Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তামাকের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় চাষ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন

প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবুল কাসেম হায়দার
বিশ^ব্যাপী তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। তামাক থেকে মূল্যবান সিগারেট বিশ^ব্যাপী প্রচুর লোকের প্রিয় পানযোগ্য সামগ্রী। আমাদের দেশে তামাকের প্রচলন প্রাচীন কাল থেকে। তামাক থেকে বিড়ি, সিগারেট তৈরি হয়। তামাক পাতা গুঁড়ো করে আমাদের দেশে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বেশ সেবনযোগ্য। আমাদের দেশে তামাকের চাষ বহুকাল থেকে চলে আসছে। তামাক দিয়ে নেশা জাতীয় পণ্য উৎপাদন করে বহু দেশ প্রচুর রাজস্ব আদায় করছে। আমাদের দেশের সরকারও তামাক থেকে বেশ রাজস্ব আদায় করছে। তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো থেকে প্রতিবছর সরকারের যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, পরোক্ষভাবে তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত লোকদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের জন্য। তামাক সেবনের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জিডিপিতেও। তামাক ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে সব ধরনের তামাক পণ্যের ওপর একই হারে উচ্চ মাত্রায় কর আরোপের দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন সময় এসেছে তামাক চাষ নিয়ে আমাদের চিন্তা করার। তামাক এমন কোন পণ্য নয়, যা ব্যবহার না করলে মানুষের কোন ক্ষতি হবে। জীবন ধারনের জন্য তামাকের কোন প্রয়োজন নেই।
২০১৩-২০১৪ সালের রাজস্ব আদায় হয় তামাক থেকে ৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। আর ২০১৪-২০১৫ সালে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৫১ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে ৯৫ হাজার। আর প্রতি বছর তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার করে ১২ লক্ষ মানুষ কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য সেবন করে দেশে মানুষের মধ্যে হচ্ছে ক্যানসার, হৃদরোগ, স্টোক, যক্ষা, প্যারালাইসিস ও শ^াসকষ্ট জাতীয় নানা কঠিন রোগ। কোটি কোটি টাকা এই খাতে ব্যয় হচ্ছে। প্রচুর লোক বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করছে। যার ফলে দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বছরে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অথচ এই খাত থেকে আমরা রাজস্ব পাচ্ছি মাত্র ১১ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এই সামান্য অর্থের জন্য আমাদের বহু মূল্যবান জীবন চলে যাচ্ছে। আর বহু প্রতিভাবান ব্যক্তি কঠিন কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এই অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। সরকার প্রতি বছর সিগারেট, বিড়ি ও তামাক জাতীয় পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করে রাজস¦ আদায় অধিক করার মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করছেন। কিন্তু তাতেও তামাক উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। তামাক ও তামাক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার কমছে না। রাজস্ব আদায় তুলনায় যেহেতু ক্ষতির ভয় অনেক অনেক বেশি, তাই তামাক উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা করতে হবে। অন্যদিকে তামাক, বিড়ি, সিগারেট আমদানিকেও কঠিনভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। তা না হলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাঁচানো যাবে না। চিকিৎসা বাবদ বিশাল ব্যয়ের লাগামকে টেনে ধরা যাবে না।
এদিকে তামাক, বিড়ি, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিড়ি, সিগারেট প্রভৃতির লেবেলে “ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” মর্মে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। তাতে তেমন একটা কাজ হয় বলে মনে হয় না। যখন ক্ষতিকর, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাই তামাক চাষ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যারা তামাক চাষ করতেন তাদেরকে ধান, গম, পাট চাষে উৎসাহিত করে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা। তাছাড়া তামাক চাষ করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ নানা রোগে প্রতিবছর আক্রান্ত হচ্ছে। এ সকল কঠিন রোগ থেকে চাষিগণ বাঁচবে, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ বাঁচবে। দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমে আসবে। মানুষের রোগ কম হওয়ার ফলে আয়ু দীর্ঘ হবে। মানুষ সুস্থ থাকবে। মানুষ বেশি দিন, সঠিক সময় ধরে কর্মক্ষম থাকবে। তাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তাই উৎপাদন খরচও আমাদের কম লাগবে। তামাক চাষ যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সমাজের জন্য একটি বড় বোঝা। তামাক চাষ বন্ধ করতে পারলে আমাদের অন্য ফসলের উৎপাদনও বাড়বে। তখন বিদেশ থেকে আমদানিও কমে যাবে। হলুদ, মসলাসহ নানা জিনিস আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি। তামাক চাষ যে পরিমাণ জমিতে হয়, তাতে অন্যান্য মূল্যবান ফসল উৎপাদন করার ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি চাহিদা বেশ কমে আসবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সিগারেট থেকে ৯ হাজার ৯৩০ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা ও বিড়ি থেকে ২৩০ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয় সিগারেট থেকে ১২ হাজার ২৬৭ দশমিক শূন্য ৩ কোটি টাকা ও বিড়ি থেকে ২৭৭ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। তামাক খাতে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দেওয়া বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো জানায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তারা বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে রাজস্ব দিয়েছে ৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তারা রাজস্ব দেয় ১১ হাজার ৫১ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের আইএইচএমইর ২০১৩ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৯৫ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও কয়েক লাখ। এসব ক্ষেত্রে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ ন্যাশনাল টোব্যাকো কন্ট্রোল সেলের (এনটিসিসি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৩ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৯৫ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও কয়েক লাখ। এসব ক্ষেত্রে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি।
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালে করা এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশের ১২ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, যক্ষ্মা, প্যারালাইসিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টসহ প্রধান আটটি রোগে আক্রান্ত হয়। এর ফলে রোগীর চিকিৎসা, অকালমৃত্যু, পঙ্গুত্বের কারণে বছরে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তামাক ব্যবহারের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ ওই সময় অনুযায়ী ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রতিবছর সিগারেট ক্রয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ ও বিড়ি ক্রয়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় হয়। বর্তমানে এই ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেড়েছে। তামাক খাত থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতে। একটি পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়। আর কোনো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যখন তামাকের কারণে মারা যান বা রোগাক্রান্ত হন, তখন সেই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এই ক্ষতি হিসাবের বাইরে।
দেশে সর্বাধিক তামাক চাষ হওয়া জেলাগুলোর মধ্যে নীলফামারী অন্যতম। স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক ক্ষতি তামাক সেবনের কারণে একজন নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় তামাক ক্রয়ের পেছনে। এখানকার মানুষ ডিম, কলা বিক্রি করে তামাক কিনছে। এই বোঝা অর্থনীতির ওপর গিয়ে পড়ছে।
স্বাস্থ্য খাতে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে করণীয় সিগারেটের যে মূল্যস্তর পদ্ধতি আছে, সেটা আগামী তিন অর্থবছরে পর্যায়ক্রমে তুলে দিতে হবে। ‘ডিউটি ফ্রি’ নিষিদ্ধ করতে হবে। তামাক কোম্পানিতে যারা কমরত আছেন, তাদের কর্পোরেট ট্যাক্স আরও ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। তামাক পণ্য রপ্তানির ওপর উচ্চ হারে রপ্তানি শুল্ক আরোপ করতে হবে। এখন সময় এসেছে তামাক চাষ নিয়ে আমাদের চিন্তা করার। তামাক এমন কোন পণ্য নয়, যা ব্যবহার না করলে মানুষের কোন ক্ষতি হবে। জীবন ধারনের জন্য তামাকের কোন প্রয়োজন নেই।
তামাক চাষ যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সমাজের জন্য একটি বড় বোঝা। তামাক চাষ বন্ধ করতে পারলে আমাদের অন্য ফসলের উৎপাদনও বাড়বে। তখন বিদেশ থেকে আমদানিও কমে যাবে। হলুদ, মসলাসহ নানা জিনিস আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি। তামাক চাষ যে পরিমাণ জমিতে হয়, তাতে অন্যান্য মূল্যবান ফসল উৎপাদন করার ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি চাহিদা বেশ কমে আসবে।
য় লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি
ধয়যধরফবৎ@ুড়ঁঃযমৎড়ঁঢ়নফ.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তামাকের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় চাষ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ