশরের ময়দানে সমবেত কর। ইবনে মাজাহ।
একবার ভেবে দেখি এর চেয়ে অসহায়দের প্রতি ভালবাসার আর কি কোন শব্দ, ভালবাসা প্রকাশ করার আর কি কোন উত্তম পথ আছে? অসহায়দের প্রতি হৃদয়ের টান, মহব্বত না থাকলে এরকম শব্দ কি মুখ দিয়ে বের হতে পারে? তাবত দুনিয়ায় এমন কেউ কি আছেন, যিনি মহান রবের নিকট গরীব থাকার জন্য আকুতি জানিয়েছেন। হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে গরীবদের প্রতি ভালবাসা, সাহায্য-সহযোগিতা এমন নজির পুরো পৃথিবীতে একটিও নেই। আরো কত আশ্চর্য হতে হয়। পৃথিবীর সবায় সম্পদকে কম বেশী ভালবাসে। ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনিদের জন্য সম্পদ জমানোর চেষ্টা করে। নিজের থেকেও ছেলে মেয়েদের জন্য কি রেখে যেতে পারলাম এই নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। অথচ নবী আলাইহিস সালাম কত সুন্দর করে বলেছেন, নবীর যাবতীয় সম্পদ তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের খরচ বাদে বাকি সবই সাদাকা। আমাদের (নবীগনের) সম্পদের কোন ওয়ারিশ থাকে না। সহিহ বুখারী। অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরে ভরণপোষনের জন্য যতটুকু সম্পদ দরকার ঠিক ততটুকু থাকবে। অতিরিক্ত সব সম্পদ অসহায় গরীবদের। সুবহানাল্লাহ। যে যত বেশি পরোপকারী, যার অন্তরে যত বেশি গরিবের প্রতি ভালবাসা ও দয়া লালন করে তার অন্তর তত কোমল, সে তত ভাল ব্যক্তি। তার অন্তরে কঠোরতা থাকে না, হিংসা, অহংকার তার হৃদয়ে দানা বাঁধতে পারে না। আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে তার হৃদয়ের কঠোরতার অভিযোগ করল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি এতিমদের মাথায় তোমার হাত রাখ আর মিসকিনদের খাবার দাও।আহমাদ। একটু চিন্তা করুন কী সুন্দর হৃদয়ের কঠোরতা দূর করার দাওয়াই। এই রোগ থেকে বাঁচার কত সুন্দর চিকিৎসা ব্যবস্থা। কী সুন্দর প্রেসকিপশন। কোন ব্যক্তি যত বড় বিত্তশালী হোক না কেন, তার অন্তরে যদি গরীবদের প্রতি ভালবাসা, দরদ, মায়া-মমতা থাকে তার অন্তরে কিভাবে হিংসা, অহংকার আর বড়ত্বের ভাব থাকবে।
একদিন এক সাহাবী এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের মধ্যে কোন কাজটি উত্তম? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন অপরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া। বোখারী। অসহায়দের, বিপদগ্রস্থদের সাহয্যের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিসগুলোর দিকে তাকালে কার হৃদয়ে নাড়া দেয় না। কোন পাষান দিলও কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই হাদিসগুলো পাঠ করলে সাহায্যেও হাত না বাড়িয়ে পারে! হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে চেষ্টা করবে, তা তার জন্য দশ বছর ইতেকাফ করার চেয়েও উত্তম। আর যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইতেকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের মাঝখানে এমন তিনটি খন্দক করে দেবেন যার দূরত্ব হবে পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের ন্যায়। আততারগীব ওয়াত তাহরীব। অসহায়দের সহায়তা করার, অন্যের উপকার করার কত বড় মর্তবা! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় সাহাবা রাঃ গনকে দরিদ্র লোকদের সাহায্য করার উৎসাহ দিতেন। আসহাবে সুফফায় অবস্থানরত সাহাবাগন দরিদ্র ছিলেন। একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার কাছে দুই জনের খাবার আছে সে যেন তিন জন নিয়ে যায়, আর যার কাছে চারজনের খাবার আছে সে যেন পাঁচ জন কি ছয় জন নিয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ জন সাথে নিয়ে আসেন আর আবু বকর রাঃ তিন জন সাথে নিয়ে আসেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো চেহারায় অভাবের ছাপ দেখলে চেহারা মলিন দেখলে ব্যথিত হতেন। জাবির রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে বসা ছিলাম, এমতাবস্থায় কিছু লোক নগ্ন প্রায় দেহ, নগ্ন পদে ডোরাকাটা চাদর জড়িয়ে কিংবা জীর্ণ আলখাল্লা পরে, কাঁধে তলোয়ার ঝুলিয়ে আমাদের কাছে এল। তারা মোদার গোত্রের লোক ছিল। তাদের চেহারা ছুরতে ক্ষুধা ও অনাহারের ছাপ ছিল। এ অবস্থা দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়ির ভেতর গেলেন এবং বের হয়ে এসে বিলাল রাঃ কে আজান দিতে বললেন। বিলাল রাঃ আজান দিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামাতে নামাজ শেষ করে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে ভাষন দিলেন সুরা নিসার ১ নং আয়াত ও সুরা হাশরের ১৮ আয়াত পাঠ করলেন। সর্ব শেষ তিনি বললেন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ দিনার, দিরহাম, কাপড়, এক সা গম, এক সা খেজুর হতেও দান করো। বলতে বলতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতটুকু পর্যন্ত বললেন, এক টুকরো খেজুর থাকলেও তা থেকে দান করো। তখন একজন আনসারী সাহাবী একটি থলি নিয়ে আসলেন। এই থলিটি এত ওজন ছিল যে, সাহাবী বহন করতে কষ্ট হচ্ছিল। অতঃপর অন্য সাহাবীগনও তার অনুসরণ করল। সেখানে কাপড় ও খাদ্যের স্তুপ জমে গেল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেহারা মুবারক উজ্জ্বল এবং তাঁকে প্রফুল্ল দেখতে পেলাম। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।