Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কূটনৈতিক ব্যর্থতায় টিকা পাচ্ছে না বাংলাদেশ

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

মহামারি করোনা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন বা টিকা। তাই বিশ্বব্যাপি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন করোনার ভ্যাকসিন। করোনার নতুন ধরণ অন্যদিকে সব মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে সারাবিশ্বে চলছে ভ্যাকসিন কূটনীতি। আভিধানিক অর্থে এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করাই হলো ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’। যদিও এক্ষেত্রে পুরোপুরিই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ। ছয় মাসের মধ্যে তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশকে সরবরাহ করার কথা ছিল সিরাম ইনস্টিটিউটের। এ নিয়ে চুক্তি করে অগ্রিম টাকাও দেয়া হয়। ভারত নির্ভরতায় টিকার অন্যান্য উৎসকে গুরুত্ব দেয়নি বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞায় চুক্তি অনুযায়ী মাত্র ৭০ লাখ ডোজ টিকা পায় বাংলাদেশ। বাকী ২ কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক ব্যর্থতায় আটকে যায়। পাশাপাশি ভারত রফতানি বন্ধ করায় সঠিক সময়ে অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহে কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। আর তাই বাংলাদেশেকে এখন টিকা আমদানির জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। অথচ প্রতিদিনই বুলি আওড়াচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে টিকা নিয়ে কথা হচ্ছে, শিগগিরই টিকা পাচ্ছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব বুলির পরেও আজ পর্যন্ত অন্যান্য উৎস থেকে একটি টিকা ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বিকল্প কোনো উৎস থেকে কবে টিকা মিলবে তারও কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত, শুরুতে বিকল্প উৎস থেকেও টিকা নেয়ার চেষ্টা করা উচিত ছিলো বাংলাদেশের। তাদের মতে, ভারতের উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতায় টিকা নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। করোনা প্রতিরোধে তাই বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রুত কিভাবে টিকা পাওয়া যায় এ জন্য সম্ভাব্য সব উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ ও টিকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাপক অর্থে ভ্যাকসিন কূটনীতি বলতে শুধু অর্থায়নকে বুঝায় না, বরং ভ্যাকসিনের আবিষ্কার, কেনা-বেচা, সরবরাহের জন্য কৌশলগত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বিনিময় এই কূটনীতির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য কূটনীতির একটি শাখা হলো ভ্যাকসিন কূটনীতি, যার কারণে ‘দা-কুমড়ো সম্পর্কের’ রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র এক ঘাটে পানি খেয়েছিল।

ইউরোপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেন্ডের বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন পাওয়া না গেলে আগামী এক বছরে বিশ্ব অর্থনীতির জিডিপিতে করোনার প্রভাব হবে তিন দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলার। আর ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে পরিমাণ দাঁড়াবে এক দশমিক দুই ট্রিলিয়ন। একই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে না। সেটা টিকা ইস্যুতে হোক আর অন্য কোন ইস্যুতেই হোক। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতা দরকার। তারা বলেন, টিকা ইস্যুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে শুধু স্বাক্ষর ছাড়া সবকিছুই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। তাদের ভ্যাকসিন কূটনীতির উপরই নির্ভর করে চলতে হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।

ভ্যাকসিন কূটনীতি বিষয়ে একজন প্রসিদ্ধ গবেষক পিটার জে হটেজ। ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ জার্নালে ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ১৮০০ থেকে ১৮০৫ সালে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন, মেক্সিকো, ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভ্যাকসিন কূটনীতির প্রথম সফল প্রয়োগ হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যকার দফায় দফায় যুদ্ধ ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দিয়েছিল বৃটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেন্নারের পোলিও’র ভ্যাকসিন আবিষ্কার। ঘোর শত্রু দেশের জাতীয় ইনস্টিটিউটকে পাঠানো চিঠিতে এডওয়ার্ড বলেছিলেন, বিজ্ঞান কখনো যুদ্ধের জন্য নয়। সবশেষ ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কিছু রোগের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। আর করোনা টিকা তৈরির জন্য যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতে ভ্যাকসিন কূটনীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। হটেজ মনে করেন, ভ্যাকসিন হলো বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর হাতিয়ার। উদাহরণ হিসেবে চীনের সাম্প্রতিক ‘হেলথ সিল্ক রোড’ নীতির কথা বলা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন করোনা ভ্যাকসিনকে একদিকে তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধার, অন্যদিকে প্রভাবের বলয় বিস্তারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। ধনীদের ভ্যাকসিন অলীক স্বপ্ন মনে করে অনেক দেশই এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দক্ষতার সঙ্গে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।

এদিকে জরুরিভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের কাছে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে করোনাভাইরাসের টিকা সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছিল। গত শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন আইটিভি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, আমি খুব বেশি চাইছি না, তাদের কাছে মাত্র এক দশমিক ছয় মিলিয়ন অ্যাস্ট্রাজেনেকা ডোজ চাইছি। তাদের উচিত দ্রুত বাংলাদেশে এই ডোজগুলো দেয়া, যাতে মানুষ তাদের দ্বিতীয় ডোজটি নিতে পারে। যুক্তরাজ্য সরকারকে আরও আন্তরিক হওয়ার বার্তা দিয়ে ড. মোমেন বলেছেন, তাদের কমনওয়েলথ সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা করা উচিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের ভালো বন্ধু এবং যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অনেক বাংলাদেশি অবদান রাখছেন। তাই যুক্তরাজ্যের এগিয়ে আসা উচিত। আইটিভি নিউজকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ড. মোমেন বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পরিস্থিতিকে একটি ‘সঙ্কট’ হিসেবে বর্ণনা করে টিকা সংগ্রহের বিষয়ে বলেছেন, আমরা মরিয়া।

সূত্র মতে, সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আসা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকার মজুত এ সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হতে চলেছে। এরপর আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রদানের সুযোগ নেই। ফলে করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি হওয়া ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৮২৪ ডোজ পাওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে এখনো কোনো উৎস থেকে টিকা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এ পর্যন্ত ৯৭ লাখ ৯২ হাজারেরও বেশি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৯১২ জন। আর প্রথম ডোজ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছেন ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ২১৮ জন। এখন মজুত আছে মাত্র ৪ লাখের কিছু বেশি ডোজ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, আমাদের হাতে চার লাখ ডোজের কিছু বেশি টিকা আছে। এটা হয়তো এ সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাবে। আমরা ঘাটতি হওয়া অক্সফোর্ডের টিকা অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে এখনো কোনো দেশ নিশ্চিত করে আমাদের কিছু জানায়নি। তিনি বলেন, আগামী ২ জুন কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের টিকা আসার কথা রয়েছে। সেখান থেকে অন্তত ১ লাখ ৬ হাজার ডোজ টিকা আসবে বলে জানানো হয়েছে। সেগুলো দিয়ে আমরা ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ দেয়া শুরু করব। এই টিকা থেকে অর্ধেক দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার জন্য রেখে দেয়া হবে।

বাংলাদেশে প্রথম ধাপে এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। কিন্তু ভারতের উপর অধিক নির্ভরশীলতা ও অন্য উৎস থেকে টিকা আনার বিষয়টি গুরুত্ব না দেয়ায় এখন বিপাকে পড়েছে দেশ। অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নেয়া ১৪ লাখের বেশি মানুষের জন্য কি করা হবে হবে তা নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্য খাত।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, টিকা নিয়ে সারা বিশ্বেই একটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের প্রথম থেকেই একক কোনো সোর্সের ওপর নির্ভর করা ঠিক হয়নি। উচিত ছিলো চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশেই টিকা উৎপাদন করা। যে সুযোগ চীনের সঙ্গে ছিলো। কারণ চীনের ভ্যাকসিনটি এদেশে ট্রায়ালের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। দেশটির সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো।##



 

Show all comments
  • MD Kajal MD Kajal ২৩ মে, ২০২১, ১২:৫৭ এএম says : 0
    কুটনৈতিক চালবাজ এখনো পয়দা হয়নি সরকারের এখনো Axprat.কুটনৈতিক পয়দা হয়নি যাওবা আছে তাড়া নিজেদের আখের গোছাতে বেতি ব‍্যাচতো কুটনৈতিক কনো যগ‍্য মানুস কে নিন
    Total Reply(0) Reply
  • MD Azizul Islam ২৩ মে, ২০২১, ১২:৫৯ এএম says : 0
    লজ্জিত
    Total Reply(0) Reply
  • Jahangir Alam ২৩ মে, ২০২১, ১২:৫৯ এএম says : 0
    ভাই বিশ্বের বহুদেশ টিকাই পায় নাই সেটা ও কি বাংলাদেশের দোষ
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Talukder ২৩ মে, ২০২১, ১২:৫৯ এএম says : 0
    সবাই দুরর্নীতিতে নিমজ্জত টিকার খবর নেওয়ার সময় নাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Neel Kosto ২৩ মে, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
    খারাপ দেশের সাথে সম্পর্ক করে কোন কিছু আদায় করা মুশকিল। ভারতীয়রা কতটা জগন্ন সেটা দেশের মানুষ ভালো করেই জানে। কিন্তু এই সরকার যেহেতু ওদের সাহায্যে ক্ষমতা এসেছে এজন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারছে না। অবৈধ ও ভোটারবিহীন সরকার হওয়ার কারণে এই সরকারের ভিত্তি মজবুত নয়। তাই কোন কাজে সফল হওয়া সরকারের জন্য অনেক কষ্টের হচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Ataur Rahman ২৩ মে, ২০২১, ৬:৪১ এএম says : 0
    গণসাস্থ্য কেন্দ্রের করোনা কিট, চীনের করোনা টিকার হিউম্যান ট্রায়ালসহ যৌথ উৎপাদনের ৯/১০ মাস আগে অনীহার ঘটনাবলী এবং গ্লোব বায়োটেক এর টিকা নিয়ে ৬/৭ মাস টালবাহানা বিষয়েও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী। এক্ষেত্রে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় জড়িত।
    Total Reply(0) Reply
  • Dadhack ২৩ মে, ২০২১, ১০:১৩ পিএম says : 0
    Muslim cannot dependent on any kafir country because they have muslim. If our country rule by Qur'an then we would have manufacture our own Covid Vaccine..
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ