বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ ফারুক খান, এমপি : বাংলাদেশের পরিচিতি সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ হিসেবে। এ দেশের মানুষ স্ব-স্ব ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ায় সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে তারা অনুকরণীয় আদর্শ বলে ভাবে। দুনিয়ার সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। সব ধর্ম অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আদর্শকে অনুকরণীয় বলে ভাবে। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক বলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতার আদর্শ এ দেশে বিরাজমান।
কিন্তু ধর্মীয় উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসীদের কোনো দেশ-কাল নেই। তারা নানা অজুহাত ও কারণ দেখিয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সমাজজীবনকে অস্বাভাবিক ও কলুষিত করার চেষ্টা করে। যেমন ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা ধ্বংসাত্মক কর্মকাÐ চালায়। পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের ওপর। উপড়ে ফেলা হলো রেললাইন, পুড়িয়ে দেওয়া হয় বাস-ট্রাক। ককটেল ও বোমা হামলা চলতে থাকে যানবাহনের ওপর৷ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে।
অথচ শান্তি ও মানবতার ধর্ম হিসেবে ইসলাম কখনও হত্যা ও ধ্বংসের রাজনীতি সমর্থন করে না। হানাহানি-কাটাকাটি ইসলামের মর্মবাণীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধর্মীয় উগ্রবাদী ও স্বার্থান্বেষী মহল এটি জেনেও তাদের অভিলাষ চরিতার্থে ধর্মের লেবাসে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
তারা মানতে চায় না, বাংলাদেশ সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ। অথচ, এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির স্বাক্ষর বহন করছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও এদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিকÑকোনো যুগেই এই সহঅবস্থানের বন্ধন ছিঁড়ে যায়নি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম-আন্দোলনে এবং অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের সংগ্রামে বাংলার মানুষ সবসময়ই একত্রে থেকেছে। এ সময় মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে কোনো আলাদা পরিচয় তাদের ছিল না।
দেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও কাÐজ্ঞানহীনদের কারণে কখনো কখনো তাদের সুনামও কণ্টকিত হয়ে ওঠে। যেমনটি হয়েছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পাবনার সাথিয়ায়, কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ায়, সাতক্ষীরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু এলাকায়। তিন বছর আগে মতলববাজদের উš§ত্ততার শিকার হয়েছিল এসব এলাকার কিছু ধর্মীয় স্থাপনা। সা¤প্রদায়িক সহিংসতা দেশের ঐতিহ্যের অংশীদার বেশ কিছু মূল্যবান স্থাপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা ক্ষতবিক্ষত করেছে দেশের গণমানুষের অসা¤প্রদায়িক ভাবমর্যাদাকে।
প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ধর্মীয় দিক থেকে প্রায় ৮৮ ভাগ মুসলমান, প্রায় ৯ ভাগ হিন্দু, প্রায় ১ ভাগ বৌদ্ধ, প্রায় ১ ভাগ খ্রিস্টান এবং অন্যান্য জাতি প্রায় ১ ভাগে বিভক্ত। ধর্মীয় দিক ছাড়াও এই জনগোষ্ঠী আরও বিভিন্ন আঞ্চলিক স¤প্রদায়ে বিভক্ত। এখানকার সংখ্যাগুরু মুসলিম স¤প্রদায় যুগযুগ ধরে সংখ্যালঘু স¤প্রদায়কে নিয়ে সুখে-দুঃখে, মিলেমিশে বসবাস করছে।
ইসলাম শান্তি-স¤প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও স¤প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘ফিৎনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ’ (বাকারা-১৯১)। ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না’ (আরাফ-৫৬)। অমুসলিমদের প্রতিও কোনো অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী (স.)-এর প্রতিটি আচরণ সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির বিরল ও উজ্জ্ব¡ল দৃষ্টান্ত।
শান্তি ও স¤প্রীতির ধর্ম ইসলাম মানবজাতির পারস্পরিক সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সামাজিক জীব হিসেবে মানবসমাজে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রাম-মহল্লার লোকজনের সঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে বসবাস করে। তাই সমাজ জীবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে সমাজের সব স¤প্রদায় ও ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। দৈনন্দিন জীবনে আয়-উপার্জন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর কাফন-দাফন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। মানবধর্মই তো মানুষের মনুষ্যত্ব। মানুষকে তার ধর্ম তথা মনুষ্যত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিলে সে অমানুষ হয়ে যায়। তাই সর্বধর্মের মহামিলনকামী বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় নির্ভীকচিত্তে লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিষ্টান।’
মানুষের মধ্যে যেসব গুণাবলি থাকলে মানুষকে মানুষ বলা যায় এবং না থাকলে আর মানুষ বলা যায় না, সেসব গুণাবলিই মানুষের ধর্ম। সব ধর্মীয় বিধিবিধান ও আচার-অনুষ্ঠান মানবকল্যাণে এবং মানুষকে সত্য-সুন্দর ও সুখ-শান্তির দিক-দর্শন প্রদানে নিয়োজিত। তাই পৃথিবীর সব কটি প্রধান ধর্মের প্রচারকেরা মহান সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত মহামানব হয়েও সদা মানবকল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন। তাই বিশ্বব্যাপী আন্তধর্মীয় স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আন্তধর্মীয় স¤প্রীতি বা সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি একান্ত প্রয়োজন।
ইসলাম শুধু আরব ভূমিতেই নয়, বহির্বিশ্বে ক্রমান্বয়ে যখন ইসলামের পতাকা উড্ডীন হচ্ছে তখন সব বিজিত অঞ্চলে অমুসলিম ও সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের সঙ্গে সদাচরণ করার এবং পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শকে কঠোরভাবে পালন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দরুন এক্ষেত্রে যেসব শর্ত বাস্তবায়নে ইসলাম দায়বদ্ধ মনে করে থাকে তার উলেখযোগ্য বিষয় হলো- শত্রুর হাত থেকে অমুসলিমদের রক্ষা করা হবে। অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখা হবে। তাদের ধন-সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা দান করা হবে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকবে। পূজা-অর্চনা থেকে পাদ্রী-পুরোহিতদের পদচ্যুত করা হবে না। তাদের ধর্মীয় প্রতীক (ক্রুশ ও মূর্তি) বিনষ্ট করা হবে না। তাদের কাছ থেকে উশল নেওয়া হবে না। তাদের অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করা হবে না। তাদের ধর্মীয় চেতনার ওপর আঘাত করা হবে না। ইসলামে মদিনা সনদের চেতনাই হলো, কারও ওপর জোরজবরদস্তি নয়। চাপ প্রয়োগ বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা নিষেধ।
অনেকে মনে করেন, সা¤প্রদায়িকতা মানে সংখ্যালঘু নিযার্তন বা সংখ্যালঘুর উপর হামলা করা। কিন্তু না মানসিক নির্যাতনও এর মধ্যে পড়ে। তাই সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের জানমাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা ও আইনি অধিকার সংরক্ষণের আমাদের সকলকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে সা¤প্রদায়িক বিরোধ নয়, সকলের সহবস্তানের নিশ্চিত করাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
য় লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।