পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের আঘাতে রীতিমতো ‘চিড়েচ্যাপ্টা’ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এ শ্রেণির বিপুল সংখ্যক মানুষের আয় কমেছে; অথচ পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়ে গেছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে উঠে আসা তথ্যমতে, করোনার এই ১৪ মাসে আয় কমেছে দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি কর্মজীবী মানুষের। বিনিয়োগ কমেছে, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছেন রাজধানীতে চাকরি, ব্যবসাসহ নানা পেশায় জীবিকা নির্বাহ করা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই শ্রেণির অনেকেই করোনাকালে চাকরিচ্যুত হয়েছেন; কারো কারো কমিয়ে দেয়া হয়েছে বেতন। অন্যান্য উৎস থেকেও কমে গেছে আয়। অথচ সংসার চালানোর নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে গেছে। সামাজিক অবস্থান ধরে রেখে সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই কেউ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন; কেউ সংসারের খরচ কমিয়ে দিয়েছেন। সংসার চালানোর অর্থের যোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শত শত পরিবার রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
করোনায় ‘লকডাউন’ বা ‘সীমিত পরিসরে সবকিছু বন্ধ’ কার্যক্রমে নিম্ন আয়ের লোকজন সরকার ও বিত্তবানদের কাছ থেকে নানা ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছেন। শহরে রিকশা-সিএনজি চালানো এবং গ্রামে তারা নানাভাবে কাজকর্ম করেছেন। কিন্তু সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় বাস্তবতার কারণে মধ্যবিত্তের পক্ষে ‘হাত পেতে সাহায্য নেয়া’ যেমন সম্ভব নয়; তেমনি তাদের সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে কার্যকর কোনো পক্ষই (সরকার ও বিত্তবান) এগিয়ে আসেনি। মধ্যবিত্তরা ত্রাণ নেয়া দূরের কথা কোথাও সাহায্যের জন্য নাম লেখাননি। এর মধ্যে বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। শুধু সয়াবিন তেলের দাম গত এক বছরে ৭ দফায় কেজিতে বেড়েছে ৬৫ টাকা। চাল, ডাল, তরিতরকারিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি প্রায় একই গতিতে চলছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত যে সব পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়ে চাকরির প্রত্যাশায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; তারাও হতাশ। দীর্ঘদিন থেকে সরকারি নিয়োগ বন্ধ। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই চাকরি প্রার্থীদের বড় অংশ লেখাপড়া শেষ করে টিউশনি করে চলতেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সে আয়ের পথও বন্ধ। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম আর্থিক দূরাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ সঞ্চয় করা পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন; কেউ কেউ সংসারের খরচ ও খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। সেটাও না পেরে বাধ্য হয়েই তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ রাজধানী ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। করোনায় ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় রাজধানীর বহু বাড়ি, ফ্ল্যাট খালি হয়ে গেছে। এতে মহানগরীর বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিকরাও বিপাকে পড়েছেন। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মধ্যবিত্ত খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তাদের আয় বাণিজ্য বন্ধ। অনেকে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় করোনা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মধ্যবিত্তদের টিকে থাকার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নগদ সহায়তা দেয়া যেতে পারে।
করোনাকালে মধ্যবিত্তের দুর্বিসহ জীবন চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ। আয় কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের। করোনার এক বছরের মধ্যে ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। তিন শতাংশের চাকরি থাকলেও বেতন পান না। এদের বড় অংশই মধ্যবিত্ত। এদিকে প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) বলছে, এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ইতোমধ্যে ৬ থেকে ৭ লাখ প্রবাসী করোনায় কাজ হারিয়েছেন। কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন আরো কয়েক লাখ প্রবাসী শ্রমিক। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্বে ৩৩ কোটি মানুষের আয় কমেছে। এটি বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বেশি প্রভাব পড়ছে। প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশকে মধ্যবিত্ত পরিবারের ধরা হয়।
করোনাকালে মধ্যবিত্তের দূরবস্থার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনীয়। বহু মানুষের আয় বন্ধ হয়েছে, কারো কমেছে। এ অবস্থা উত্তরণে খুব বেশি কিছু করার নেই। আপাতত এদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। এজন্যই এই কর্মসূচির মাধ্যমেই কাজ হারানো মানুষকে সাপোর্ট দিতে হবে।
’৫২ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১ মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০ এর গণঅভ্যুত্থানসহ সবকিছুতেই মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ বেশি। দেশের রাজনীতি, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে মধ্যবিত্তদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, দেশে তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে মধ্যবিত্তদের মাসিক আয় ২৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে। যে কোনোভাবে আয় করে যারা এ ধরণের একটি সামাজিক মর্যাদা তৈরি করেছেন, তারাই মধ্যবিত্ত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতা (পিপিপি) যদি প্রতিদিন দুই মার্কিন ডলার থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে হয় তবে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই হিসেবে তারা বলছে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হলো ৩ কোটি ৭ লাখ। বিশ্বব্যাংকের মধ্যবিত্তের আয়ের হিসেবটি একটু বেশি। যাদের প্রতিদিন আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার, তারা মধ্যবিত্ত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই থেকে চার ডলার প্রতিদিনের আয় হলেই মধ্যবিত্ত। সেই হিসেবে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা সেই মধ্যবিত্ত। এটি বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসেবে সংখ্যাটি দাঁড়ায় চার কোটি ৮০ লাখ। তবে ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোরশেদ বলেন, দিনে ১.৯ ডলারের দ্বিগুণ যাদের আয় তাদের আমরা বলি নিম্ন মধ্যবিত্ত। এরাই করোনাকালে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটের মুখে আছেন। তারাই হয়তো দরিদ্রের কাতারে নেমে গেছেন। কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত, তারা এখনো টিকে আছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান’র (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে; ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই জরিপে কিন্তু মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত স্পষ্ট ধরা দেয়।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে বিআইডিএস’র অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন দেশের ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে মধ্যবিত্ত। ২০১৫ সালে তিনি তার গবেষণায় বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের ৪৮.৪ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করেন। ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করেন। প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করেন। নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১.৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করেন। আর ব্যবসায় যুক্ত ১৭ শতাংশ। মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা জমির মালিক। টাকা পয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। ২৩.৪৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। করোনাকালে এই মধ্যবিত্ত চরম দুরবস্থায় পড়ে গেছে।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মধ্যবিত্তের কিছু সঞ্চয় থাকে। করোনাকালে ও লকডাউনে তারা সেই সঞ্চয় ভেঙে খান। এভাবে তাদের সেই সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে। তখন বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত এই পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্তে পরিণত হবেন। সবচেয়ে বড় সঙ্কট হবে যখন সবকিছু স্বাভাবিক হবে তখন তো বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারাবে। উন্নত দেশে তো বেকার ভাতা দেয়া হয়। এখানে সেই ব্যবস্থা নেই। এই মধ্যবিত্ত বেকার শ্রেণি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সরকারের যে প্রণোদনা সেখানেও কিছু মধ্যবিত্তের কোন অবস্থান নেই। আসলেই বাংলাদেশে মধ্যবিত্তরা ভয়াবহ সঙ্কটে আছেন।
উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। করোনার কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই। আবার কারও বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ও উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের আপাতত কোনো সঙ্কট হবে না। কিন্তু যারা বেসরকারি খাতে আছেন তারা এখন জমানো টাকা খাচ্ছেন। এটা শেষ হলে ঋণ করে অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা ঋণগ্রস্থ হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে যাবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।