বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আল ফাতাহ মামুন
প্রতিবছরই ঈদুল আজহা এবং কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে পশুর চামড়া নিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যা চামড়া শিল্পের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। চামড়ার দাম নির্ধারণ ও কেনাবেচা নিয়ে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের ‘যেমন খুশি তেমন’ সিদ্ধান্তের বিষয়টিও নতুন নয়। অন্যান্য বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও কেনাবেচা নিয়ে এক ধরনের হরিলুটের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ঈদের আগে যে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, বাজার তার ধারে-কাছেও ছিল না। জানা গেছে, চামড়ার সরবরাহ বেশি থাকায় মাঠপর্যায়ে বেঁধে দেওয়া দামের প্রতিফলন ঘটেনি। এ পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত দর না পেয়ে অনেকেই স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণের চেষ্টা চালান। কিন্তু সেখানেও লবণ সংকটের কারণে সাফল্য আসেনি। লবণের উচ্চমূল্যের কারণে সংগৃহীত চামড়াও অনেকেই লোকসানে বিক্রি করে দিয়েছেন। হাতবদলের ফাঁকে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় চামড়ার গুণগত মানও নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণেও কম দাম নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। কিছু এলাকায় অবিক্রীত চামড়া মাটির নিচে পুঁতে ফেলা এবং নদীতে ফেলে দেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।
চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারদর কম বলে প্রতিবছরই খোঁড়া যুক্তি দেখানো হয়। একই যুক্তিতে এ বছরও গরু ও ছাগলের প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য স্মরণকালের সবচেয়ে কম নির্ধারণ করা হয়েছে। গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০ টাকা ধরা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে গরুর প্রতি বর্গফুট ফিনিশড চামড়ার মূল্য ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, যা প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ ৪০ শতাংশ বাদ দিয়ে দাঁড়ায় ৯৬ টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রতি বর্গফুট চামড়ার ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, ট্যানারি মালিকসহ চামড়া ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের যে দোহাই দিচ্ছেন, তা মোটেও সঠিক নয়। এভাবেই বড় ব্যবসায়ীরা দালাল-ফড়িয়াদের মাধ্যমে সস্তা দরে চামড়া কিনে মজুদ গড়ে তোলেন। পরে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দর ওঠে তখন ওই চামড়া ফিনিশড অথবা প্রক্রিয়াজাত করে বেশি দামে রপ্তানি করে নিজেদের পকেট ভারী করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। দাম নির্ধারণের পরও যখন বাজার বিপর্যস্ত এবং নির্ধারিত দামে চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে না তখন এই পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। চামড়া এ দেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প, ফলে চামড়া নিয়ে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রোধ করতে যৌক্তিক ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকেই।
কোরবানির মাংসের একটি অংশ যেমন গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে, তেমনি চামড়া বিক্রি থেকে পাওয়া পুরো অর্থই নিঃস্বদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। চামড়া ব্যবসার সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদে বছরের ৬০ শতাংশ চামড়া সংগৃহীত হয়। কোরবানিদাতারা চামড়া ও তার মূল্য মাদরাসা পড়–য়া এতিম, অসহায় ও গরিবদের দান করেন। এটা তাদের হক। অথচ প্রতিবছরই গরিব-মিসকিনদের এই হক বা পাওনা কেড়ে নেওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। অসত্য তথ্য, স্বেচ্ছাচারী আচরণ এবং কম দাম নির্ধারণ করে ট্যানারি মালিকরা তাদের ষোলআনা উসুল করার পরও আরো বেশি লাভ করে চলেছেন। তাদের এই লাভ আসছে অসহায় এতিম ও গরিবদের হক মেরে দেয়ার মধ্যদিয়ে, যা কোনোভাবেই মানবিকতার মধ্যে পড়ে না। সাধারণত কোরবানির চামড়ার মূল্য দিয়ে দেশের মাদরাসাগুলো বছরের ৫ থেকে ৬ মাস সার্বিক ব্যয় নির্বাহ করে। এ বছর ট্যানারি মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অবৈধ মুনাফা লুটের কারণে মাদরাসাগুলোর ব্যয় দেড় মাসও চালানো যাবে না বলে ধারণা করছেন মাদরাসা পরিচালকরা। ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক মাদরাসা কতৃপক্ষ বলেন, ‘ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের নৈতিকতার কতটা অবক্ষয় ঘটলে তারা এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করতে পারে। ট্যানারিওয়ালারা প্রতি বছরই নানা অজুহাতে দরিদ্রদের হক থেকে বড় অংশ খেয়ে ফেলছে। এভাবে গরিবের হক সবলের দখলে যাওয়া সভ্য সমাজে কাম্য নয়’। মাদরাসা কতৃপক্ষদের সঙ্গে একমত হয়ে বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘প্রতিবার চামড়া নিয়ে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, উপযুক্ত দাম পাওয়া যাবে না, এটা হতে পারে না। এজন্য চামড়া সংগ্রহের বিষয়টি সুষ্ঠু নিয়মনীতির আওতায় আনা জরুরি।’ বিষেশজ্ঞরা আরও বলেন, ‘চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া গেলে সমাজের এতিম, অসহায়, মসজিদ-মাদরাসা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দান-খয়রাত ও আর্থিক সহায়তা পাওয়া অনেকটা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি চামড়া নিয়ে যেন সিন্ডিকেট, জবরদস্তি বা অন্য কোনো অনিয়ম না চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ দেশি চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য এটি জরুরি। সরকার এবং চামড়া ব্যবসা ও চামড়াশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। আগামীতে এ ধরনের বিচ্যুতি যাতে না ঘটে, সে দিকে নজর রেখে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
য় লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধষভধঃধযসধসঁহ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।