দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মুফতি মোহাম্মদ তাহির মাসউদ
আহলে বাইত বলতে স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতিকে বুঝায়। রাসূল (সা.)-এর পবিত্র সহধর্মিণীগণ, তিন পুত্র, চার কন্যা ও কন্যার বংশধরকে তাঁর আহলে বাইত বলে। (তাফসিরে হাশিয়ায়ে শাইখ যাদাহ-৬/৬৩৫)
পবিত্র সহধর্মিণীগণের সংখ্যা ১১ জন, যাদের মধ্যে দুজন রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেছেন। এক. হযরত খাদিজা, দুই. হযরত যয়নাব বিনতে খুযাইমাহ (রা.)। নয়জন স্ত্রী রাসূলের ইন্তেকালের সময় জীবিত ছিলেন। নিচে ক্রমধারামত তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হলোÑ
হযরত খাদিজা (রা.)
হযরত সাওদা (রা.)
হযরত আয়েশা (রা.)
হযরত হাফসা (রা.)
হযরত যয়নাব বিনতে খুযাইমাহ (রা.)
হযরত উম্মে সালমা (রা.)
হযরত যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.)
হযরত জুয়াইরিয়্যাহ (রা.)
হযরত উম্মে হাবিবাহ (রা.)
হযরত সাফিয়্যাহ (রা.)
হযরত মাইমুনাহ (রা.)
এ ছাড়া রাসূল (সা.)-এর তিনজন দাসী ছিলেনÑ (১) হযরত মারিয়া (রা.) (২) হযরত রাইহানা (রা.) (৩) নাফিসাহ (রা.)।
হযরত রাসূল (সা.)-এর তিনজন সাহেবজাদার নাম হলোÑ (১) হযরত কাসিম (রা.) (২) আবদুল্লাহ (রা.) যাকে তায়্যিব, তাহিরও বলা হয়। কারো কারো মতে তারা ছিলেন পৃথক সন্তান। (৩) হযরত ইবরাহীম (রা.)। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যাগণের নাম হলোÑ (১) হযরত যয়নাব (রা.) (২) হযরত রুকাইয়্যাহ (রা.) (৩) হযরত উম্মে কুলসুম (রা.) (৪) হযরত ফাতিমা (রা.)। সকল কন্যাই প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, বিবাহশাদি হয়েছিল। হযরত ফাহিমা (রা.) ব্যতীত তিন কন্যা তাঁর জীবদ্দশাতেই ইহলোক ত্যাগ করেন। ইবরাহিম (রা.) ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর সকল সন্তান আম্মাজান খাদিজার গর্ভজাত। একমাত্র ইবরাহিম (রা.) তার দাসী হযরত মারিয়া কিবতিয়ার (রা.) গর্ভে জন্মলাভ করেন। হযরত ফাতিমা (রা.) ছাড়া অন্য কোনো সন্তানের মাধ্যমে তার বংশধারা বিস্তার লাভ করেনি।
রাসূল (সা.) তনয়া ফাতিমা (রা.) ব্যতীত অন্য কোনো সন্তান হতে রাসূলের পরবর্তী বংশধারা নেই। রাসূল (সা.) এর বংশ একমাত্র ফাতিমা (রা.) হতেই বিস্তৃত হয়েছে। এর দুটি শাখা, একটি হাসান (রা.) হতে, অপরটি হুসাইন (রা.) হতে। (শরহু ফিকহে আকবার-১১০) (খ) তিনি তেইশের ঊর্ধ্বে বয়ঃসন্ধিকালে হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তার নবুওয়াতের কার্যক্রম শুরুর আগে কাসিম, রুকাইয়া, যয়নব ও উম্মে কুলসুমের জন্ম হয়। নবুওয়াতের দায়িত্ব শুরুর পর তায়্যিব, তাহির ও ফাতিমা জন্মলাভ করেন। (উসুলে কাফী-২৭৯, কিতাবুল হুজ্জাহ-বাবু মাওলিদীন নাবিয়্যি (সা.)। কোরআন হাদিসের সাহাবাকিরাম ও আহলে বাইতের ফজিলতে অগণিত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্য হতে কয়েকটি মাত্র এখানে উল্লেখ করা হলো।
আহলে বাইত (রা.)-এর কতিপয় ফজিলতÑ
মহানবী (সা.) তাঁর সহধর্মিণীগণকে বিশ্বের সকল নারী হতে উত্তম বলেছেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সর্বপ্রকার অপবিত্রতা হতে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন বলে নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহপাক নবী পতœীগণকে লক্ষ্য করে বলেনÑ হে নবী পতœীগণ! তোমরা অন্য মহিলাদের মতো সাধারণ মহিলা নও। হে নবী গৃহের সদস্যগণ! আল্লাহপাক তোমাদের থেকে অপবিত্রতা ও নোংরামি বিদুরিত করে রেখেছেন (আল আহযাব-৩২-৩৩)
আল্লাহপাক স্বয়ং নবী পতœীগণকে পবিত্র রমণী বলে সাব্যস্ত করেছেন। তাদের ওপর অভিযোগ আপত্তি উথাপনকারীগণকে দুনিয়া-আখিরাতে লা’নত ও কঠিন শাস্তির যোগ্য বলে নির্ধারণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
নিশ্চয়ই যেসব লোকেরা পূত-পবিত্রা, সরলা মুমিনা নারীগণের ওপর ভিত্তিহীন অপবাদ রটনা করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর অভিসম্পাতের পাত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। সেদিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত, তাদের পাসমূহ তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। সেদিন আল্লাহতায়ালা তাদের সঠিক ও উচিত বিনিময় দেবেন ও তারা অবগত হবে যে, আল্লাহতায়ালাই সত্য ও সুস্পষ্ট ব্যক্তকারী। চরিত্রহীনা রমণীগণ চরিত্রহীন পুরুষদের জন্য, চরিত্রহীন পুরুষগণ চরিত্রহীনা নারীদের জন্য যোগ্য, পবিত্রা রমণীগণ পবিত্র পুরুষদের আর পবিত্র পুরুষগণ পবিত্রা নারীদের জন্য। তারা ওদের (মুনাফিকদের) কথাবার্তা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র ও মুক্ত। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানের জীবিকা। (আননূর-২৩-২৬)
হুজুর (সা.) আহলে বাইতকে নূহ (্আ.)-এর কিস্তির সাথে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নূহের কিস্তিতে স্থান লাভ করেছে, সে মুক্তি পেয়েছে, আর যে তাতে আরোহণ করতে পারেনি সে ধ্বংস হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেনÑ রাসূল (সা.) বলেছেনÑ তোমরা আল্লাহর সাথে মহাব্বত রাখ। যেহেতু তিনি স্বীয় নিয়ামাত রাশি দিয়ে তোমাদের জীবন পরিচালনা ও খাদ্য সরবরাহ করে থাকেন। আল্লাহ মহাব্বতের খাতিরে আমাকে মহাব্বত কর আর আমার মহাব্বতের কারণেই আমার আহলে বাইতকে মহাব্বত কর। (জামি’তিরমিজি-২/৬৯৯)
অনুরূপভাবে যে আহলে বাইতকে ভালোবাসতে পেরেছে সে মুক্তি পেয়েছে, আর যে আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা পোষণ করেছে সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।
হযরত আবু যর (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছিÑ আমার আহলে বাইত নূহ (আ.)-এর কিস্তি সমতুল্য। যে তাতে আরোহণ করেছে সে মুক্তি পেয়েছে আর যে পেছনে পড়েছে সে ডুবে মরেছে। (মুস্তাদরাকে হাকিম-২/৩৩৪,-৪/১২৪৩)
মহানবী (সা.) কোরআন কারীম ও আহলে বাইত সম্পর্কে ইরশাদ করেছেনÑ আমি তোমাদের মাঝে দুটি অতি বৃহৎ বস্তু রেখে যাচ্ছি, প্রথম বস্তু আল্লাহর কিতাব, যাতে রয়েছে হেদায়েত ও নূর। দ্বিতীয় বস্তু আমার আহলে বাইত। আমি তোমাদেরকে আহলে বাইতের ব্যাপারে সতর্ক করে যাচ্ছি, তোমরা আহলে বাইতের হক ও অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। এ দুটিকে দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখবে।
ইয়াজিদ ইবনে হাইয়্যান বলেন, একদা আমি, হুসাইন বিন সাবুরাহ ও উমার বিন মুসলিম, জনাব যায়িদ বিন আরকামের খিদমতে গমন করলাম। আমরা উপবেশনের পর তিনি বললেন, একদা রাসূল (সা.) খুতবা দিবার উদ্দেশ্যে আমাদের মাঝে দ-ায়মান হলেনÑ তিনি বললেন, হে লোক সকল! আমি একজন মানুষ বই কিছু নই। অদূর ভবিষ্যতেই আমার নিকট রবের দূত (আজরাইল ফেরেস্তা) এসে পড়বেন, আমি তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাব। আমি তোমাদের মাঝে দুটি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি, তার প্রথমটি কিতাবুল্লাহ যাতে আছে হেদায়েত ও নূর। তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ কর, একে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর। তিনি কিতাবুল্লাহর ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা দান করলেন। অতঃপর বললেন, আরেকটি আমার আহলে বাইত। আমি তোমাদের স্মরণ করার নির্দেশ দিচ্ছি। আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর। (সহিহ মুসলিম-২/৩৭৯)
হুজুর (সা.) ইরশাদ করেছেনÑ কারো অন্তরে ঈমান প্রবেশ করবে না যতক্ষণ সে আল্লাহর রাসূলের খাতিরে আহলে বাইতের সাথে ভালোবাসা না রাখবে। একদা হযরত আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে রাগান্বিত অবস্থায় হাজির হলেন। বর্ণনাকারী বলেনÑ আমি তখন রাসূলের নিকট উপস্থিত ছিলাম। রাসূল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেনÑ তোমার ক্ষোভের কারণ কী? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ও কুরাইশদের মধ্যে কী হলো? তারা পরস্পরে মিলিত হলে হাশিখুশি নিয়ে মিলিত হয়, যখন আমাদের সাথে মিলিত হয় তখন সেভাবে মিলিত হয় না। রাসূল এ কথা শুনে রাগন্বিত হলেন। অতঃপর বললেনÑ যার হাতে আমার জীবন তার শপথ! কোনো ব্যক্তির অন্তরে ঈমান প্রবেশ করতে পারে না যতক্ষণ সে তোমাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের খাতিরে ভালো না বাসে। (তিরমিজি-২/৬৯৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আব্বাস (রা.) সম্পর্কে ফরমানÑ যে আমার চাচা আব্বাসকে কষ্ট দিল, সে আমাকে কষ্ট দিল। কেননা চাচা পিতৃতুল্য। আরো বললেনÑ আব্বাস (রা.) আমার, আমি (সা.) আব্বাসের (রা.)।
হুজুর আকরাম (সা.) ফাতিমাকে (রা.) জান্নাতী রমণীদের নেত্রী আখ্যা দিয়েছেন। আরো বলেছেনÑ ফাতিমা আমার দেহের অংশ। যে ফাতিমাকে অসন্তুষ্ট করল, সে আমাকে অসন্তুষ্ট করল।
(ক) নবী করিম (সা.) বলেছেনÑ হে লোক সকল! যে আমার চাচাকে ব্যথা দিল সে আমাকে ব্যথা দিল। কেননা চাচা পিতৃতুল্য। (তিরমিজি-২/৬৯৬) (খ) হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বলেনÑ রাসূল (সা.) বলেছেনÑ আব্বাস আমার অংশ, আমি তার অংশ। (তিরমিজি-২/৬৯৬) মেছওয়ার বিন মাখরামাহ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনÑ ফাতিমা আমার দেহের টুকরা, যে ব্যক্তি তাকে দুঃখ ব্যথা দিল সে আমাকে দুঃখ-ব্যথা দিল। (সহিহ বুখারি-১/৫৩২)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।