Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নেচে-গেয়ে লাশ দাফনের পর এবার ভন্ডপীর শামীমের আরেক ভিডিও ভাইরাল

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ভণ্ডপীর শামীমকে গ্রামছাড়া করতে এলাকাবাসীর স্মারকলিপি

কুষ্টিয়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০২১, ৮:৪০ পিএম

কুষ্টিয়ার ফিলিপনগর উপজেলায় ঢোল-ঢগর বাজিয়ে নেচে-গেয়ে এক কিশোরের লাশ দাফনসহ ইসলামবিরোধী নানা অপকর্মের হোতা কথিত ভণ্ডপীর আব্দুর রহমান শামীম ওরফে শামীম রেজাকে গ্রামছাড়া করতে স্মারকলিপি দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।

রোববার (৩০ মে) দুপুরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের কাছে প্রায় ৭০০ মানুষের গণস্বাক্ষর সম্বলিত এই স্মারকলিপি দেয়া হয়। জেলা প্রশাসকের পক্ষে স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক মৃনাল কান্তি দে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। পরে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম ও দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তারের কাছে স্মারকলিপির অনুলিপি দেয়া হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন- ফিলিপনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল হক কবিরাজ, দৌলতপুর উপজেলা যুবলীগের ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম কবিরাজ, পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. ওমর ফারুক উপস্থিত ছিলেন।

স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ফিলিপনগর ইউনিয়নের পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের মৃত জেছের মাস্টারের ছেলে শামীম রেজা এলাকার বেশ কিছু সংখ্যক মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে আসছেন। যার জ্বলন্ত বহিঃপ্রকাশ গত ১৬ মে রাতে পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের মহাসিন আলীর ছেলে আঁখির (১৭) মরদেহ ভণ্ড শামীম ও তার অনুসারীরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নেচে গেয়ে দাফন করেন।

এছাড়া তারা ধর্মবিরোধী বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ করে আসছে। তার এসব কর্মকাণ্ডে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় ভণ্ড শামীমকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জোর দাবি জানান এলাকাবাসী।

স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ্, ইউপি চেয়ারম্যানসহ এলাকার সাধারণ মানুষ অবিলম্বে এসব ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধের পাশাপাশি ভণ্ড শামীমের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
ঢোল-টগর বাজিয়ে নেচে-গেয়ে অনুসারীদের নিয়ে এক কিশোরের লাশ দাফনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে এবার কথিত ভণ্ডপীর শামীমের আরেকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ভণ্ড শামীম আয়েশি ভঙ্গিতে ফুলের মালা গলায় দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে রেখে নারী-পুরুষরা নেচে-গেয়ে ‘হরে হরে, হরে হরে, হরে শামীম, হরে শামীম’ বলে সবাই চিৎকার করছেন। শামীম একটি বড় গামলায় দুই পা দিয়ে রেখেছেন। আর ভক্তরা দুধ দিয়ে তার পা ধুয়ে দিচ্ছেন, কেউবা চুমু খাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার হামাগুড়ি দিয়ে পায়ে মাথা ঠুকে তাকে সিজদা করছেন।

মোবাইল ফোনে ধারণকৃত দুই মিনিট এক সেকেন্ডের এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে আবারও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। বইছে সমালোচনার ঝড়। এতে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যানসহ এলাকার সাধারণ মানুষ অবিলম্বে এসব ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধের পাশাপাশি ভণ্ড শামীমের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

এর আগে গত ১৬ মে রাতে পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের মহাসিন আলীর কিশোর ছেলে আঁখি (১৭) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। মহাসিন আলী ওই গ্রামের কথিত ভণ্ডপীর শামীমের অনুসারী হওয়ায় ছেলের মরদেহ তার হাতে তুলে দেন। ওইদিন রাতে শামীম তার অনুসারীদের নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নেচে-গেয়ে আঁখির মরদেহ দাফন করেন। স্থানীয় মুসল্লিরা এর তীব্র বিরোধিতা করলেও শামীম ও তার অনুসারীরা কর্ণপাত না করেই তাদের রীতি মেনে মরদেহ দাফন করেন। নেচে-গেয়ে মরদেহ দাফনের ওই ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিলে তা ভাইরাল হয়।

কে এই শামীম?
শামীমের পুরো নাম মো. শামীম রেজা। তার বাবা মৃত জেসের মাস্টার ছিলেন স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তার বড় ভাই শান্টুও স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন।

শামীম পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৪ সালে ফিলিপনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। কুমারখালী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ভেড়ামারা কলেজ থেকে বি কম পাস করে পরবর্তীতে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এম কম পাস করেন।

পড়ালেখা শেষ করে ঢাকার জিনজিরা এলাকায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন শামীম রেজা। পরবর্তীতে ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলাম-এ-বাবা কালান্দার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরীর মুরিদ হন এবং খাদেম হিসেবে সেখানে বসবাস শুরু করেন।

কথিত পীর গোলাম-এ-বাবা কালান্দার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরীর মুরিদ হওয়ার পর থেকে শামীম পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজাখুজি করেও শামীমের সন্ধান লাভে ব্যর্থ হন।

২০০৭ সালে শামীম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সে বিয়ে দুই-তিন মাসের বেশি টেকেনি। প্রায় বছর দুয়েক আগেই হঠাৎ করেই শামীম নিজ গ্রাম ইসলামপুর ফিরে আসেন এবং তার বাড়িতেই আস্তানা গড়ে তোলেন। যে শামীম এক সময় জিন্সের প্যান্ট-গেঞ্জি পড়ে ঘুরে বেড়াতেন, এলাকায় ফিরে আসার পর দেখা যায় শামীমের মুখে লম্বা দাঁড়ি। গেরুয়া-পাঞ্জাবি পরা। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া প্রায় দুই বিঘা জায়গা নিয়ে শামীম বসবাস শুরু করেন। সেখানেই তার আস্তানা।

স্থানীয়রা জানান, শামীম এবং তার অনুসারীরা পুরোপুরি নাস্তিক। তারা ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ, নবী-রসুল কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করে না।

শামীমের আস্তানায় দিনরাত সব সময় কমবেশি লোকজন আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। ফকির-সাধু ভেবে এলাকাবাসী এতোদিন তাকে গুরুত্ব দিতো না। কিন্তু দিন দিন শামীমের আস্তানায় তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, শিশু থেকে সব বয়সী মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে।

প্রায় রাতেই আস্তানায় ঢোল-ডগর বাজিয়ে অশ্লীল নাচ-গানের আসর বসতে দেখা যায়। গান-বাজনার পাশাপাশি চলে গাঁজা-ইয়াবা সেবনের আসর।

বছরে দু-একবার শামীমের আস্তানায় ওরশ বসে। তার শত শত ভক্ত-অনুসারীরা এখানে ভিড় জমান। অনেকটা হিন্দুরীতিতে নেচে-গেয়ে তারা শামীমের নাম যপ করতে থাকেন।

এলাকাবাসী জানান, শামীমের ভক্ত-অনুসারীদের বেশিরভাগই অল্প বয়সী তরুণ-তরুণী। শামীম নিজে এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অনুসারী অশিক্ষিত এবং অল্প শিক্ষিত মানুষজনকে মগজ ধোলাই করে শিষ্যত্ব লাভে বাধ্য করেন। প্রায় দুই বছর ধরে তার আস্তানায় নাচ-গানসহ অশ্লীল এবং ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড চললেও মূলত গত ১৬ মার্চ আাঁখি নামের এক কিশোরের লাশ ঢোল-তবলা বাজিয়ে নেচে-গেয়ে দাফন করার পর থেকে শামীম সবার আলোচনায় চলে আসেন।

ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকাবাসী
নেচে-গেয়ে ঢোল-ডগর বাজিয়ে লাশ দাফন করা থেকে শুরু করে একের পর এক ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ইসলামপুর গ্রামের মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শামীমের একের পর এক ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় এ নিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

দৌলতপুর উপজেলা যুবলীগের ১নং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম কবিরাজ বলেন, ‘নেচে-গেয়ে ঢোল-ডগর বাজিয়ে লাশ দাফন করার পরের দিন আমরা স্থানীয় মসজিদের ইমামসহ এলাকাবাসী ইউএনও এবং ওসির কাছে গিয়েছিলাম। তারা আমাদের আইন হাতে তুলে না নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি মোকাবিলা করার কথা জানিয়েছেন।’

ফিলিপনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফজলুল হক কবিরাজ বলেন, ‘শামীম একজন ভণ্ড। ইসলামের নাম নিয়ে সে যেসব অপকর্ম করছে একজন মুমলমান হিসেবে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’

ভণ্ডপীর শামীম প্রসঙ্গে কথা হয় কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম সারোয়ার জাহান বাদশার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শামীম আর আমার ওয়ার্ড একই ৬নং ওয়ার্ডের। আমরা একই গ্রামের মানুষ। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় শামীম নিখোঁজ ছিল। ইসলামের নামে সে আস্তানা বানিয়ে যা করছে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’



 

Show all comments
  • শওকত আকবর ৩১ মে, ২০২১, ৮:৩৩ এএম says : 0
    এই ভন্ডপীরের উচিৎ শিখ্খা দিন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ